আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৫ বছরে ঢাকায় ৫৩৩৭ বেওয়ারিশ লাশ

আমি খুবই Innocent...!!!

আপেল মাহমুদ ১৩ সেপ্টেম্বর, গভীর রাত। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে একটি বাক্স সকালে স্থানীয় লোকজন দেখতে পেয়ে সন্দেহ হলে পার্শ্ববর্তী থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে ওই ব্রিফকেস থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ লাশটির সুরুতহাল রিপোর্ট করে পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠায়। ধারণা করা হয় তরুণীটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং সে কোনো বাসার গৃহকর্মী হতে পারে।

কিছুদিন লাশ মর্গে রাখার পরও কোনো পরিচয় না পাওয়ায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হলো। তারা বেওয়ারিশ হিসাবে লাশটি দাফন করে। ৯ মাস আগে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে অজ্ঞাত দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। সন্ত্রাসীরা তাদের গুলি করে হত্যা করে। লাশের পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়।

এভাবে প্রতিদিন ঢাকা শহরে গড়ে প্রায় ৫টি লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। এসব লাশ বেশিরভাগই পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার বলে জানা যায়। সন্ত্রাসীদের অন্তর্কলহ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, পূর্বশত্রুতার জের, রাজনৈতিক শত্রুতা, প্রেমঘটিত বিষয় কিংবা ছিনতাইকারীরা এসব হত্যাকা-ের পেছনে কাজ করছে। কিন্তু এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা সম্ভব না হওয়ায় কোনো বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার লাশের কোনো পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ দাফন করা হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় পর লাশের পরিচয় পাওয়া গেলেও সঠিক প্রমাণ ও ক্লুর অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা গত ৫ বছরে ঢাকায় বেওয়ারিশ হিসাবে মোট ৯ হাজার ৩শ ৩৭টি লাশ দাফন করা হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ১৭২, ফেব্রুয়ারিতে ১৮২, মার্চে ২০৮, এপ্রিলে ১৬৯, মে ১৮৮, জুনে ১৭২, জুলাইয়ে ১৪৫, আগস্টে ১৩৯, সেপ্টেম্বরে ১৮২, অক্টোবরে ১৫৯, নভেম্বরে ১১৬ ও ডিসেম্বরে ১৪৯ জনের লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এ ছাড়া ২০১০ সালে জানুয়ারিতে ১৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৮, মার্চে ১২৯, এপ্রিলে ১২২, মে’তে ১০২, জুনে ৬৮, জুলাইয়ে ৫০, আগস্টে ৮৪, সেপ্টেম্বরে ৮৬, অক্টোবরে ০৭ ও নভেম্বরে ১০১ জনের লাশ দাফন করা হয়। বছর পুরুষ মহিলা শিশু মোট ২০০৬ ১০৭৫ ৭১৫ ৩০৯ ২০৯৯ ২০০৭ ১১৭৩ ৭৭৩ ৩১৩ ২২৫৯ ২০০৮ ৯৬৩ ৬২৯ ২৭৫ ১৮৬৭ ২০০৯ ১০১৬ ৬৬৫ ২৯৭ ১৯৭৮ ২০১০ (জানুঃÑনভেঃ) ৫৭৯ ৩৫৮ ১৯৭ ১১৩৪ মোট ৯৩৩৭ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জানান, ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে বেশিরভাগ হত্যার ঘটনা ঘটে।

হত্যাকারীরা লাশ গুম করার উদ্দেশে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ফেলে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও লাশ ঢাকায় আনা হয়। স্থান পরিবর্তনের কারণে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। উত্তরা জোনের পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় লাশের টুকরা উদ্ধার করা হয়। যাতে তার পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় না।

এ ক্ষেত্রে আমাদেরও তেমন কিছু করার থাকে না। ডিবি সূত্রে জানা যায়, কখনো কখনো বিকৃত চেহারার লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব লাশের ছবি তার আত্মীয়স্বজন দেখলেও চিনতে পারে না। তিনি আরো জানান, অনেকে হত্যা করে লাশ রেললাইনে রেখে যায়। রেললাইনে কাটা যেসব লাশ উদ্ধার করা হয় সেগুলোর পরিচয় বের করা কঠিন।

