ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............
আমাদের মাঝে মাঝে ডুব দিতে হয়। বাদবাকি সময় সমানে-অসমানে,সমান্তরালে-বিপরীতে ভাসতে হয়। মাঝেমধ্যে আমাদের বেশিরভাগেরই মানসিকতার,চলনবলনের অর্থ হয়ে যায় -এক কথায়- তুলনা । মানুষে মানুষে তুলনা চলে। মানুষের তুলনা বিস্তৃত হয় পশুতে-পাখিতে,গাছ-গাছালির নামে,প্রকৃতিতে।
অন্য একজনকে জানে সে। তারপর আবার অন্য একজনকে জানার লোভ করে অথবা করে না। তবু জানার গতি দ্রুত হয়ে যায়। একজন ব্যক্তি মানুষ এভাবেই ভিন্ন হয়ে যায়। বিভিন্নতার স্বাদ পায়।
অস্তিত্বের সংকট আসে। সাথে আসে সফলতার চেষ্টা । ব্যর্থতার জন্য ভুলবার ওষুধের দরকার পড়ে। একজন মানুষকে এড়িয়ে চলে আর একজন। তুলনার অন্য নাম হয়ে ওঠে ভয়।
আবার তুলনা না করলে জীবন হয়ে ওঠে না।
ক.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ র উপন্যাসগুলো ১৯৯৬ সালে প্রতীক প্রকাশনা সংস্হা থেকে 'উপন্যাসসমগ্র' নামে বের হয়। সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে হায়াত মামুদ 'গ্রন্হপরিচয়','জীবনপঞ্জি','গ্রন্হপঞ্জি' নামে তিনটি পরিশিষ্ট যুক্ত করেছেন। 'সমগ্র'টিতে উপন্যাসও তিনটি,পূর্বপ্রকাশিত গুলো(অপ্রকাশিত আর ইংরেজি ভাষায় লেখা আরও দু'টি উপন্যাসের বাঙলা করে প্রকাশ করা হয়েছে 'প্রথম আলো'র ঈদ সংখ্যায়,পরে)।
'উপন্যাসসমগ্র' বইটির ভূমিকায় সম্পাদক আন মারি ওয়ালীউল্লাহ্ কে উদ্ধৃত করেছেন,
'He often said he wanted to write about a clean man'.
সম্পাদকের ভাষায়, ওয়ালীউল্লাহ্ র 'মজিদ তাহের -মোস্তফা কেউই তো clean নয় 'হায়াত মামুদের বিশ্লেষণ,'ঘটনাহীন জীবনেরও কাহিনী থাকে।
'কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্ কাহিনী লিখেছেন। তার চেয়েও বেশি লিখেছেন ব্যক্তিকে:সেই ব্যক্তি সমাজের সাথে যত বেশি সম্পর্কিত ,তত বেশি সমাজবিচ্ছিন্ন । উপন্যাস তিনটার মধ্যে 'চাঁদের অমাবস্যা ' মানেই বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ নিয়ে সবার সেরা উপস্হাপন । আর এই দর্শন আনা সম্ভব হয়েছে পারস্পরিক তুলনার মাধ্যমে,'foil character' ব্যবহার করে।
'চাঁদের অমাবস্যা'র কাহিনী,ইরেজিতে যাকে বলা চলে story,মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার।
অথচ সাজানোর কৌশল,আধুনিক ব্যাখ্যার প্রয়োজনে এগিয়েছে অনেক দূর। বলা চলে কৌশলে প্রবেশ করেছে কাহিনীর আরও গভীরে। যেখানের চরিত্রগুলোর বিস্তারিত মন আছে। যেখানে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রশ্ণ মাথা তুলতে পারে,যেখানে ভিন্ন জনের ভিন্নতার পোস্ট মর্টেম প্রকাশের সুযোগ চলে আসে।
যুবক শিক্ষক আরেফ দাদাসাহেবের বাড়িতে আশ্রিত ।
দাদাসাহেব বড়ঘরের মানুষ। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি ধর্মপ্রাণ বা ধর্ম-আপ্রাণ। তাঁর ছোট ভাই অন্যধরনের মানুষ যার সাথে কারও তুলনা চলে না। ছোটবেলায় দুরন্ত স্বভাবের ছিল তবে পরিবর্তন চলে এসেছে সফল বিপ্লবের মতো।
বর্তমানের শান্ত আর বিচ্ছিন্ন মানুষটি দাদাসাহেবের কাছে অতি ভিন্ন একজন।
দরবেশতুল্য।
'পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়েও শুয়ে নাই। তারপর কোথায় তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে। যুবতী নারীর হাত পা নড়ে না।
চোখটা খোলা মনে হয়,কিন্তু সত্যিই হাত পা নড়ে না। তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনে নাই। '
এভাবে যুবক শিক্ষকের অস্তিত্বের শুরুটা হয় উপন্যাসের প্রথমেই। তার শুরুটা হয ধবধবে আলোতে।
তবে সে আলো সবকিছু অস্পষ্ট করে তোলে। রাতের বেলা ছোট্ট জৈবিক কাজে বের হয়ে সে আবিষ্কার করে এক যুবতীর লাশ । এমনকি হত্যার ঘটনাটার একরূপ সাক্ষীও হয়ে পড়ে। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারে না কিছুতেই। ঘটনা তাকে তাড়া করে ।
