কবি হওয়ার ভান করি, উদাস হই; ভালোবাসার মাহাত্ব খূঁজি
রাশেদুল হাসান
সত্য প্রকাশ বা উচ্চারণ পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই সুখকর ছিল না। সত্যান্বেষী ব্যক্তিদের যুগে যুগে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হতে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের হাতে। স্বার্থবাদীদের রক্তচক্ষুর বিষাক্ত দৃষ্টি পড়েছে সত্য প্রকাশের পতাকাবাহীদের উপর। বিশ্ববিখ্যাত মনিষী সক্রেটিসের মতো ব্যক্তি সত্য উচ্চারণের জন্য ক্ষমতাসীনদের রুদ্ররোষের শিকার হন। কারারুদ্ধ হন তিনি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতে গিয়ে রাজ পরিবারের সদস্য হয়েও বার্ট্রান্ড রাসেলকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। আদিপত্যবাদীদের হাতে বলি হয়ে হয়েছে অসংখ্য সত্যপিয়াসী মানুষকে। ‘যারা ওদের মুখোশ উম্মোচন করে দিতে চায় তাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন নিপীড়ন। যারা ফাঁস করে দেয় ওদের হরিলুটের কীর্তি-কাহিনী তাদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হয় হাতুড়ি বাহিনী। ’ কিন্তু এ সত্য প্রকাশ থেমে থাকেনি।
সত্যানুসন্ধানী মানুষ কালে কালে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় অত্যাচারের ‘ব্লু প্রিন্ট’ প্রকাশ করেছে। গোপন কথাটি গোপনে থাকতে পারেনি জাতীর এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য।
প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের তথ্য জানবার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারও রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত হয়। তবে সত্য প্রকাশ এবং তথ্য গোপনে ক্ষমতাসীন সরকার এমন করেন কেন? রাষ্ট্র তার স্বীয় কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য জনগণের কাছে।
আর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়তো সাংবিধানিকভাবে সে অধিকার পায় জনগণ। তবে কেন রাষ্ট্রীয় কুকীর্তি-অন্যায়-অত্যচার প্রকাশে জীবন দিতে হয় মানুষকে। গণতন্ত্র মানুষকে ন্যায্য অধিকার দেয়। কথা বলার অধিকার দেয়। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম রাষ্ট্রের অনিয়ম-দুর্নীতি বিশেষ ক্ষেত্রে গোপন নীতি বা চুক্তিগুলো প্রকাশ করে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির ভুরি ভুরি। আবার গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের উপর শারিরীক এবং মানসিক নিপীড়নসহ গুম করার ঘটনাও পৃথিবীর ইতিহাসে কম নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, পর্তুগালসহ বহু উন্নত এবং অনুন্নত দেশে এমন কর্মকান্ড পরিচালনার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলার এবং মুসোলিনী গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের নতুন পন্থার ব্যবহার শুরু করেন। তারা সরকারী দলের যুবক শ্রেণীকে লেলিয়ে দেয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এবং তার সঙ্গে যোগ দেয় সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা।
একই কর্ম সম্পাদন করেছিলেন সালাজার ও ফ্রাংকের মতো একনায়করা। গণমানুষ ও মাধ্যমকে ওরা নিক্ষেপ করেছিল একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কঠিন নিগড়ে। ইতিহাস এদের সকলকেই স্মরণ রেখেছে যার যার মতো করে।
আধুনিক বিশ্বের প্রায় দেশেই সরকার এবং তার দোসর বাহিনী সত্যপ্রকাশী গণমাধ্যমের উপর ছড়াও হয়েছে। একনায়কতন্ত্রের পাশাপাশি বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে খ্যাত সরকারগুলো যখন তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়, আর তখনই দুর্দিন নেমে আসে এসব গণমাধ্যমের।
কারণ গণমাধ্যমই তাদের অনধিকার, অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক, মানবতাবোধ বিবর্জিত ও ফ্যাসিস্টিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে পারে। আর গণমাধ্যমের সামান্যতম প্রতিবাদও জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়।
স¤প্রতি মানবজাতীর ইতিহাসে ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে বেশী গোপন তথ্য প্রকাশ করেছে একটি ই-গণমাধ্যম। একসাথে এত গোপন তথ্য প্রকাশের আর কোন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কুকীর্তির খবর ফাঁস করে দিয়ে গত একবছর ধরে আলোচনা শীর্ষে উইকিলিকস নামের এ ওয়েব সাইট।
