আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রীমদভগবদগীতাঃ গীতা পর্ব ৪ - দ্বিতীয় অধ্যায় – সাংখ্যযোগ

মানুষের জীবনে রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু-হারানো থাকবেই... কিন্তু সবকিছু থেকে বড় হলো 'বেচেঁ থাকা' ... এই বেচেঁ থাকা দিয়ে সব কিছু জয় করতে হবে ।

সঞ্জয় উবাচ তং তথা কৃপয়াবিষ্টম শ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্‌। বিমীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ। । ১ শ্রীভগবান্‌ উবাচ কুতত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্‌।

অনার্যযুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন। । ২ ক্লৈব্য মাম্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্ম্যতে। ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ। ।

৩ অর্জুন উবাচ কথং ভীষ্মমহং সংখ্যো দ্রোণঞ্চ মধুসূদন ইষ্যুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন। । ৪ গুরূনহত্বা হি মহানুভাবন্‌ শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমগীহ লোকে। হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব ভুঞ্জীয় ভোগান্‌ রুধির-প্রদিগ্ধান্‌। ।

৫ ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীরো যদ্বা জয়েম যদি না নো জয়েয়ুঃ। যানেব হত্বা ন জিজীবিষাম- স্তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাস্ট্রাঃ। । ৬ কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি তাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ। যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রৃহি তম্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্‌।

। ৭ ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুস্যাৎ যচ্ছোকমুচ্ছোষ্ণমিন্দ্রিয়াণাম্‌। অবাপ্য ভূমাসবপত্নমৃগ্ধং রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্‌। । ৮ সঞ্জয় উবাচ এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ।

ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভূব হ। । ৯ তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত। সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে'বিসীদন্তমিদং বচঃ। ।

১০ শ্রীভগবাচ উবাচ অশোচ্যানবশোচত্ত্বং প্রজ্জাবাদাশ্চে ছাষসে। গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচস্যি পন্ডিতাঃ। । ১১ ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ। ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্‌।

। ১২ দেহিনোহস্মিন্‌ যধা দেহে কৈমারং যৌবনং জরা। তথা দেহান্ত্রপ্রপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি। । ১৩ মাত্রাস্পর্শাত্তু কৌন্তয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।

আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত। । ১৪ যং হি ন ব্যখয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ। সমদুঃখসুখং ধীরং সোহম্রুতত্বায় কল্পতে। ।

১৫ নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। উভয়োরপি দৃষ্টোহস্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদশিভিঃ। । ১৬ অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্‌। বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুনর্হতি।

। ১৭ অন্তবস্তু ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ। অনাশিনোহপ্রেমেয়স্য তস্মাদ্‌ যুধ্যস্ব ভারত। । ১৮ য এনং বেত্তি হন্তারং যশৈনং মনস্যতে হতম্‌।

উভৌ নৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হস্যতে। । ১৯ ন জায়তে ম্রিয়তে বআ কদাচিৎ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণ্যে ন হন্যতে হস্যমানে শরীরে। ।

২০ বেসাবিনাশিনং নিত্য য এনমজমব্য্যম্‌। কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্‌। । ২১ বাসংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্যুতি নরোহপরাণি। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংয্যাতি নবানি দেহী।

। ২২ নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈন্য দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়স্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ। । ২৩ অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যাহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ। কাব্যক্তোহয়মচিত্যহত্তমবিকার্যোহয়মুচ্যতে। । ২৪ তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি। ২৫ অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্‌।

তথাপি কং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি। । ২৬ জাতত্ত হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি। ।

২৭ অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত। অব্যক্তনিধনাষ্যব তত্র কা পবিবেদনা। । ২৮ আশর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেব- ম্যশ্চর্যবদ্‌ বদতি তথৈব চাস্যঃ। আশ্চ্ররযবচ্চৈনমন্যঃ শৃনোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।

। ২৯ দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত। তস্মাং সর্বাণি ভুতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি। । ৩০ স্বধর্মমপি চারেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমহসি।

ধর্ম্যাগ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহস্যং ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে। । ৩১ যদুচ্ছয়া চোপপন্নং স্বররগদ্বারমপাত্ত্বতম্‌। সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধনীদূশজ্‌। ।

