আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গণআন্দোলন জরুরি

কি বলব

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছিল। এই উত্থান বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এমন এক জাতির উত্থান সম্ভব করেছিল যে জাতির ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিকতা প্রায় একই। যে জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপুল ত্যাগ ও ক্ষতির ক্ষত মুছে ফেলে নতুন উদ্দীপনায় জাতীয় উন্নতি-প্রগতি অর্জনের জন্য উদয়াস্ত সংগ্রামমুখর হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই। মুক্তিযুদ্ধে অনেক সন্তান বাবা-মা হারিয়েছেন।

অনেক নারী স্বামী হারিয়েছেন। অনেক স্বামী প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছেন। অনেক স্বজনই হারিয়েছেন প্রিয় স্বজনকে। কিন্তু সবাই আপনজন হারানোর বেদনার কারণে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার সংগ্রাম ভুলে থাকেননি। সব বেদনা-ক্ষত ভুলে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’টাকে সম্ভাবনায় এক দেশে পরিণত করার জন্য অবিরাম কাজ করে গেছেন।

কিন্তু আজ স্বাধীনতার অর্জনের ৩৯ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের দিকে তাকালে বুকটা হু হু করে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ হতশ্রী দশা ও গভীর হতাশা বিরাজমান। শ্রেষ্ঠত্বের কোনো অহঙ্কার ও উদ্যমের ছাপই বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয়, বাংলাদেশ এমন এক নতজানু দেশ, গোলামির জিঞ্জিরে বন্দি থাকাই যার শেষ পরিণতি। পাণ্ডুর ও বর্ণহীন এমন এক বাংলাদেশকে আমরা দেখছি, যার সীমান্ত প্রতিরক্ষার অনন্য বাহিনী চাণক্য-চক্রের আয়োজনে তছনছ হয়ে গেছে।

যার সড়ক-নৌপথ-সমুদ্রবন্দর আজ ট্রানজিটের নামে প্রায় বেহাত হতে বসেছে। পদ্মার বুকে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। আর সুরমা নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল-মধ্যাঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করার আয়োজন চলছে। আর দেশের অভ্যন্তরে হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, জখম, দখল ও উচ্ছেদের তাণ্ডব চালাচ্ছে ওই প্রতিবেশীদের দেশীয় দোসররা। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি কখনোই এমন হওয়ার কথা ছিল না।

জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয় মুক্তির সাফল্য অর্জন করার কথা ছিল। আজ জাতীয় মুক্তি যেন সোনার পাথর বাটি। কারণ এখন জাতীয় স্বাধীনতাই ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই অতীতকে নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কেন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে—এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের নির্মোহ হতেই হবে।

এ ক্ষেত্রে গত ৩৯ বছরের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে আমরা দেখি বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকে যা কিছু সাফল্য অর্জন করেছে তা নস্যাত্ করে দিতে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি ও তাদের দেশীয় তাঁবেদাররা সব সময়ই উঠেপড়ে লেগেছে। এ ঘটনার শুরু ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের মুহূর্ত থেকেই। বিজয়ের পরপরই সমগ্র জাতির সংগ্রামকে একটি রাজনৈতিক দলের কৃতিত্বে পরিণত করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পরিচালনার নামে দেশের মানুষকে নিপীড়ন করা শুরু হল। তাদের দৌরাত্ম্য এ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তাদের দলীয় প্রধান ও তত্কালীন শাসক শেখ মুজিবুর রহমান বলতে বাধ্য হলেন দেশ স্বাধীন হলে সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র কৃতিত্বের দাবিদার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্য স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার সামান্যই প্রতিনিধিত্ব করে।

মূলত স্বাধীনতার পর সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কল-কারখানার যন্ত্রাংশ লুটপাট, চোরাকারবার, ডাকাতি, ছিনতাই, সংখ্যালঘুদের জমি-বাড়ি দখল, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি গর্হিত অপরাধের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিল। তাদের এই দমনাভিযানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতেই রক্ষী বাহিনীর মতো বাহিনী গড়ে তুলে আরও বেশি অত্যাচার চালানো হয়েছিল। একদলীয় বাকশালী শাসন প্রবর্তন এবং বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের মতো ঘৃণ্য কাজ করা হয়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার পরিবর্তে ধ্বংস করার এই আয়োজন ছিল অত্যন্ত আত্মঘাতী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা। যার ফলে ক্ষমতার বিকার সমাজের সর্বত্র মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