এ সাইটটি ২০০৭ সালে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নামের একজন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এ সাইটটি নিজেদের ‘অনাবি®কৃত ব্যাপক নথিপত্র ফাঁস ও বিশ্লেষণের জন্য সেন্সরবিহীন উইকিপিডিয়া’ বলে দাবি করে। ২০০৭ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের এক হেলিকপ্টার হামলায় রয়টার্সের দু’জন সাংবাদিকসহ একডজন বেসামরিক লোককে হত্যার গোপন ভিডিও দৃশ্য প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি কওে গণমাধ্যমটি। কেনিয়ার সরকার অনুগত পুলিশ ৫শ’ লোক হত্যা ও গুম করার খবর ‘দ্য ক্রাই অব ব্লাড এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং এন্ড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ তথ্য চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করে সাইটটি। আর এ তথ্যচিত্রের জন্য গত বছর অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল অ্যাসাঞ্জকে।
দীর্ঘ চার বছর এ সাইটের কার্যক্রম চালু থাকলেও গত ২৮ নভেম্বর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২শ’ ৭৪ টি দূতাবাস থেকে পাঠানো গোপন তারবার্তাগুলো প্রকাশ করে। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সাল থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারী ২০১০ পর্যন্ত যেসব তারবার্তা মার্কিন দূতাবাস গুলো পাঠায় তার মধ্য থেকে ২ লাখ ৫১ হাজার ২শ’ ৮৭ টি তারবার্তা উইকিলিকস গত ২৮ নভেম্বর থেকে প্রকাশ করতে শুরু করে। কিন্তু উইকিলিকস কেন ফাঁস করলো এসব তথ্য? এ ফাঁসে কিইবা উদ্দেশ্য উইকিলিকস প্রধানের। এর উত্তর অবশ্য উইকিলিকস এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জ দিয়ে দিয়েছেন। তার ভাষায় এই ‘মেগালিকস’ হচ্ছে করপোরেট ও সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিশ্ব তথ্যযুদ্ধের একটা অংশ।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ব তথ্যযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এছাড়াও বিগত জুলাই মাসে ‘উইকিলিকস’ আফগান যুদ্ধ বিষয়ক ৯০ হাজারেরও বেশি নথিপত্র দেয় বিশ্ববাসীকে। অক্টোবরে ইরাক যুদ্ধ বিষয়ক প্রায় ৪ লাখ দলিল ফাঁস করে উইকিলিকস। এ সময় উইকিলিকস এর পক্ষ থেকে বলা হয়, মার্কিন ও মিত্রবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন ইরাকি জনগণের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে আমরা সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছি। উইকিলিকস এমন সব প্রামাণ্য দলিল পেশ করেছে, সেখানে মার্কিন জোট বাহিনীর লুটপাট ও গণহত্যার কথা লেখা হয়েছে।
মাত্র ৫ শতাংশ জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বের ২৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে। আর এ সম্পদ অর্জনের জন্য মিথ্যা, জালিয়াতি, জোচ্চুরি, গুপ্তহত্যা, হামলা চালানোর হুমকি, দমন, নির্যাতন, গণহত্যাসহ কোন ধরণের অপরাধ থেকে পিছু হটছেন না। ১৯৫০ সাল থেকে সরাসরী সেনা অভিযান চালিয়ে ৩০ টির মতো দেশ দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখনো সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যুদ্ধ করছে মার্কিন সেনারা। আর দখল করে আছে তিনটি ভূখন্ড ইরাক, আফগানিস্তান ও দিয়াগো গার্সিয়া।
আরো অনেক ভূখন্ডে যুদ্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সাথে ওয়াশিংটনের মিত্র অনেক দেশও বিভিন্ন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের ভূখন্ড দখল করে আছে। বর্তমানে বিশ্বের ৬৩টি রাষ্ট্রের ৭শ’ থেকে ৮শ’ সেনাঘাটি পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২ লাখ ৫৫ হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে ১শ’ ৫৬ টি রাষ্ট্রে। এসব করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী যে ক্ষতি করে চলেছে তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন ড. গিদিয়ন পলিয়ার।
