Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience
৩৯ বছর হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধের বারুদপোড়া গন্ধ, বধ্যভুমির গলিত লাশ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদেও বীরত্বে কোন চিহ্ন দেখার সুযোগ হয়নি এ প্রজন্মেও তরুনদের। ঢাকার সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ধরে রেখেছে যুদ্ধদিনের সেইসব স্মৃতিচিহ্নকে। আপনিও দেখে আসতে পারেন ৭১ এর উত্তাল কিছু ঘটনাপ্রবাহের বাস্তব চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ঘুরে সন্দীপন বসু মুন্না
পঞ্চম গ্যালারি
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের সর্ববৃহৎ এই কক্ষ মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের সাক্ষ্য বহন করে।
এ গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকহানাদারদের ব্যাবহৃত অস্ত্রের এক বিপুল প্রদর্শনী। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাবহৃত এলএমজি , রাইফেল পিস্তল , এন্টি ট্যাংক মাইন, পাকিস্থানি ঘাঁটি থেকে প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর উচ্চতর অফিসারের পদক, মর্টার শেল, ট্যাংক বিধ্বংসী রাইফেল, পাকিস্থানীদের পরিত্যাক্ত অস্ত্রশস্ত্র বেশ সুশৃংখলভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই গ্যালারিতে।
জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পোস্টার এবং কনসার্টে রবি শংকর, বব ডিল্যান, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টনের গাওয়া গানের রেকর্ড, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানবতাবাদী বিভিন্ন শিল্পী যেমন : লি ব্রেনন, পেটি থমাস, জন ব্রাউন, জিমি সেফটন, রুমা গুহঠাকুরতা, গ্ল্যান্জ জ্যাকসন, নরমা উইনস্টনের গাওয়া গানের অডিও ক্যাসেট সংরক্ষিত আছে এখানে। আরও আছে আছে তৎকালীন বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউজ উইক এর বাংলাদেশ নিয়ে করা প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি। এছাড়াও রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার অনুষ্ঠানের পান্ডুলিপি, শিল্পীদের নাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কাজে ব্যাবহৃত ট্রান্সমিটারটি , নৌকমান্ডো, বিমান বাহিনী, নারী সমাজ, বৈদেশিক সমর্থন বিশেষ করে ভারতীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রতিবিম্ব যা এক কথায় বাংলাদেশের গণজাগরণের প্রতিচ্ছবি।
ষষ্ঠ গ্যালারি
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের সর্বশেষ এই কক্ষটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আপামর জনসাধারণ ও বুদ্ধিজীবি, ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের নিদর্শন। ষষ্ঠ গ্যালারিতে রক্ষিত মিরপুর মুসলিমবাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা কঙ্কাল, শহীদদের ব্যাবহৃত বস্তুসামগ্রী, পত্র, ডায়রী , নোটবুক, পরাজিত পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রসম্ভারের নমুনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির রাষ্ট্রীয় দলিল, বিশ্বখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকার আলোকচিত্রী জিল ডুরাসের ক্যামেরায় ধর্ষিতা বাংলাদেশের প্রতীক এক রমণীর ছবি, সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি ও তাদের যুদ্ধের বিবরণী ও রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে পড়ে থাকা বুদ্ধিজীবিদের লাশের আলোকচিত্র। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সর্বশেষ এই কক্ষে এসে দর্শক একাত্তরের পরম ত্যাগ ও বেদনার দংশন অনুভব করবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে হারানো দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের চিত্র এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।
আরও রয়েছে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে আমাদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের পরিচয়।
সবশেষে রয়েছে আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীসহ পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র এবং তাদের কাপুরুষোচিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন। ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে মিরপুর ১২নং সেকশনের ডি ব্লকে নূরী মসজিদ সংলগ্ন মুসলিম বাজার বধ্যভূমির একটি পরিত্যক্ত কুয়া থেকে মাথার খুলিসহ পাঁচ শতাধিক হাড় উদ্ধার করা হয়। একই বছর মিরপুর ১০নং সেকশনের ডি ব্লকের ১নং এভিনিউতে জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫৩৯২টি ছোট-বড় হাড় পাওয়া যায়। এসব হাড় এ গ্যালারিতে রাখা আছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বেশিরভাগ স্মৃতিচিহ্ন দিয়েছেন শহীদদের স্ত্রী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
