ব্লগের জগতে কলম ধরছি এই প্রথম। কি লিখব তা ঠিক করতে যেয়ে ভাবলাম, এই মুহুর্তে আমি যে বইটা পড়ছি, ওখান থেকে কিছু মজাদার তথ্য আমার ভাষায় পরিবেশন করা যাক। লিখে লিখে হাত পাকানোর মতলব আর কি! অস্ট্রেলিয়াতে এসেছি এক বছর হল, স্ত্রী-পুত্র ও তল্পিতল্পাসহ। অস্ট্রেলিয়া আবিস্কারের কাহিনি নিয়ে একটা বই পড়ছি এই সময়ে, আর অবাক হচ্ছি অনেক অজানা তথ্য জেনে।
আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া যখন বাকি পৃথিবীর কাছে ছিল অজানা, তখনও অনেক ভুগোলবিশারদ ও চিন্তাবিদরা ধারনা করতেন যে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে একটা বিশাল ভূমিখন্ড তথা মহাদেশ আছে।
একইভাবে তারা ভারত মহাসাগরে আরেকটি ভূমিখন্ড তথা মহাদেশ থাকার সম্ভাবনা ব্যক্ত করতেন। এগুলো ছিল কাগুজে তত্ত্ব, তবে নিছক কল্পনা নয়। যুক্তিতর্ক দিয়ে তারা পৃথিবীর ভারসাম্য, সমুদ্র স্রোতের গতিবিধি ও জলভাগ-স্থলভাগের বাঞ্ছিত অনুপাতের ভিত্তিতে এই কাল্পনিক স্থলভাগগুলির সম্ভাব্য অবস্থানের বাস্তবতাকে সমর্থন করতেন, যদিও সাগর পাড়ি দিয়ে কেউ এই হাইপোথিসিস প্রমান বা অপ্রমান করার সাহস দেখাননি দীর্ঘদিন। টলেমির আঁকা পৃথিবীর মানচিত্রে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান চিহ্নিত করা ছিল, যেখানে অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয়েছিল ‘টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা’ অর্থাত ‘দক্ষিনের অজানা দেশ’। ১৪৯২ সালে কলম্বাস আটলান্টিক পাড়ি দিলেন; ১৪৯৮ সালে ডাচরা আফ্রিকা ঘুরে ভারতে (তখনকার ইঊরোপীয়দের ভাষায় পুরব ভারত তথা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’, কারন ততদিনে কলম্বাসের এক ভুলের কারনে মধ্য আমেরিকায় ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলির নাম হয়ে গেছে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ) এল বানিজ্জ্য করতে; ডাচদের পেছনে পেছনে এল বাকি সব ইঊরোপীয় লুটেরা বেনিয়ারা।
তারপরেও প্রায় পৌনে তিনশ বছর ধরে ভারত মহাসাগরের বুকে সেই ‘টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা’ তখনও ইনকগনিটা-ই রয়ে গেল।
অবশেষে ইংরেজ নাবিক কুক অস্ট্রেলিয়া আবিস্কার করলেন, বলতে গেলে এইতো সেদিন, ১৭৭০ সালে। তবে তার অনেক আগেই, সেই ১৬৯৬-৯৭ সালে, ডাচ নাবিক উইলেম ডি ভ্লামিং (Willem De Vlamingh) অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম তীরে তার জাহাজ নোঙ্গর করেছিলেন, যা তিনি তার দিনলিপিতে লিখে গেছেন। এরপর ইংরেজরা সিডনিতে বন্দিশিবির বানাল, তারপর বসতি/উপনিবেশ গড়ল, সে সব কাহিনি আমরা সবাই কম বেশি জানি।
যা জেনে খুব মজা পেলাম, জন ব্যাটমান নামে এক ইংরেজ আজকে যেখানে মেলবোর্ন সেই এলাকায় এসেছিলেন ১৮৩৫ সালে।
এই এলাকায় তখন বাস করত বুরুন্ডেরী (Wurundjeri) গোত্র। ব্যাটমান সাহেব করলেন কি, কয়েক বোতল এ্যালকোহল ও কয়েকটি লোহার তৈরি অস্ত্র-শস্ত্রের বিনিময়ে গোত্রপতির কাছ থেকে ৬০০,০০০ একর জমি কিনে নিলেন, এবং ওই জায়গার নাম রাখলেন ব্যাটমানিয়া। সেখানে তিনি তার দল বল নিয়ে রীতিমত একটা শহর পত্তন করে বসলেন, যা আজকের মেলবোর্নের পুরবসুরী। বাদ সাধল বেরসিক ইংরেজ সরকার; বেচারা ব্যাটমানের ক্রয় দলিল কে অবৈধ ঘোষনা করে সরকার সে জমি নিজের দখলে নিয়ে নেয় এবং শহরের নামও পালটে দেয়। ভাবতে মজাই লাগছে, আজ আমি মেলবোর্নে না থেকে ব্যাটমানিয়াতেও বাস করতে পারতাম!