পার পাচ্ছে অপরাধী বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ দাফন করায় পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ঘাতকদের পরিচয় কিংবা কোনো ক্লু উদঘাটন না হওয়ায় এসব খুনের কোনো বিচার হচ্ছে না। এতে তারা নতুম উদ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। মানবাধিকার কর্মীরা জানান, পুলিশের দায়িত্ব লাশের পরিচয় নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছে না এবং অনেক সময় তারা দায় এড়িয়ে চলছে।

ফলে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমাদের প্রশাসন যদি দেশের বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের ব্যাপারে আরো বেশি তৎপর হয় তাহলে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমবে। অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, প্রতিবছর এত বেওয়ারিশ লোক হওয়ার কথা না। সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে পরিকল্পিত হত্যার শিকার অনেককে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হচ্ছে। ফলে এসব হত্যার কোনো ক্লু উদঘাটিত হচ্ছে না।

যাদের দায়িত্ব লাশের ছবি পত্রিকা বা ইন্টারনেট মাধ্যমে প্রকাশ করা, সারা দেশে এর তথ্য পৌঁছে দেওয়া, তারা তা সঠিকভাবে করছে না। তারা দায়িত্ব এড়াতে লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে দিচ্ছে। কোনো ব্যক্তি তখন বেওয়ারিশ হবে যখন তার কোনো পরিচয় থাকবে না। দেশের মধ্যে কেউ হারিয়ে গেলে কোনো না কোনো থানায় জিডি হয়। কিন্তু নিখোঁজ সংশ্লিষ্ট জিডির সঙ্গে লাশের পরিচয় মিলিয়ে দেখা হয় না।

তিনি আরো বলেন, অনেক সময় পুলিশের তদন্ত করার গাফিলতি থাকায় অপরাধীরা সুয়োগ নেয়। তারা আইনের ফাঁক-ফোকর বের করে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, খুব কম সংখ্যক ব্যক্তির লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। অধিকাংশ লাশের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। ফলে এসব মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না।

শীর্ষে শাহবাগ থানা ঢাকা মেট্রোপলিটন থানাগুলোর মধ্যে বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে শাহবাগ থানা। আগে লালবাগ থানা প্রথম স্থানে থাকলেও এখন এই স্থান দখল করেছে শাহবাগ থানা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চলতি বছরে এই থানার অধীনে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৬৭টি লাশ। পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে কতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এ ব্যাপারে শাহবাগ থানায় যোগাযোগ করা হলে কোনো তথ্য নেই বলে জানানো হয়। ওসি রেজাউল করিম সাপ্তাহিক ২০০০-কে বলেন, শাহবাগ থানা ঢাকা মেডিক্যালের অধীনে হওয়ায় এখানে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বেশি।

আমরা চেষ্টা করি লাশের পরিচয় বের করে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে। যদি মার্ডার হয় তাহলে তার মামলা হচ্ছে এবং এগুলোর ছবি সিআইডির গেজেটে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানান, মার্ডার করা অপরাধীরা এখান থেকে ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যেগুলো মার্ডার না সেগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর দাফন করা হচ্ছে। দাফনের দীর্ঘ সময় পর কেউ লাশের পরিচয় জানতে পারলে সে ব্যাপারে কোনো কিছু করার থাকে না কারণ ততদিনে ওই লাশের কোনো হদিস থাকে না বলে থানা সূত্রে জানা যায়।

নেই সঠিক প্রচার বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ দাফন করার আগে লাশের সঠিক পরিচয় পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা রয়েছে। সঠিক প্রচারের অভাবে উদ্ধারকৃত লাশের পরিচয় জানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও এর প্রায় কোনোটিই বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কিত কোনো তথ্য প্রচার করে না। দু-একটি গণমাধ্যমে লাশের কথা বললেও তথ্যের ঘাটতির কারণে আত্মীয়স্বজন লাশের পরিচয় পাচ্ছে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপপুলিশ কমিশনার মোঃ মাসুদুর রহমান জানান, অনেক সময় লাশগুলো বিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

