আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে...
এই এখনো (রাত ১১টা) বাংলাদেশী ওয়েবসাইট নিউজ.অর্গ কিংবা ফার্নিচার বাংলাদেশে চলছে হ্যাকারদের তাণ্ডব। প্রযুক্তিবিষয়ক ফোরাম প্রজন্ম ফোরাম দুদিনের ডাটা হারিয়েছে গতকালই। প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগ টেকটিউনস এখনো লড়ছে হ্যাকারদের রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন মেরামতে। নিজস্ব ওয়েবসাইট যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই মর্যাদার প্রতীক। অথচ বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কতোটা দুর্বল - হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলো সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
২০১০ সালের প্রান্তে এসে চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক পুরো বছরে হ্যাকিংয়ের দিনপঞ্জি।
ভারতীয় হ্যাকারদের অভূতপূর্ব হামলা
২০ মার্চ রাত ১টা ৫১ মিনিটে সরকারের জেলাভিত্তিক ওয়েবসাইট 'জেলা তথ্য বাতায়ন' একযোগে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়। ৬৪টি জেলার ওয়েব পোর্টালের মধ্যে লালমনিরহাট, বান্দরবান, মৌলভীবাজার, পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ ও দিনাজপুরসহ ১৯টি জেলার ওয়েবসাইট হ্যাক করে নিওহ্যাকার নামের একটি গ্রুপ। হ্যাকাররা অবশ্য 'ইএমআইএল ইন্ডিয়ান হ্যাকার' হিসেবেও নিজেদের পরিচয় দেয়। এর মাত্র দু মাস আগে বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী ৬৪ জেলার এই ওয়েব পোর্টাল উদ্বোধন করেন।
এ সময় সাইটের মূলপাতায় হ্যাকারদের একটি বার্তা দেখা যায়। তাতে বলা হয় - 'ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপদ কর। যদি পাকিস্তান থেকে কোনো সন্ত্রাসী বাংলাদেশ হয়ে ভারতে ঢোকে, তাহলে সাইবার যুদ্ধের মাধ্যমে তোমাদের বিপদ হয়ে আসবো। আমরা ভারতে আরেকটি ২৬/১১ (মুম্বাই হামলা) চাই না। ' 'বাংলাদেশের সরকার এদিকে দৃষ্টি না দিলে সাইবার যুদ্ধ শুরু হবে.....তোমাদের ইন্টারনেট সেবাদাতাদের আমরা ধ্বংস করবো।
' হ্যাক হওয়া সাইটগুলোর মূলপাতায় প্রকাশিত একটি পোস্টারে লেখা ছিল- '২৮ ভিন্ন রাজ্য, ২৮ ভিন্ন ভাষা, কিন্তু এক কথা- 'জয় হিন্দ'। ' প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ভিত্তিক অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) দলের কর্মকর্তারা পরে জানান, যে কম্পিউটার ব্যবহার করে 'জেলা তথ্য বাতায়ন' হ্যাক করা হয় তা ভারতের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ভিএসএনএল'র সংযোগ ব্যবহার করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটে ভঙ্গুর নিরাপত্তা
■ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটটি হ্যাক হয় ২০ নভেম্বর। গুয়েভারা খালিদি নামধারী এক হ্যাকার ওয়েবসাইটের মূলপাতায় আরবি ভাষায় কিছু বার্তাও রাখেন। রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরে সাইট উদ্ধার করলেও ৪ ডিসেম্বর আবার হ্যাকিংয়ের শিকার হয়।
সে সময় HaNniBaL KsA নামের এক হ্যাকারের নাম দেখা যায় মূলপাতায়।
■ ৭ জুলাই কোনো এক সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হ্যাক হয় ৭ জুলাই। আলজেরিয়া থেকে ওয়ালিদ নামের একজন সাইটটি হ্যাক করে বলে দাবি করে। সাইটে মূলপাতায় ওই হ্যাকারের একটি ইমেইল ঠিকানাও () প্রকাশ করা হয়। ৮ জুলাই দুপুর নাগাদ সাইটটি পুনরুদ্ধার করা হয়।
