( এক )
সামান্য এক চিলতে কাগজ, কত মনের কথা বুকে বয়ে,
চলে যায় দূর থেকে দূরান্তে। স্থলে, জলে , অন্তরীক্ষে কত
অজানা পথ ডিঙ্গিয়ে, ঠিক গিয়ে পড়ে আপনজনের হাতে।
কেউ প্রাণ ভরে হাসে,
কেউ শ্বাসতুলে ভাসে,
কেউ চিন্তিত হয়,
কেউ বা নিশ্চিন্ত হয়-----------
এই দীর্ঘ ভ্রমণেও সে রোদে পোড়ে না, জলে ভেজে না, হাওয়ায়-ও ওড়ে না। ভেজে-ভেজে , কারুর মন ভেজে, কারুর চোখ ভেজে, কারুর প্রাণ পোড়ে।
আজ সারাদিন শুধু ঘরই গুছালাম।
সমস্ত পুরোন জিনিস
ওলোট-পালোট করে রোদে শুকিয়ে, উমো-উমো গন্ধ বুকে ভরে ঘরে তুললাম। পুরোন ট্রাঙ্কের তলার কাগজটা
পাল্টাতেই, গড়িয়ে পড়ল, অত্যন্ত সাবধানে লুকোন সেই
চিঠিখানা।
সে আজ কোথায়? কালের অতলে হারিয়ে গেছে। এক যুগ পেরিয়েও পড়ে আছে তার লেখা--------------হলদেটে হয়ে গেছে সাদা কাগজ -খানা। নীল কালির অক্ষর-গুলো সব বিবর্ণ, অস্পষ্ট, আবছা।
অতি যত্ন ও ভাঁজের চাপে,
মুচমুচে হয়ে ভাঁজে-ভাঁজে ভেঙ্গে গেছে। কোথাও, কোথাও
পুরোন লোহার ট্রাঙ্কের মরচের ছোঁয়ায় লাল ফুটোফুটো
মত হয়ে আছে।
চোখে দেখে আর কিছুই পড়া যায় না। অবশ্য তাতে কোন অসুবিধা হয় না। এ যে আমার মনের পর্দ্দাতে বাঁধান আছে।
প্রতিটা শব্দ যেন তাঁর, সেই অভিজাত কণ্ঠ-স্বরেরই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।
বাড়ী ফাঁকা। আমিও একা। নিশ্চিন্তে, নিরিবিলিতে ঝাপসা
চোখের সামনে মেলে ধরি আমার অতি প্রিয় জনের সেই জবান-বন্দি---------------------
( দুই )
-"এতো কান্না নয় আমার, এ যেন চোখের জলের মুক্তো হার,
আমার পরতে ভাল লাগে। -"
পিতা ও কন্যার সম্পর্কের বন্ধনে সামান্য স্মৃতিও যদি আমার মনের আয়নায় দাগ কেটে থাকে, তবে তারই প্রতিফলিত স্বরূপ এই পত্র।
কল্যানীয়া পূর্নিমা,
পত্রের মাধ্যমে তোমার উদগ্রীবতা আমাদের শান্ত ও মুগ্ধ করে। সন্তানের এই উৎকন্ঠায় আমরা প্রকৃতই
গর্বিত। তবে তোমার উপকারের কথা বিবেচনা করিয়াই বলিতেছি, অধিক চিন্তা, দুর্ভাবনা বৃদ্ধি করে। শরীর ও মন ক্লিষ্ট করে। প্রতিদিনের সুখ-শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
সুতরাং নিজের অনিষ্ট করিও না। আমাদের কর্মফল আমাদের ভোগ করিতেই হইবে। ইহা হইতে কেহ কোনদিন নিস্তার পায় নাই এবং আমরাও পাইব না। ইহাই পরম সত্য।
-----পাপ-পূণ্য সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোন উপলব্ধি হয় বলিয়া বুঝিতে পারি না।