এসব বিকৃত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ফলে বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেশের মানুষ সহজে পাচ্ছে না। তবে আমাদের ওয়েবসাইটে এসব বেওয়ারিশ লাশের ছবিসহ বিভিন্ন ক্লু প্রকাশ করা আছে। প্রায় তিন মাস এসব ছবি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে কোনোটির পরিচয় পাওয়া গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাশ খুঁজতে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় উদ্ধারের জন্য ছবি তুলে রেখে লাশ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। লাশের ছবি বা কোনো ক্লু সম্পর্কে জানতে হলে গোয়েন্দা অফিসে যেতে হয়। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম অথবা অন্য কোথাও যদি লাশের পরিচয় বা ছবি টাঙানো থাকত তাহলে সহজেই লাশের পরিচয় পাওয়া সম্ভব হতো। মর্গে জায়গা নেই লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। এরপর পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।

। হাসপাতাল পোস্টমর্টেম শেষে লাশ মর্গের মরচুয়ারিতে রাখে। এভাবে প্রতিদিন প্রায় সাত থেকে দশটি লাশ হাসপাতালে আসে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ৩০টি লাশ রাখার ব্যবস্থা আছে বলে মর্গ সূত্রে জানা যায়। এ ছাড়া বছরের কিছু সময় মরচুয়ারি নষ্ট থাকে, ফলে সঠিকভাবে লাশ ব্যবস্থাপনা সম্ভব হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মর্গে কর্মরত একজন জানান, জায়গার অভাবে কোনো লাশ বেশিদিন রাখা সম্ভব হয় না। দ্রুত দাফন করার ফলে লাশের পরিচয়, মৃত্যুর কারণ বা কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত এর কোনোটিই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। মর্গে লাশের সংখ্যা বাড়লেও লাশ রাখার জায়গা বাড়েনি। ফলে অল্প জায়গায় বেশি লাশ রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, মরচুয়ারি যদি ঠিক থাকে তাহলে আরো ১০ দিন বেশি লাশ রাখা সম্ভব হতো।

এতে পরিচয় পাওয়া আরো সহজ হতো। শাহবাগ থানার ওসি জানান, বেওয়ারিশ লাশগুলো মূলত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু যে পরিমাণ লাশ পাওয়া যাচ্ছে তা রাখার মতো জায়গা ওখানে নেই। ফলে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত মর্গে লাশ রাখার স্থান বৃদ্ধি করা।

তৎপর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফনে দীর্ঘদিন ধরে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বেওয়ারিশ লাশ দাফন কার্যক্রমের মাধ্যমেই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পরিচিতি। এখানকার উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, দুভাবে বেওয়ারিশ লাশ এখানে দাফন করার জন্য নিয়ে আসা হয়। মেডিক্যালের মাধ্যমে এবং থানার মাধ্যমে। সাধারণত মেডিক্যাল থেকে যেসব বেওয়ারিশ লাশ এখানে নিয়ে আসা হয় সেগুলো কাটা-ছেঁড়া অবস্থায় থাকে বিধায় সেগুলো গোসল ও দাফন করা কিছুটা কষ্টকর।

অন্যদিকে যে কোনো দুর্ঘটনায় যে লাশগুলোর পরিচয় পাওয়া যায় না সেগুলো বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে আঞ্জুমান মুফিদুল দাফন করে থাকে। বেওয়ারিশ লাশ ছাড়াও দরিদ্র মানুষের লাশও বিনামূল্যে দাফন করে থাকে এ সংস্থা। আজিমপুর কবরস্থান ও জুরাইন কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। লাশের গোসল, কাফন পরানো এবং লাশ কবরস্থানে পৌঁছে দেওয়ার সব কাজই করে থাকে আঞ্জুমান মুফিদুল। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যে কোনো সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দিন-রাত যে কোনো সময় সংস্থার প্রধান কার্যালয় এসকে দাস রোড, গেণ্ডারিয়া ফোন-৭৪১১৬৬০ এবং কাকরাইল সেবাকেন্দ্র-৯৩৩৬৬১১ টেলিফোন কিংবা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করতে পারবে সমাজের যে কোনো শ্রেণীর মানুষ।

লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।