নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় বাড়ি শরিফুল ইসলামের। ২৩ বছরের এই যুবক দুই লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ করে এসেছেন মালয়েশিয়ায়। স্কুলের গণ্ডি না পেরোলেও তাঁকে বাংলাদেশি দালালেরা এনেছেন ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ছাত্র সাজিয়ে। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে মাসে এক-দুবার কলেজে যান, বাকি সময় কাজ করেন শ্রমিক হিসেবে।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর নগরের দামাই এলাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ফেরার পথে ট্রেনে দেখা হয় শরিফুলের সঙ্গে।
তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি দালালেরা জাল কাগজপত্র বানিয়ে তাঁকে ভর্তি করিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফরেন একাডেমি নামের একটি কলেজে। দালালেরা বলেছেন, এক বছর কাজ করলেই খরচ উঠে যাবে, এরপর থাকবে লাভ। সেই বিশ্বাসেই তিনি এসেছেন।
শরিফুলের মতো ছাত্র নামধারী আরও অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে দেখা হয় কুয়ালালামপুরে। বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করার পর একশ্রেণীর দালাল ছাত্র ও পর্যটক বানিয়ে এখানে শ্রমিক আনছেন।
শ্রমিকের চাহিদা থাকায় মালয়েশিয়ার একটি চক্রও এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকায় অভিবাসন পুলিশের সহায়তায় এরা বিমানবন্দর পার হচ্ছে। গত দুই বছরে এভাবে অন্তত দেড় লাখ শ্রমিক আনা হয়েছে। এখন শ্রমিকের সংকট থাকায় এঁরা কাজ পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে এঁদের নিয়ে ভয়াবহ সংকট হবে।
এতে বৈধভাবে শ্রমিক আনার সুযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কুয়ালালামপুরের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে বসে কথা হয় বরগুনার মোহাম্মদ জুয়েল হোসেনের সঙ্গে। মাধ্যমিক পাস না করা জুয়েল কুয়ালালামপুরের ওয়ার্ল্ড পয়েন্ট একাডেমি নামের কলেজের ছাত্র। তিনি জানান, দালালেরা দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁকে এখানে এনে কাগজপত্র বানিয়ে কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। মাসে এক-দুই দিন কলেজে যান, বাকি সময় রেস্তোরাঁয় কাজ করেন।
জুয়েল বলেন, ‘বাড়িতে বাবা-মা আর ছয় ভাইবোন। সংসারে অনেক সমস্যা। তবুও ধারদেনা করে বাবা-মা পাঠিয়েছেন। বেশি বেশি কাজ করে টাকা পাঠাব। ’
যশোরের তরিকুল ইসলাম ভর্তি হয়েছেন কুয়ালালামপুরের রিমা কলেজে।
তিনি জানান, ছাত্র সেজে এলেও ক্লাস করার ইচ্ছা তাঁর নেই। পৌনে দুই লাখ টাকা খরচ করে এসেছেন। সেই টাকা তুলতে এক বাংলাদেশির দোকানে কাজ করছেন। এক লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে এসে মুন্সিগঞ্জের জাভেদ সুলতান সেজি কলেজে ভর্তি হলেও কাজ করেন আসবাবের দোকানে।
ছাত্র সাজিয়ে শ্রমিকদের মালয়েশিয়া আনছেন, এমন কয়েকজন দালালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এক বাংলাদেশি।
আলাপকালে তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান। নারায়ণগঞ্জে বাড়ি এমন এক দালাল জানান, তিনি ১৬ বছর ধরে আছেন। এক সময় কাজ করলেও এখন বাংলাদেশ থেকে লোক আনেন। কলিং ভিসা বন্ধ হওয়ার পর থেকে তিনি ছাত্র সাজিয়ে শ্রমিক আনছেন। তিনি বলেন, ‘কেউ আসতে চাইলে প্রথমে তার পাসপোর্ট করাই।