৩২ অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি। ততঃ স্বধর্মং কীতিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি। । ৩৩ অকীতিঞ্চাপি ভূতানি কথাবিষ্যন্তি তেহব্যতয়ম্‌। স্নতাবিতস্য চাকীতির্মরণাদতিরিচ্যতে।

। ৩৪ ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ। যেধাঞ্চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্‌। । ৩৫ সঞ্জয় বলিলেন, তখন মধুসূদন কৃপাবিষ্ট অশুরুপূর্ণলোচন বিষয়বস্তু অর্জুনকে এই কথা বলিলেন।

১ শ্রীভগবান্‌ বলিলেন, হে অর্জুন, এই সঙ্কট সময়ে অনার্যজনোচিত, স্বর্গহানিকত, অকীর্তিকর তোমার এই মোগ কোথা হইতে উপস্থিত হইল? ২ হে অর্জুন, কারত হইও না। এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাতে শোভা পায় না। হে পরন্তপ, তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া (যুদ্ধার্থে) উথিত হও। ৩ অর্জুন বলিলেন, হে শত্রুমর্দন মধুসূদন, আমি যুদ্ধকালে পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত কিরূপে বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব? (অর্থ্যাৎ তাঁহারা আমার শরীরে বাণ নিক্ষেপ করিলেও আমি গুরুজনের অঙ্গে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারিব না। ) ৪ মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষানুভোজন করাও শ্রেয়।

কেননা গুরুজনদিগকে বধ করিয়া ইহলোকে যে অর্থকাম ভোগ করিব তাহা ত (গুরুজনের) রুধির-লিপ্ত। ৫ আমরা জয়ী হই অথবা আমাদিগকে ইহারা জয় করুক, এই উভয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেয়ন্তর তাহা বুঝিতে পারিতেছি না- যাহাদিগকে বধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহি না, সেই ধৃতরাষ্ট্রপ্রত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত। ৬ (গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কিরূপে প্রাণ ধারণ করিব এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত) চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইয়াছি; প্রকৃত ধর্ম কি এ সম্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে; যাহা আমার ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণ্যপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও। (আমাকে আর তুমি সখা বলিয়া মনে করিও না, আমি তোমার শিষ্য)। ৭ পৃথিবীতে নিস্কটক সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না।

৮ সঞ্জয় কহিলেন- শত্রুতাপন অর্জুন হৃষীকেশ গোবিন্দকে এইরূপ বলিয়া 'আমি যুদ্ধ করিব না' এই কথা কহিতা তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন (নীবর রহিলেন)। ৯ হে ভারত (ধৃতরাস্ট্র), হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যে বিষদপ্রাপ্ত অর্জুঙ্কে হাসিয়া এই কথা বলিলেন। ১০ শ্রীভগবান বলিলেন, যাহাদিগের জন্য শোক করার কোনো কারণ নাই তুমি তাহাদিগের জন্য শোক করিতেছ, আবার পন্ডিতের ন্যায় কথা বলিতেছ। কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী তাঁহারা কি মৃত কি জীবিত, কাহারও জন্য শোক করেন না। ১১ আমি পূর্বে ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিগণ ছিলেন না, এমন নহে (অর্থ্যাৎ সকলেই ছিলাম)।

আর, পরে আমরা সকলে থাকিব না তাহাও নহে (অর্থ্যাৎ পরেও সকলে থাকিব)। ১২ জীবের এই দেহে বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্য কালের গতিতে উপস্থিত হয়। তেমনি কালের গতিতে দেহান্তর-প্রাপ্তিও হয়। জ্ঞানিগণ তাহাতে মোহগ্রস্ত হন না। ১৩ হে কৈন্তেয়, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়াদির সংযোগেই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখ প্রদান করে।

সেগুলির একবার উৎপত্তি হয়, আবার বিনাশ হয়, সুতরাং এগুলি অনিত্য। অতএব সে সকল সহ্য কর। ১৪ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, যে স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি এই স্কল বিষয়স্পর্শ-জনিত সুখদুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, উহাতে বিচলিত হয় না, তিনি অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হন। ১৫ অসৎ বস্তুর ভাব (সত্ত্বা, স্থায়িত্ত্ব) নাই, সৎসবস্তুর অভাব (নাশ) নাই; তত্ত্বদর্শিগণ এই সদসৎ উভয়েরই চরম সর্শন করিয়াছেন (স্বরূপ উবলব্ধি করিয়াছেন)। ১৬ যিনি এই সকল (দৃশ্য জগৎ) ব্যাপিয়া আছেন, তাঁহাকে অবিনাশী জানিও।