শহীদ ড. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেছেন তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। রোকাইয়া হাসিনা তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শহীদ রাশিদুল হাসানের ব্যবহৃত কলম সীল, স্যুট ও আলোকচিত্র জাদুঘরে জমা দেন। শহীদ ডাক্তার আতিকুর রহমানের মেয়ে মিমি রহমান তার বাবার ব্যবহৃত একটি কোর্ট ও একটি টুপি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সংগৃহীত উপকরণ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে তৎকালীন এশিয়া টুডে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, আনন্দবাজার, নিউজউইক, সংগ্রামী বাংলা, রণাঙ্গন, মুক্তিযুদ্ধ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ও স্বাধীন বাংলাসহ বিভিন্ন দুর্লভ পত্রপত্রিকা ও পোষ্টারের সংগ্রহ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডাঃ সুলতান সালাহউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক উদ্ভাবিত হ্যান্ডবিল ছাপানোর মেশিন, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ও পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীরযুদ্ধ নকশা; এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পূর্ণাঙ্গ বিবরণী সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে।
বর্তমানে জাদুঘরে সংগৃহীত স্মারক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪১৭টি। এর মধ্যে ৮০০টি আলোকচিত্র, ৫০৬টি দলিলপত্র, ৫০০টি পত্রিকা কাটিং, ৬৬৫টি অন্যান্য স্মারক। এগুলোর মধ্যে ৩১০ আলোকচিত্র, ৮৪টি দলিলপত্র, ২২৭ পত্রিকার কাটিং এবং ৪৭০টি বিভিন্ন স্মারক গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাকিগুলো সংরক্ষণাগারে সযত্নে রক্ষিত হচ্ছে।
ইতোমধ্যেই জাদুঘরটি সম্মানজনক আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংস্থা আমেরিকান এসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের সদস্য পদ লাভ করেছে।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিজস্ব জায়গা না থাকায় অনেক দুর্লভ জিনিসপত্র প্রদর্শন করা সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালে আগারগাঁওয়ে ২.৫ বিঘা জমি আট সদস্যের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিজস্ব ভবন তৈরির কাজ বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে শুরু হচ্ছে। ভবন নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।
আগামী তিন বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে সেগুনবাগিচা থেকে জাদুঘর স্থানান্তর হয়ে যাবে আগারগাঁওয়ে। জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, জাদুঘর নির্মাণ তহবিল গঠন প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়া হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে সর্বসাধারণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাত রয়েছে। ৫০ লাখ টাকায় পৃষ্ঠপোষক সদস্য, ১৫ লাখ টাকায় স্থাপনা সদস্য, ৩ লাখ টাকায় উদ্যোক্তা সদস্য, ১ লাখ টাকায় আজীবন সদস্য এবং ১০ হাজার টাকায় জাদুঘরের একটি প্রতীকী ইট ক্রয় করার সুবিধা থাকছে।
জাদুঘর ভবন নির্মাণের অর্থ সহায়তা গ্রহণের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ’ নামে জনতা ও ব্র্যাক ব্যাংকের সব শাখায় এসটিডি (এসটিডি হিসাব নং : ১৫০১১০১৬৫৮৬৩৭০০১, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড গুলশান-১ শাখা, ঢাকা ও এসটিডি হিসাব নং : ৩৬০০০৪০৮, জনতা ব্যাংক, তোপখানা রোড শাখা, ঢাকা) হিসাব খোলা হয়েছে।
এর বাইরেও যে কেউ সেগুনবাগিচার জাদুঘর কার্যালয়ে এসে সরাসরি অনুদানের টাকা জমা দিতে পারবেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হলে , হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হলে আপনাকে আসতেই হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহশালার এই পীঠস্থানে। বিজয়ের এই মাসে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে হলের আমাদেও এই বীরত্বগাঁথা দেখে আসুন। জানুন বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তির ইতিহাস।
ঠিকানা : মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ৫ সেগুনবাগিচা, ঢাকা -১০০০, ফোন ঃ ৯৫৫৯০৯১, ফ্যাক্স : ৯৫৫৯০৯২
ই মেইল :
ওয়েবপেইজ : liberationmuseum.org
( প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, রোববার বন্ধ )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।