প্রায় একই সময়ে হ্যাক হয় সরকারি প্রকাশনালয় বিজি প্রেসের ওয়েবসাইট। মূলপাতায় লিখে রাখা হয় - 'হ্যাকড বাই টিথ্রি৪এম'।
■ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটে ১৫ থেকে ১৬ অক্টোবরের মধ্যকার কোনো এক সময়ে। মূল পাতায় হ্যাকাররা দাবি করে- এজেডএস গ্রুপের W3CTVIP ছদ্মনামের একজন সাইটটি হ্যাক করেছে।
■ জুলাইতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইট হ্যাকারদের কবলে পড়ে।
একাধিক হ্যাকারের একটি দল সাইটটির দখল নিয়ে আপত্তিকর বার্তা লিখে রাখে।
■ ১৬ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়।
■ ৪ আগস্ট থেকে বেশ কিছুদিন হ্যাকারের কবলে ছিল দেশের প্রধান তথ্যভাণ্ডার পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট।
■ এছাড়া বিভিন্ন সময়ে হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটসহ আরো কিছু সরকারি ওয়েবসাইটে।
■ প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের এপ্রিলে তুর্কি হ্যাকারদের হাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেহ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল।
সংবাদমাধ্যমেরও রেহাই নেই
■ ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়। ওই সময়ে সাইটটিতে ক্লিক করলে 'aNa Muslim' শীর্ষক একটি বার্তা দেখা গেছে। একইদিন রাত ৮টা ৫০ মিনিটে সাইটটি আবারো সচল হয়। হ্যাকার দখলে থাকা অবস্থায় বিকল্প ব্যবস্থায় বাসসের সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
■ দেশ টিভির ওয়েবসাইট হ্যাক হয় ১৭ এপ্রিল।
আমির সালার এবং ওমিদ পিচ নামের দুই হ্যাকার কাজটি করে বলে সাইটে দাবি করা হয়।
■ অনলাইন সংবাদ সংস্থা ন্যাশনাল নিউজের ওয়েবসাইট হ্যাক করে ভারতীয় হ্যাকাররা। 'নিও হ্যাকার ওয়াজ হেয়ার'- এই বার্তা দিয়ে সাইটের মূলপাতায় লিখে রাখা হয়-
WE HAVE AN EYE ON YOU
HINDUSTAN ZINDABAD
JAI HIND
SEE THIS SCREEN-SHOT I HACKED YOUR ARMY OFFICAL WEB SITE IF YOUR CONTRY NOT SECURE BORDER BETWEEN INDIA AND BANGLADEH OHTERWICE...
■ আগস্টের শেষদিকে দৈনিক দিনকালের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়। মরক্কোর হ্যাকাররা কাজটি করে বলে মূলপাতায় দাবি করা হয়। তবে অনেকের ধারণা কাজটি বাংলাদেশী কোনো হ্যাকারেরই কাজ।
■ মরক্কোভিত্তিক একটি হ্যাকারগ্রুপ ২০০৯ সালের শেষ দিকে এসে যুগান্তর ও ইন্ডিপেন্ডেন্টের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাদ পড়েনি
■ ২০ ডিসেম্বর থেকে টানা অন্তত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় হ্যাকড হয়ে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।
■ ডিসেম্বরের শুরুতে হ্যাকিংয়ের কবলে পড়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। জুমলার প্রথম সংস্করণ দিয়ে করা সাইটটিতে হ্যাকাররা যৌন উত্তেজক ওষুধ 'ভায়াগ্রা'র একটি বিজ্ঞাপন যুক্ত করে। ওয়েবসাইটটির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের নাম রয়েছে।
■ ২৬ এপ্রিল পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ই-মেইল ঠিকানা হ্যাক হওয়ার ঘটনা ঘটে। ই-মেইল ঠিকানার পাশাপাশি অনেকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও হ্যাক হয়। এ ব্যাপারে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেন কেউ কেউ।