কেহই এই অব্যয় স্বরূপের বিনাশ করিতে পারে না। ১৭ দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল হেহ নশ্বর বলিতা উক্ত হইয়াছে। (কিন্তু) আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রেময় (স্বপ্রকাশ)। অতএব, হে অর্জুন, যুদ্ধ কর (আত্মার অবিনাশিতা ও দেহাদি নশ্বরত্ত্ব স্মরণ করিয়া কারততা ত্যাগ কর। স্বধর্ম পালন কর)।

১৮ যে আত্মাকে হন্তা বলিয়া জানে এবং যে উহাকে হত বলিয়া মনে কঅরে, তাহারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না। ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না। ১৯ এই আত্মা কখনও জন্মেন না বা মনে না। ইনি অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ত্ব লাভ করেন না অর্থ্যাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান। ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত, এবং পুরাণ; শরীর হত হইলেও ইনি হত হন না।

২০ যিনি আত্মাকএ অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয় বলিয়া জানেন, হে পার্থ, সে পুরুষ কি প্রকারে কাহাকে হত্যা করেন বা করান? ২১ যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন শরীর পরিগ্রহ করে। ২২ শস্ত্রসকল ইহাকে ছদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না। ২৩ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, , অক্লেদ্য, অশোষ্য। ইনি নিত্য, সর্ব্ব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্তা, অবিকার্য বলিয়া কথিত হন। ২৪ অতএব আত্মাকে এই প্রকার জানিয়া তোমার শোক করা উচিত নয়।

২৫ আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মা সর্বদা দেহের সঙ্গে জন্মে এবং দেহের সঙ্গেই বিনষ্ট হয়, তথাপি, হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয়। ২৬ যে জন্মে তাহার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তাহার জন্ম নিশ্চিতল সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়। ২৭ হে ভারত (অর্জুন), জীবগণ আদিতে শব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত এবং বিনাশে অব্যক্ত থাকে। তোমার শোক বিলাপ কি? ২৮ কেহ আত্মাকে আশ্চর্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা ইনি আশ্চর্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন। কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না।

২৯ হে ভারত, জীবসকলের দেহে আত্মা সর্বদাই অবধ্য, অতএব কোনো প্রানীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নহে। ৩০ স্বধর্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার ভীত-কমিত হওয়া নহে। ধর্ম্যযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নাই। ৩১ হে পার্থ, এই যুদ্ধ আপনা হইতেই উপস্থিত হইয়াছে, ইহা মুক্ত স্বররগদ্বার স্বরূপ। ভাগ্যবান্‌ ক্ষত্রিয়েরাই ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করিয়া থাকেন।

৩২ আর যদি তুমি ধর্ম্যযুদ্ধ না কর, তবে স্বধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে। ৩৩ আরও দেখ, সকল লোকে চিরকাল ট্মার অকীর্তি ঘোষণা করিবে। সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্তি মরণ, অপেক্ষাও অধিক, অর্থ্যাৎ অকীর্তি অপেক্ষা মরণও শ্রেয়ঃ। ৩৪ মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হইয়েছ, (দয়াবশতঃ নহে)। সুতরাং যাঁহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন, তাঁহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে।

৩৫ তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবচ্য কথা বলিবে, তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কি আছে? ৩৬ যুদ্ধে হত হইলেও স্বররগ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে, সুতরাং হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর। ৩৭ অতএব সুখদুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়, তুল্যজ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্‌যুক্ত হো। এইরূপ করিলে পাপভাগী হইবে না। ৩৮ হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষ্ণ সাংখ্যনিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান উপদেশ দিলাম, এক্ষণ যোগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ কর (যাহা এক্ষণ বলিতেছি); এই জ্ঞান লাভ করিলে কর্মবন্ধন ত্যাগ করিতে পারিবে। ৩৯ ইহাতে (নিস্কাম কর্মযোগে) আরম্ভ কর্ম নিষ্ফল হয় না এবং (ত্রুটি-বিচ্যুতি-জনিত) পাপ বা বিস্যু হয় না, এই ধর্মের অল্প আচরণও মহাভয় হইতে ত্রাণ করে।