যার অনিবার্যতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক আহমেদসহ আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ কিছু সেনা অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে দেশে প্রথম স্বৈর-শাসন কায়েম করে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে মুজিবের নেতৃত্বে অপশাসন চালানো ও তার মৃত্যুর মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো স্বৈরশাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতার মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই এ দেশ পতিত দশায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিল বাংলাদেশের আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যে নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছে, সেই জাতি যে ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকেও জেগে উঠবে, এটাই ঐতিহাসিক সত্য। নেতৃত্বহীন বাংলাদেশ ২৫ মার্চের কালরাতে বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়ার মাত্র একদিন পরে তরুণ সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে নেতৃত্ব ফিরে পেয়ে প্রতিরোধের সূচনা করেছিল।

সেই স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও জেগে ওঠেছিল। বাংলাদেশ অপশাসন, লুটপাট, দুর্নীতি, শোষণ, নিপীড়ন, বাকশালীয় একনায়কতন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের বীভত্সতা থেকে মুক্ত হয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র, ন্যায়-নীতি ও আইনের শাসনের মতো প্রগতিশীলতার দিকে নতুন যাত্রা শুরু করে। যার ফলে জনগণ, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্র স্বাধীনতা ফেরত পায়। কিন্তু আজ দ্বিধাহীন চিত্তেই বলতে হয়, স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অপরাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়িতে’ পরিণত করার যে অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল, কখনোই তা থেমে থাকেনি। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে উত্পাদন ও উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত করার যে অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন, তাকে হত্যা করে সেই অপচেষ্টা আবারও বাংলাদেশের বুকে চেপে বসে।

বাংলাদেশে স্বৈরাচারী এরশাদের অপশাসন প্রবর্তিত হয়। ওই শাসনকে আওয়ামী লীগের তত্কালীন সভানেত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন জানান। এরপর শহীদ জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিসহ গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ও অকুতোভয় ছাত্র সমাজের সুদীর্ঘ ৯ বছরব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের স্বৈরশাসনের পতন হয়। বাংলাদেশ আবারও গণতন্ত্র ও উত্পাদনমুখী ধারায় পথ চলার সুযোগ পায়। বর্তমান আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের আপামর জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অসম ও দেশের স্বার্থবিরোধী একের পর এক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দাসত্বের জালে আবদ্ধ করছে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার, ১০ টাকা কেজি চাল, বিনা পয়সায় কৃষকদের মাঝে সার, ঘরে ঘরে চাকরির আশ্বাস, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ার পরিবর্তে হত্যা, গুম, লুণ্ঠন, দখল, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, নারী ও শিশু নির্যাতনে মেতে ওঠেছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে দেশের ঊদীয়মান অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধকে ও ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের পথকে রুদ্ধ করে দেশকে ২০ বছরের পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ১১ জানুয়ারির জরুরি সরকার দেশপ্রেম, উন্নয়ন, উদ্দীপনা ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে দেশের চলমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সেই অপশক্তির মদতে এবং প্রভুদের আশীর্বাদে বর্তমান নিষ্ঠুর অত্যাচারী ও জনধিকৃত সরকার তাদেরই ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। ১১ জানুয়ারি দেশের বিরুদ্ধে প্রভু ও তাঁবেদার শিখণ্ডীদের নতুনরূপে সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের সূচনা হয়, যার ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই সন্তানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়।

প্রভু দেশের অর্থে পরিচালিত মিডিয়া সিন্ডিকেটের মিথ্যা প্রচারণা ও প্রপাগান্ডার মাধ্যমে শহীদ জিয়ার পরিবারের ওপর কালিমা লেপন করার হীন চেষ্টা করা হয়। বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ ও হত্যার হুমকিও প্রদান করা হয়। জরুরি সরকারের সেই জিয়া পরিবারবিরোধী চক্রান্ত বর্তমান আওয়ামী সরকার অব্যাহত রেখেছে। তারা আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করছে। বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, সেনাবাহিনী, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশ।

এ অবস্থায় জাতির সামনে একটাই প্রশ্ন, বাংলাদেশকে কি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে দেবে? ইতিহাস সাক্ষী, গণতন্ত্র ও দেশবিরোধী দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে টিকে থাকতে দেবে না। তাদের অতীত কখনোই প্রমাণ দেয়নি, তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে। এ অবস্থায় গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের চিরস্থায়ী ক্ষমতার স্বপ্ন-সাধ ও বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন চুরমার করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের আর কোনো বিকল্প নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।