পরিসংখ্যানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের একবার মহাশূন্য ষ্টেশনে ফ্লাইট পরিচালনার খরচ দিয়ে বছরে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু রোধ করা যায়। ওবামা প্রশাসনের আমলেও সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ডগুলোতে প্রতিদিন এমন ১ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটছে যাদের সহজেই সুরক্ষা দেয়া যেত। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয়ে এ পর্যন্ত ৮০ লাখ মানুষ মারা গেছে। এদের মধ্যে ইরাকে ২৫ লাখ, আফগানিস্তানে ৪০ লাখ ৯০ হাজার এবং ৮০ হাজার কথিত মাদকবিরোধী অভিযানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে ১৯৫০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অধিকৃত এলাকায় এড়ানো যেত এমন মৃত্যুর সংখ্যা ৮ কোটি ২০ লাখ এবং ৭২ কোটি ৭০ লাখ।
অনুর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৯০ হাজার এবং এড়ানো যেত এমন ১৩ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। ১৯৫০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের আগ্রাসনের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে ১শ’ ৩ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এদের মধ্যে ১শ’ ২ কোটি ইউরোপের বাইরে, ৬০ কোটি মানুষ মারা যায় মুসলিম বিশ্বে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইহুদি ‘হলোকাস্টের’ চেয়ে মুসলিম ‘হলোকাস্টে’ প্রাণ হারিয়েছে দশ গুণ বেশি। বিশ্ব এখন পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
আর এটা মানুষের তৈরী গ্রীণ হাউস গ্রাসের কারণে। স¤প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট ও আলোচনায় আসবে না এমন বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এ শতাব্দিতে ১শ’ কোটিরও কম মানুষ বেঁচে থাকবে। এতে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯শ’ ৫০ কোটিতে দাঁড়াবে। অন্যদিকে পরিবেশ সৃষ্ট গণহত্যার এ শতকেই প্রাণ হারাবে ১ হাজার কোটি মানুষ। এদের মধ্যে ৬শ’ কোটি অবুঝ পাঁচ বছরের শিশু, ৩শ’ ৮০ কোটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘হলোকাস্টে’, ২শ’ কোটি ভারতীয়, ১শ’ ৩০ কোটি অমুসলিম আফ্রিকান, ৫০ কোটি বাঙালি, ৩০ কোটি পাকিস্তানী এবং ৩০ কোটি বাংলাদেশী।
এমন অসংখ্য সত্য প্রকাশ এবং সত্য প্রকাশের আন্দোলন শুরু করার জন্য বিশ্বের নানা দেশে উইকিলিকস প্রধান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। ইন্টারপোল তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড ঘোষণা করেছে। আমেরিকান আইএসপি তার ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেয়। হোয়াইট হাউজ বলেছে, অ্যাসাঞ্জকে থামাতে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করা হবে। রিপাবলিকান দলের কেউ কেউ চাচ্ছেন তাকে হত্যা করা হোক, আবার কারো দাবি গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তার বিচার করা হোক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন বলেন, যারা এ চুরির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অসংখ্য অন্যায় গোপন করা অন্যায় নয়, আর সে সব অন্যায় প্রকাশ করাটাই অন্যায় হয়ে গেল মার্কিন সরকারের কাছে। তাকে স্তব্ধ করে দিতে অবশেষে অ্যাসাঞ্জকে কথিত নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্বব্যাপি শুরু হয় প্রতিবাদ। অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য অবস্থান ও কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছেন গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিশ্বাসী বিভিন্ন দেশের মুক্তচিন্তাবিদ, বিশিষ্ট সাংবাদিকসহ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
বিখ্যাত মার্কিন বুদ্ধিজীবি, ভাষাতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষালবম্বন করে তাকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়ান গিলার্ডের কাছে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কড়া সমালোচনা করেন। অস্ট্রেলিয়ার নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. গিদিয়ন পলিয়া উইকিলিকসকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, বিশ্বের মূল ধারার গণমাধ্যমে উইকিলিকস এ প্রকাশিত ভয়াবহ চিত্রের ছিঁটেফোটাও প্রকাশ পায়না। এরা উইকিলিকস স্পর্শকাতর কোন রিপোর্ট প্রকাশ করে কেলেঙ্কারী ঘটিয়েছে তা বিশ্লেষণে ব্যস্ত। এরা বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা হলোকাস্ট বা গণহত্যা নিয়ে টু শব্দটিও করছে না। এ সব নৃশংসতাকে পন্ডিতরা বাঙালি হলোকাস্ট, মুসলিম হলোকাস্ট, ইরাকি হলোকাস্ট, আফগান হলোকাস্ট, ফিলিস্তিনী গণহত্যা ও পরিবেশগত গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করলেও মূলধারার গণমাধ্যমে এসব চিত্র একেবারেই অনুপস্থিত।
মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর এই ধরণের আচরণের জন্য ডক্টর গিদিয়ন পলিয়া ‘গণতান্ত্রিক ফেসিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশিষ্ট আমেরিকান কলামিস্ট ডেভিড স্যামুয়েল ‘দ্য আটলান্টিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত কলামে বলেন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে লজ্জাকর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয় সত্য প্রকাশী জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের জন্য। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার লন্ডন হাইকোর্ট অ্যাসাঞ্জকে জামিনে মুক্তি দেয়। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দুই লাখ পাউন্ড বা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৪শ’ ডলার জরিমানায় জামিনে মুক্তি দেয় লন্ডনের হাইকোর্টের বিচারক ডানক্যান উইসলি।
সত্য প্রকাশের দায়ে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের নির্মম স্বীকার হতে হয়েছে বাংলাদেশ নামক আমাদেও এই ছোট্ট রাষ্ট্রটি গঠনের পরপরই। গণমাধ্যমের ইতিহাসে নির্মমতার শিকারে এই ক্ষুদ্র দেশটি প্রতিকৃতির ভূমিকা পালন করবে নিশ্চয়ই। দেশ গঠনের প্রথম বছরে রাজনৈতিক কারণে সত্য প্রকাশের দায়ে ১০টি সংবাদপত্র প্রকাশনা স্থগিত ও একটি বাজেয়াপ্ত করে। তার পরের বছর ১৯৭৩ সালে ১শ’ ৮ টি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ গ্রেফতার করে সত্য প্রকাশের দায়ে।
তৎকালীন সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই কবি শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন ওমর, সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, এনায়েত উল্যাহ খান, আলী আশরাফ, আলমগীর কবির সহ দেশের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবিরা প্রতিবাদমুখর বিবৃতি প্রদান করেন। যুদ্ধপরবর্তী একটি দেশের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সরকার তথ্য প্রকাশকে প্রধান সমস্যা মনে করে গণমাধ্যম ও সত্য প্রকাশের ব্রত ব্যক্তিদের উপর নির্যাতন চালায়। তৎকালীন অসহনশীল আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭২ সালে মাওলানা ভাসানী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি খোলা চিঠিতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে যদি পত্রিকা প্রকাশনার সাধারণ অধিকারটুকু না থাকে তবে আমি এদেশে থাকতে চাই না। হয় পত্রিকা প্রকাশনার জন্য অনুমতি দানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দাও নয়তো আমাকে এই দেশ থেকে বহিষ্কার কর। যাতে অন্য কোন সত্যিকারের স্বাধীন দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারি এবং বর্তমান মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।
’ মাওলানা ভাসানী মাত্র এক বছরে সত্যিকারের স্বাধীন দেশ খোঁজার মানে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। সত্য ও সত্যপ্রকাশের আকাল স্পষ্টত ভাসানী’র উপরোল্লিখিত বাক্যে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় সরকারী নির্দেশ মেনে সংবাদ পরিবেশন না করায় ৬টি পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত ও ২টি পত্রিকার প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ১৬ জুন দেশের ২শ’ ২২ টি পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। মুখে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, সত্য প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বললেও কার্যত এই দলটি তার জন্মলগ্ন থেকেই ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী এবং সমালোচকদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর,দৃঢ় ও অসহনশীল।
অ্যাসাঞ্জের যে তথ্যযুদ্ধ এই তথ্যযুদ্ধ আরো আগ থেকেই শুরু হয়েছে। পৃথিবীময় অ্যাসাঞ্জের মতো অনেকেই স্বীয় সামর্থের আলোকে এ শুরু করেছেন। অ্যাসাঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক লক্ষ দলিল ফাঁস করেছেন আর বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে তথ্যযুদ্ধের পথিকৃৎ মাহমুদুর রহমান মার্কিন মদদপুষ্ট আদিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল সরকারের কুকীর্তি প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষায় আপোষহীন, নির্ভেজাল, দেশপ্রেমিক মাহমুদুর রহমানকে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তার যুদ্ধ থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, হচ্ছে। সত্য প্রকাশের দায়ে ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় ক্যাডাররা বার বার হামলা করেছে তার উপর।