৪০ ইহাতে (এই নিষ্কাম কর্মযোগে) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি (নিষ্কাম ভাবে কর্ম করিয়াই ত্রাণ পাইব এইরূপ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) একই হয় অর্থ্যাৎ একনিষ্ঠ থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না। কিন্তু অব্যবসায়ীদিগের (অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অনন্ত (সুতরাং নানাদিকে ধাবিত হয়)। ৪১ হে পার্থ, অল্পবুদ্ধিব্যক্তিগণ বেদের কর্মরহিত স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে, চতুক্ত কাম্য-কম্যকর্মত্মক ধর্ম ভিন্ন আর কিছ ধর্ম নাই, তাহাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বররগই তাহাদের পরম পুরুষার্থ, তাহারা ভোগৈশ্বর্য লাভের উপা-স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশসোসূচক আপতমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে। এই সকল প্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বররযে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্যাকার্য-নির্ণায়ক বুদ্ধি এই বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না (ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না)। ৪২-৪৪ হে অর্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও- তুমি নির্দ্বচ্ছ, নিত্যসত্ত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মবান্‌ হও।

৪৫ ব্যাপীকুপতড়াগাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রে জলাশয়ে যে প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, এই বিস্তীর্ণ মহাজলাশয়ে সেই সমস্তই সিদ্ধ হয়; সেইরূপ বেদোক্ত কাদ্যকর্মযমুহে যে ফল লাভ হয়, ব্রহ্মবেত্তা ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুদেব সেই সমস্তই লাভ হয়। ৪৬ কর্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্ফলে কখনও তোমার অধিকার নাই। কর্ম্ফল যে তোমার কর্ম্প্রবৃত্তি হেতু না হয়, কর্মত্যাগেও যে তোমার প্রবৃত্তি না হয়। ৪৭ হে ধনঞ্জয়, যোগস্থ হইয়া, ফলাসক্তি বর্জুন করিয়া, সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্যজ্ঞান করিয়া তুমি কর্ম কর। এইরূপ সমত্ব-বুদ্ধিকেই যোগ কহে।

৪৮ হে ধনঞ্জয়, কেবল বাহ্যকর্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট, অতএব তুমি সমস্তবুদ্ধির আশ্রয় লও; যাহারা ফলের উদ্ধেশ্যে কর্ম করে, তাহারা দীন, কৃপার পাত্র। ৪৯ সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিষ্কাম কর্মী ইহলোকেই সূকৃত দুষ্কৃত উভয়ই ত্যাগ করেন, সুতরাং তুমি যোগের অনুষ্ঠান কর, কর্মে কৌশ্লই যোহ। ৫০ সমত্ত্ববুদ্ধিযক্ত জ্ঞানিগণ কর্ম করিলেও কর্মজনিত ফলে আবদ্ধ হন না, সুতরাং তাঁহারা জন্মরূপ বন্ধন অর্থাৎ সংসার-বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত বিষ্ণুপদ বা মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন। ৫১ যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকানন অতিক্রম করিবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে। ৫২ লৌকিক ও বৈদিক নানাবিধ ফলকথা শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে নিশ্চল হইয়া থাকিবে, তখন তুমি (সাম্যবুদ্ধিরূপ) যোগ প্রাপ্ত হইবে।

৫৩ অর্জুন কহিলেন- হে কেশব, যিদনি সমাধিস্থ হইয়া স্থিতপ্রজ্ঞ হইয়াছে তাঁহার লক্ষণ কি? স্থিতধী ব্যক্তি কিরূপ কথা বলেন? কিরূপ অবস্থান করেন? কিরূপ চলেন? ৫৪ শ্রীভগবান বলিলেন- হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জুন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন। ৫৫ যিনি দুঃখে উদ্বেগশুন্য, সুখে স্পৃহাশুন্য, যাঁহার অনুরাগ, ভগ এবং ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনি বলা যায়। ৫৬ যিনি দেহ-জীবনাদি সকল বিষয়েওই মমতাশূন্য, তত্তৎ বিষয়ে শুভ-প্রাপ্তিতে সন্তোষ বা অশুভ-প্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। ৫৭ কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গসকল সমুচিত করিয়া রাখে, তেমনি যিনি রূপ্রসাদি ইন্দির‍্যের বিষন্ত হইতে ইন্দ্রিয়সকল সংরক্ষণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। ৫৮ ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়োপভোগ নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু বিব্রয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না।