১৭৭০ সাল এবং তার পরের বিভিন্ন ইংরেজ নাবিক ও প্রতিনিধিদের চিথিপত্র ও অন্যান্য দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায় যে, তারা এবোরিজিনদেরকে খুব জংলি, আক্রমনাত্তক ও হিংস্র মনে করত, এবং সে কারনে সিডনিতে স্থাপিত বন্দিশিবির টিকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ছিল।
যার উপরে এই বন্দিশিবির স্থাপনের কাজের ভার পরেছিল, সেই গভরনর ফিলিপ কিন্তু এবোরিজিনদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, এবং তাদেরকে তার নব্য কলোনির শান্তিপুর্ন সমর্থকে পরিনত করেছিলেন। কিভাবে? ইতিহাসবিদরা বলছেন, একটা কাকতালীয় বিষয় তাকে খুব সাহায্য করেছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সে সময় বাস করত বিভিন্ন গোত্র, যাদের নিজ নিজ এলাকার সীমানা চিহ্নিত করা থাকত। তবে শক্তিশালী গোত্র দুবর্ল গোত্রকে প্রজা হিসেবে শাষন করত এবং খাজনা আদায় করত। সিডনিতে যে গোত্র বাস করত, তারা ক্যামারাগাল নামে একটা শক্তিশালী গোত্রের প্রজা ছিল, এবং এই পরাধীনতার নিদর্শন হিশেবে প্রজা-গোত্রের সকল পুরুষের উপরের পাটির সামনের দুটি দাঁত তুলে ফেলা হত।
গভরনর ফিলিপেরও, কাকতালীয়ভাবে, উপরের পাটির সামনের দুটি দাঁত ছিল না, যে কারনে সিডনির এবোরিজিনরা তাকে তাদের নিজেদের একজন হিসেবেই গণ্য করত বলে ধারনা করা নিতান্ত অসমীচীন হবে না। গভরনর ফিলিপের এবোরিজিন-বশীকরন মন্ত্র তাহলে এটাই ছিল। ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে!
ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের গোলমাল প্রাচীনকাল থেকেই, আর অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসেও তার একটু-আধটু ছিঁটেফোঁটা আছে বই কি। ইংরেজ পরিব্রাজক ম্যাথিউ ফ্লিনডার্স, যার নামে আজকের মেলবোর্নের কেন্দ্রিয় রেলস্টেশনের নামকরন করা হয়েছে, এক দীর্ঘ অভিযানে ১৭৯৭-১৮০৩ সময়কালে পুরো অস্ট্রেলিয়ার চারপাশে জাহাযে করে চক্কর দেন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রথম প্রামান্য মানচিত্র আকেন। ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার পথে তার জাহাজের তলা ছিদ্র হওয়ায় মেরামতের জন্য মরিশাসে থামতে হয়।
মরিশাসে তখন ছিল ফরাসিদের আস্তানা; তারা সেখানে ম্যাথিউ ফ্লিনডার্সকে পাক্কা ৬ বছর বন্দি করে রাখে এবং তার অভিযানের সব কৃতিত্ত্ব একজন ফরাসি নাবিকের নামে দাবি করে। যা হক, জনাব ফ্লিনডার্স ইংল্যান্ডে ফিরে যান ১৮১০ সালে, এবং বই লিখে তার অভিযান ছিনতাই এর ঘটনা প্রকাশ করেন। ভাগ্যের কি পরিহাস, সেই বই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হবার কয়েক দিন আগেই তিনি পটল তোলেন। কি বিচিত্র দুনিয়া!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।