তাকে গ্রেফতার করা হয়। অসংখ্যা মামলায় জর্জরিত করা হয় তাকে। রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হয়। তার সম্পাদিত দৈনিক ‘আমার দেশ’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারাদন্ড হয় সত্য প্রকাশী আরেক মহানায়কের।
অ্যাসাঞ্জ মার্কিনীদের রুদ্ররোষে পড়েন তাদের আর গোপন করার কিছু রাখেনি বলে কিন্তু মাহমুদুর রহমান? তিনি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর কি ফাঁস করলেন এদিকে একটু চোখ ফেরাই। সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিদেশী কোম্পানীর শেভরন থেকে ঘুষ লেনদেন বা দুর্নীতির অভিযোগের তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশ, অবৈধভাবে ভারতকে ট্রানজিট প্রধানের কঠোর সমালোচনা, ভারতের সাথে অসম চুক্তির প্রতিবাদ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান, বিডিআর বিদ্রোহের নেপত্যের কাহিনী খোঁজা, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে কতক সত্য উন্মোচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রশাসনের দুর্নীতি, সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দখল, টেন্ডার, হত্যা, ধর্ষণ, আধিপত্য বিস্তারে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের সচিত্র প্রতিবেদন, তথ্য প্রমাণসহ শিক্ষাবোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের ফলবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, গণতন্ত্র হত্যা, বিরোধী নিধন, ভোট বাক্স ছিনতাই, পদোন্নতি বাণিজ্য ও পোস্টিং বাণিজ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নগ্নথাবা তুলে ধরেছেন। আর এই জন্যই ক্ষুব্ধ হয় ক্ষমতাসীন সরকার। সেই পুরনো কায়দায় নির্যাতন ও গ্রেফতার করা হয় তাকে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের দায়ে অভিযুক্ত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অকুতোভয় মাহমুদুর রহমান।
অস্ট্রেলীয় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. গিদিয়ন পলিয়ার সেই আক্ষেপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানকার গণমাধ্যমও ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর অনৈতিক কর্মকান্ডের আমার দেশ’এ প্রকাশিত ভয়াবহ চিত্রের ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করেনি বরং এদেশের গণমাধ্যমগুলো ছিলো নিরব। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ প্রশ্নেও এদের নিরবতা সত্যিই ব্যথা দেয়। রাজনীতির পার্টিশন এ সেক্টরেও নগ্ন আগ্রাসন স্পষ্ট লক্ষনীয়। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়।
জেলায় জেলায় তার বিরুদ্ধে মামলা করে সত্য প্রকাশকে স্তব্ধ করে দিতে চায় বেনিয়া গোষ্ঠী। আইনী প্রক্রিয়ায় আমার দেশ’ এর প্রকাশনা শুরু হলেও এর অধিকর্তা এখনও কারারুদ্ধ। অ্যাসাঞ্জের জন্য বিশ্বব্যাপি প্রতিবাদ শুরু হলেও বাংলাদেশে একজন সত্যবাদীর জন্য তেমন প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। নোয়াম চমস্কি অ্যাসাঞ্জের পক্ষে কথা বলেন, আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। আর বাংলাদেশের চমস্কিরা (সুশীলরা) মুখে কুলুপ এঁটেছেন আধিপত্যবাদীদের দোসর হয়ে।
অ্যাসাঞ্জ মুক্তি পেল। হয়তো মাহমুদুর রহমানও মুক্তি পাবেন। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ বিরোধীতা ও জাতীয় স্বার্থরক্ষায় হয়তো মাহমুদুর রহমান আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবেন। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধর ইতিহাসে মাহমুদুর রহমান নামে নতুন অধ্যায় রচনা হবে। অ্যাসাঞ্জের সত্য প্রকাশ যেমন থেমে থাকবে না মাহমুদুর রহমানকেও নিশ্চয়ই স্তব্দ করা যাবে না।
অ্যাসাঞ্জ তথ্যযুদ্ধে যে নবজোয়ার সৃষ্ট করেছেন মাহমুদুর রহমানও মিলবে সেই একই মোহনায়।
লেখক
কবি ও প্রাবন্ধিক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।