কিন্তু সেই পরম পুরুষকে দেখিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির বিষয়-বাসনা নিবৃত্ত হয়। ৫৯ হে কৌন্তেয়, প্রমাধী ইন্দ্রিয়গণ সংযমে যত্নশীল, বিবেকী পুরুষেরও চিত্তকে বল্পূর্বক হরণ করে (বিষয়াসক্ত করে)। ৬০ যিনি আমার অনন্যভক্ত তিনি সেই সকল ইন্দিয়কে সংযত করিয়া আমাতে চিত্ত সমাহিত করিয়া অবস্থান করেন। তাদৃশ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিরই ইন্দ্রিয়সকল বশীভুত হয়, তিনিওই স্থিতপ্রজ্ঞ। ৬১ বিষয়-চিন্তা করিতে করিতে মনুষের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা অর্থাৎ সেই বিষয় লাভের অভিলাস জন্মে, সেই কামনা কোনো কারণে প্রতিহত বা বাধ্যপ্রাপ্ত হইলে প্রতিরোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ, ঘটে।

৬২-৬৩ কিন্তু যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যাহার মন নিজের বশবর্তী, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, আত্মবশীভূগ ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিষয় উপভোগ করিয়া অত্মপ্রসাদ লাভ করেন। ৬৪ চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে এই পুরুষের সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি হয়; যেহেতু প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্র উপাস্যে (ঈশ্বরে) স্থিতি লাভ করে। ৬৫ যিনি অযুক্ত অর্থাৎ যাঁহার চিত্ত অসামহিত ও ইন্দ্রিয় অবশীভূত তাঁহার আত্ম-বিষয়া বুদ্ধিও হয় না, চিন্তাও হয় না। যাঁহার (আত্ম-বিষয়া) চিন্তা নাই, তাঁহার শান্তি নাই, যাঁহার শান্তি নাই, তাঁহার সুখন কোথায়। ৬৬ মন বিষয়ে প্রবৃর্ত্মান ইন্দ্রিয়গণের যেটিকে অনুবর্তন করে, সেই একটি ইন্দ্রিয়ই, যেমন বায়ু জলের উপরিস্থিত লৌকাকে বিচলিত করে, তদ্রূপ উহার প্রজ্ঞা হরণ করে।

৬৭ হে মহাবাহো, (যখন ইন্দির‍্যাধী মন এবং মনের অধীন প্রজ্ঞা) সেই হেতু, যাহার ইন্দ্রিয় সর্বপ্রকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারই প্রজ্ঞা হইয়াছে। ৬৮ সাধারণ প্রাণিগণের পক্ষে যাহা (জ্ঞাত্যানিষ্ঠা) নিশাস্বরূপ, তাহাতে (আত্মনিষ্ঠাতে) সংযমী স্যক্তি জাগ্রত থাকেনল যাহাতে (বিষয়-নিষ্ঠাতে) অজ্ঞ প্রাণিসাধারণ জাগরিত থাকে, আত্মদর্শী মুনিদিগের তাহা (বিষয়নিষ্ঠা) রাত্রিস্বরূপ। ৬৯ যেমন নদ-নদীর জলে পরিপুরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশী আসিয়া প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, সেইরূপ যে মহাত্মাতে বিষয়সকল প্রবেশ করিয়াও কোনোরূপ চিত্তবিক্ষেপ উৎপন্ন করে ন, তিনি শান্তি লাভ করেন, যিনি, ভোগকামনা করেন, তিনি শান্তি পান না। ৭০ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করিয়া নিস্পৃহ হইয়া বিচরণ করেন, যিনি মমতাশুন্য ও অহঙ্কারশুন্য, তিনিই শান্তি প্রাপ্ত হন। ৭১ হে পার্থ, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান)।

এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে জীবের আর মোহ হয় না। মৃত্যুকালেও এই অবস্থায় থাকিয়া তিনি ব্রহ্মনির্বাণ বা ব্রহ্মে মিলনরূপ মোক্ষ লাভ করেন। ৭২

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।