কাদেরের সাথে জড়িয়ে পড়ে সে অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে। তাকে ডেকে নিয়ে যায় কাদের। তারা দু'জনে লাশটি নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কাদের সম্পূর্ন ভিন্ন মানুষ। সমাজে তার অবস্হান অন্য।
যুবক শিক্ষক যে পরিবারে আশ্রিত সেখানে কাদের দরবেশতুল্য। কিন্তু এই অন্যরকম মানুষের থেকে যুবক শিক্ষকের দূরত্ব দূর হয়?হয় না। হওয়ার মতো না। তবে সবচেয়ে অসমান্তরালভাবে যুবকের মনে আশা চলে আসে। একাকিত্ব ঘুচানোর আশা।
বন্ধুর আশা। সে ভাবে,'দু-জনেরই বন্ধুত্বের বিশেষ প্রয়োজন। তারা একটি গুপ্তকথার মালিক। সে গুপ্তকথা একাকী বহন করা যদি কষ্টসাধ্য হয়,তবে বন্ধুত্বের সাহায্যেই তারা তা অনায়াসে করতে পারবে। '
অথচ তারা যে সম্পূর্ণ বিপরীত তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় দু'জনকে জানার প্রথম থেকেই।
আরও সচেতন মন নিয়ে পড়লে হয়তো যুবক শিক্ষককে পরিষ্কারভাবেই বোকা বলে মনে হতো। সে হয়তো আসলেই বোকা। আর সেজন্যই কাদেরকে এত বেশি চালাক প্রমাণ করা যায়। একজন চালাকের সামনা সামনি বা পাশাপাশি একজন ' আও বোঝেনা ভাও বোঝে না,মনের কথা তাও বোঝে না' গোছের মানুষের চলে আসাটা যেমনি দরকারি তেমনি স্বাভাবিক। না হলে চালাকের সুযোগ কাজে লাগানো কৌশল অদেখা থেকে যেত।
বোকা শিখত কিভাবে?
কিন্তু 'চাঁদের অমাবস্যা' শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয় নাই,অবশ্যই। যুবক শিক্ষক আসলে কিছুই শেখে না । জানে শুধু।
জানার প্রয়োজনীয়তা মাঝে মাঝে ভুলে যায় অথবা যেতে চায়্ যুবক শিক্ষক আরেফ আলী।
বন্ধু হতে চেয়ে ভিন্ন একজন কাদেরের বিপরীত রূপ ভুলতে চায় সে।
তুলনা করে তাদের মধ্যে অন্তত একটি সমতা আনতে চায়। এরপর অনেকটা অগোছালো হয়ে যায় সে।
তুলনার ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারণ তাদের বন্ধুত্বের কোন রকম সম্ভাবনাই দেখা যায় না।
একসময় লাশটা ভেসে ওঠে। লাশের পরিচয় জানা যায়।
খুনির পরিচয়ও পাঠকদের জানানো হয়ে যায়। কাদেরের ভিন্নতার কুৎসিত পরিচয়টা পাওয়া যায় । একজন দেহসর্বস্ব প্রেমিক আর লুকাতে চাওয়া খুণী। ।
কিন্তু রহস্যোপন্যাসের মতো এখানে শেষ হয় না বরং শুরু হয় সত্যিকারের দ্বন্দ্বের।
আরেফ আলী নিজের কাছ থেকে নিজেই ভিন্ন হয়ে যায়। সে দুইজন বিপরীত মানুষ হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে যেন বারবার তুলনা চলে। একজন চায় সত্য চেপে যেতে যার মানে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া। এখানে কোন বিপদ হওয়ার কথা না।
অন্য একজন সত্য প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চায়। আশ্রয়,আইন,সমাজ,পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা সবকিছু তার জন্য পিছে পড়ে থাকে। নিজের অস্তিত্বই সেখানে একক সত্য। সত্যের প্রকাশই তার একমাত্র অস্তিত্ব।
সে জানিয়ে দেবে বলে যখন স্হির করে ,যখন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দাদাসাহেবকে জানাতে যায়,তার নিজস্ব সকল ভিন্নতার অবসান হয়;কিন্তু জানানোর পর সবার কাছ থেকে ভিন্ন হযে পড়ে।
তাকে আলাদা হতে হয়। তার মতো ,তার হয়ে আর যেন কেউ নেই । তার উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । যুবক শিক্ষকের বক্তব্য শোনার পর 'পুলিশ-কর্মচারীর মুখে বিরক্তির ভাব জাগে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্য কেবল।
তারপর সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বাজে কথার সময় শেষ হয়েছে। '
কাদের বড় ঘরের ভিন্ন রকমের মানুষ। সে ডুব দেয়। তাকে আড়াল হতে দেখে যুবক শিক্ষক মড়ার মতো ভেসে ওঠে।
ভিন্নই থেকে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।