এরপর নামের সঙ্গে মিল রেখে সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র বানাই। মালয়েশিয়ায় এখন কিছু কলেজ আছে, যারা আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা সেখানে ঘুষ দেই। ঢাকায় বিমানবন্দরে পুলিশকে টাকা দেওয়া থাকায় তারা ঝামেলা করে না। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরেও ইমিগ্রেশনকে টাকা দেওয়া থাকে।
তারাও ছেড়ে দেয়। এরপর বিমানবন্দর থেকে নিয়ে এসে আমরা কাজ দেই। ’
এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে না—জানতে চাইলে চারজন দালাল বলেন, ‘ভাই, এই বিষয় নিয়ে লিখে আমাদের ভাত মারবেন না। কলিং ভিসা বন্ধ হওয়ার পর এই করে আমরা বেঁচে আছি। আর যারা আসছে তারাও তো ভালো টাকা আয় করছে।
দেশের তো লাভই হচ্ছে। দেশে থাকলে এই পোলাপানগুলো নষ্ট হয়ে যেত। ’
মানিকগঞ্জের সুমন মিয়া, কুষ্টিয়ার আবদুল আলী, শরীয়তপুরের নাসির মিয়াসহ আরও অনেকে এসেছেন পর্যটক হিসেবে। কাজ করছেন শ্রমিক হিসেবে। দালালেরা তাঁদের কাছ থেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ছাত্র ও পর্যটক হিসেবে এভাবে শ্রমিক আনার ঘটনার বিস্তারিত তথ্য আছে বাংলাদেশ দূতাবাসে। কিন্তু তারা এটি বন্ধ করতে পারেনি।
দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ৮৭ হাজার এবং চলতি বছর ৯০ হাজার বাংলাদেশি পর্যটক হিসেবে মালয়েশিয়ায় এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ হাজার আর দেশে ফেরেননি। তাঁরা এখন বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করছেন।
এই প্রক্রিয়ায় ছাত্র বানিয়ে আনা হয়েছে এক লাখের কাছাকাছি শ্রমিককে।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশনার এ কে এম আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সমস্যা জানিয়ে দূতাবাস থেকে অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অভিবাসন পুলিশকে বলা হয়েছে, দেশে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করেন; বিমানবন্দরে এদের থামান। না হলে এরাও এক সময় অবৈধ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এদের নিয়েই বড় ধরনের সমস্যা হবে।
কিন্তু বারবার বলার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়নি।
দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মাসুদুল হাসান বলেন, ‘অবৈধ এই প্রক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারে। কোনো না কোনোভাবে মালয়েশিয়া লোক পেয়ে যাচ্ছে। এক সময় এই শ্রমিকেরা যখন অবৈধ হয়ে যাবে, তখন তারা বিপদটা বুঝতে পারবে। কলিং ভিসা বন্ধ হওয়ার পরও শুরুর দিকে এক দিনে ৮০০ করে লোক মালয়েশিয়া এসেছে।
এভাবে জনশক্তি রপ্তানি ঠেকাতে গঠিত টাস্কফোর্স বিমানবন্দর থেকে একবার অনেক ভুয়া ছাত্রকে আটকও করেছে। ’ ছাত্র ও পর্যটক হিসেবে এভাবে কত বাংলাদেশি এসেছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা ধারণা করছেন, এদের সংখ্যা দেড় লাখ।
ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ছাত্র বানিয়ে শ্রমিক আনার ঘটনায় উদ্বিগ্ন মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্ররাও। কুয়ালালামপুরের মালায়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আবু হায়াত বলেন, ‘আমাদের মতো যারা এখানে লেখাপড়া করতে আসে, এসব ঘটনা ভবিষ্যতে তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। তখন হয়তো ভুয়ারা পার পেয়ে যাবে, কিন্তু সত্যিকারের ছাত্ররা আসতে পারবে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সবার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।