নামি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহালদশা
■ মোবাইল কোম্পানি এয়ারেটেলের ওয়েবসাইট বাংলাদেশে যাত্রা শুরুর শুরুতেই ২৫ ডিসেম্বর হ্যাকারদের পাল্লায় পড়ে। ব্লগার স্স্পরসের বাহিরের সৌজন্যে এখানে পাবেন এয়ারটেল সাইটে হ্যাকারদের সেই সময়কার কাণ্ডকারখানা।
■ মার্চের শুরু থেকে বেশ কিছুদিনের জন্য হ্যাকিংয়ের কবলে পড়েছিল ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের ওয়েবসাইট। হ্যাকাররা সাইটের মূলপাতা পরিবর্তন করে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আমেরিকা-ইজরায়েলের বিপক্ষে বেশকিছু বার্তা প্রকাশ ছাড়াও মুজাহিদীনদের বিজয় কামনা করে।
সাধারণ সাইটও বাদ থাকছে না
■ আগস্টের শুরুতে বিনোদনমূলক সাইট বাংলাদেশ শোবিজ হ্যাক হয়। জুমলাতে করা সাইটটিতে jakksbaba ছদ্মনামের হ্যাকার লিখে রাখে 'Bangladesh fuckbiz'! এটাও বাংলাদেশী হ্যাকারেরই কীর্তি।
■ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দু দুবার হ্যাকিংয়ের শিকার হয় আমারব্লগ।
দুবারই স্বল্প সময়ের মধ্যে সাইট পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয় ডেভেলপাররা। তবে কর্তৃপক্ষ হ্যাকিংয়ের কথা স্বীকার করেনি কোনোবারই। পরে সাইট মেইনটেন্যান্সের কথা বললেও আগে সেরকম কোনো ঘোষণাও দেয়নি।
■ বাংলাদেশের ফিশারিজ বিষয়ক তথ্য শেয়ার করার একটি অনলাইন প্লাটফর্ম হ্যাক হয় ফেব্রুয়ারিতে।
কম্পিউটার সমিতির সভাপতির করুণ দশা!
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তফা জব্বারের টুইটার, জিমেইল ও ফেসবুক একাউন্ট একযোগে হ্যাক হয় ৬ মে।
তার টুইটার একাউন্টে হ্যাকার একটি বার্তাও লিখে রাখে- 'U cant reset Password. Send a email for password. Also spread this news on Paper, TV,radio that ur facebook, gmail and Twitter ID hacked.' মোস্তফা জব্বার এর আগে বাংলা লেখার সফটওয়্যার অভ্রের ডেভেলপার ছাড়াও ইউএনডিপি ও নির্বাচন কমিশনকে হ্যাকিং ও পাইরেসিকে উৎসাহিত করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। তার মতে, অভ্রের মতো পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের কারণে দেশের সরকারি ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, হ্যাকাররা গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য অভ্রের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি অনুরাগীদের বেশিরভাগই অবশ্য মোস্তফা জব্বারের এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
বর্ষশেষে টাইগারমেটের তাণ্ডব
গত ২৯ ডিসেম্বর একযোগে হ্যাকারদের কবলে পড়ে প্রজন্ম ফোরাম (স্ক্রিনশট), লিনাক্সমিন্ট বাংলাদেশ ফোরাম (স্ক্রিনশট), লিনাক্সবিডি ফোরাম।
ওই একইদিন আরো হ্যাক হয় সংবাদভিত্তিক সাইট নিউজ.অর্গ এবং এবং ফার্নিচার বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রজন্ম ফোরাম অন্তত দুদিনের ডাটা চিরতরে হারিয়ে ফেলে। ৩০ নভেম্বর সকালে প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগ টেকটিউনস হ্যাক হয়। সাইট পুনরুদ্ধার করা গেলেও ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি। মূল সাইটে এখনো (রাত ১১টা) বার্তা ঝুলছে - 'Some upgradation is going on for Techtunes. Coming back soon.'
'টাইগারমেট' নামে পরিচয়দানকারী অজ্ঞাত বাংলাদেশী হ্যাকারদের একটি দল হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।