না চাইলেই পাই, না চাইতে চাই
লাবণ্য ছিল নাকি চিকন শ্যামলা। শ্যামলার চিকন মোটা কাকে বলে জানি না (কেউ জানলে আওয়াজ দিয়েন), কিন্তু শ্যামলা যে সেটা জোরের সাথে বলতে পারি, কারণ পাশেই 'শেষের কবিতা' র সংঘাতের পাতাটা খোলা। শেষের কবিতা পড়েছে, কিন্তু লাবণ্যকে একবারও মনে ধরে নাই, এরকমটি আমি আজও পাই নাই (তবে থাকার সম্ভবনাটাও উড়িয়ে দিচ্ছিনা, এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব, বেঁচে থাকাটাও )। রবিঠাকুর কেন এটা করেছেন জানি না, তবে যা করেছেন সেটা অতি চমৎকার। আমার কাছে মনে হয়, এ যেন লাবণ্যের লাবণ্য বাড়িয়ে দিল বহুগুনে।
আমাদের সমাজে এরকম মানুষ অসংখ্য, যারা নিজের গায়ের রং নিয়ে বিব্রত। আর হবে নাই বা কেন, সেই কবে থেকে আমরা গোরা দের অধস্তন। আর্যরা গোরা, ইংরেজরা গোরা। আর উপরওয়ালার মুখপানে 'কাউয়ার' মত চেয়ে থাকা, তাদের অন্ধ অনুকরণ তো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আর মানুষের মনের এই খুঁতখুতানি কে পূঁজি করে নিজেদের লাভের বোঝা ভারী করছে (আমার নাম উল্লেখ করার দরকার আছে কি?) কতিপয় কোম্পানি (এদের 'বেশি পানি' বলাই ভালো, এরা অগাধ জলের মাছ কিনা!)।
এদের বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে যেমন রাগে গা গিরগির করতে থাকে, তেমনি করুণা হয়। যদি এরা সত্যি কারো গায়ের রং ফর্সা করতে পারত, তাহলে কেন ওরা ফর্সা মডেল ব্যবহার কর? কয়েক বছর আগেও মনে হত, এগুলো নারী জাতির জন্য অবমাননাকর, কিন্তু এখন যে হারে ছেলেদের ত্বকের জন্য 'ইস্পিশাল' ফেয়ারনেস ক্রিম বার হচ্ছে, তাতে আগের ঝালটা সামান্য কমেছে বই কি (আমার কাছে কিন্তু ফর্সা হবার পর সব কয়টা মডেল কেই চরম ক্যাবলা কান্ত লাগে )।
কিন্তু কি লাভ এই সব ঘষে ফর্সা হয়ে। আমাদের পৈতৃক ও মাতৃক সম্পত্তিকে এভাবে বেদখল হতে দেওয়াটা কি নিজেকে অপমানের সামিল না? ধরুন যদি এমন হতো, পৃথিবীতে রাজত্ত্ব হত আমাদের উপমহাদেশীয়দের মত শ্যামলাদের কিংবা আফ্রিকান নিগ্রোদের, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াতো। আমার কাজটা সহজ করে দেওয়ার জন্য ওঁ রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম কে ধন্যবাদ (কে আছেন স্বর্গে গিয়ে উনাকে এই বার্তা জানিয়ে আসবেন? )।
উনার 'উলটপুরান' থেকে নিচের অংশটুকু মেরে দিলাম (যে ধন্যবাদটা জানাতে যাবেন, তিনি দয়া করে এই স্বেচ্ছাকৃত নকলটার জন্য ছুইটলি ছরি ও বলে আসবেন, প্লিইইইজ )।
''অম্বুরী বরুণ : মেমগণদের দুঃখ এইবার দূর হইল। এই আশ্চর্য গুঁড়া মুখে মাখিলে ফ্যাকাশে রং দূর হইয়া ঠিক বাঙালী মেয়ের মতন রং হইবে। যদি আর একটু বেশী ঘোর করিতে চান, তবে ইহার সঙ্গে একটু বের্দিগ্রীন মিশাইয়া লইবেন। রামচন্দ্রজী উহা মাখিতেন।
দাম প্রতি পুরিয়া পাঁচ শিলিং। বিক্রেতা - শেখ অজহর, লেডেনহল স্ট্রীট, ইন্ডিয়া হাউজ, লন্ডন। ''
অবশ্য এত ঝামেলা না করিয়া কয়লা বিভিন্ন অনুপাতে পানিতে মিশ্রিত করিয়া চর্মে লেপন করিলেই তো সকল ল্যাঠা চুকিয়া যায়। এই রে, সাধু লিখতে লিখতে নিজের কথাটাও সাধু হয়ে গেল। এই আইডিয়াটা কিন্তু একদম আমার।
বিশ্বাস না হলে যান না, 'উলটপুরান' এর পাতা উলটে দেখুন।
উন্নত বিশ্বে দেখি, তারা জন্মদিনের পোশাক পরে, কুমিরের মত হাত পা ছড়িয়ে সমুদ্রের তীরে রোদ স্নান করে (ওদেশে পানিও নেই, বাড়ির সামনে আচার শুকানোর উঠানো নেই, কি আফশোস! )। এই রকম কর্মের কারণ, আমি যতদূর জানি, তারা চামড়ায় যথেষ্ট মেলানিন তৈরি করে ত্বকের ক্যান্সার থেকে বাঁচার জন্য (জানায় ভুল থাকলে শুধরে দিবেন)। আর আমরা কিনা আমাদের গায়ের মেলানিন গুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইছি!
আরো অনেক যুক্তিই দাঁড় করানো যায়, শ্যামলার পক্ষে, কালোর পক্ষে। কিন্তু মন চোখে অন্ধ আর কানে কালা হলে ব্লগ লিখেও লাভ নেই, মাইকিং করেও লাভ নেই।
তবুও বলতে ইচ্ছা হয়, '' কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ ক্যানে?''
(কবি - তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।