কারণ আমার মনে হয়, কেহ বুঝিয়া পাপ করে না এবং কেহ না বুঝিয়া পূণ্যও করে না---------সুতরাং, এ দুটিরই কোনটির ফল ভোগ করিতেছি ------------ ইহা অবান্তর ।
--তবে আজ অভিজ্ঞতাই বলিয়া দেয়, হয়ত আমার চালনাতেই কোন ত্রুটি ছিল অথবা যথা সময়ে তোমার মায়ের বক্তব্যকে সর্ব্বদা অগ্রাহ্য করিবার প্রবণতারই ফল। যাহা আজ আমাকে নিরন্তর দংশন করে। কিন্তু সে ভুল আজ আর শোধরাইবার কোন উপায় নাই।
--যাহা হউক তুমি আমাদের প্রথম সন্তান।
সে হিসাবে অনেক সুখ যেমন তোমাকে স্পর্শ করিয়াছে, অনেক দুঃখও তোমাকে দহন করিয়াছে। আজ আমাদের জন্য তোমার এই কাতরতা হয়ত তাহারই রূপান্তর। যাহা আমি প্রতি-নিয়তই অনুভব করি। সেই জন্যই আজ তোমার নিকট এই দীর্ঘ ও
( আমার মনে হয় ) শেষ পত্র লিখিতে বাধ্য হইয়াছি।
--তোমার জন্মের-ও পূর্বে যখন প্রথমবার পূর্ব বাংলা ( দেশ )
হইতে মুসলমানদের দ্বারা বিতাড়িত হইয়া বাস্তুচ্যূত হইলাম,
---সেদিন অগাধ সম্পত্তি, বাড়ী-ঘর, জমি-জমা সব ফেলিয়া আসিয়াছিলাম।
সম্পূর্ন নিঃস্ব হইয়াও সঙ্গে আনিয়াছিলাম একটি সুস্থ-সবল দেহ ও প্রভূত মানসিক উদ্দীপনা। আজ বুঝি তাহার মূল্য ছিল সেই সম্পত্তি অপেক্ষা-ও সহস্র সহস্র গুন বেশী।
আশ্রয় ও উপার্জ্জন কিছুরই ঠিক ছিল না, কিন্তু সেই অবস্থাতেও আশ্রয় গড়িয়াছি এবং আশ্রয় দিয়াছি। ক্রমশঃ আত্মীয়-স্বজন পরিবৃত হইয়া, নব-জাতকদের মুখ দেখিয়া, সুখে ও শান্তিতেই দিন যাপন করিয়াছি।
--কিন্তু আজ আমি নিঃস্ব না হইয়াও দ্বিতীয় বার আত্মজার দ্বারা আশ্রয়-চ্যুত হইলাম।
আজ আমরা ( আমি ও তোমার মা )
যাযাবর। অধিক সন্তানের পিতা-মাতা হওয়ার সুবাদে বাসস্থান হয়ত বা মেলে, অপরিসীম সুখও উপভোগ করি, কিন্তু পেটের জ্বালা যেভাবে জুড়ায় মনের জ্বালা হয়ত-বা সেভাবে জুড়ায়-না।
--কাহারও বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নাই। সকলেই আমাদের সুখে রাখিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে। তোমার মায়ের অবস্থা আমার অপেক্ষাও অধিক কষ্টের।
কারণ, আমি নীরব ও নির্ব্বিকার হইয়াও এখনও সবার স্তুতি আহরণ করিতেছি। কিন্তু সে? সে এখনও সংসারের চাকায় অনর্গল পিষ্ট হইতেছে। আর সন্তানের কল্যান কামনায় কত না বিনিদ্র রজনী যাপন করিতেছে।
--কেবল দর্শক হইয়া বসিয়া আছি, এ জীবনে আর রক্ষক হইতে পারিব না।
--পরম পিতার উদ্দেশ্যে একমাত্র তোমাদের মঙ্গল কামনা ও আমাকে তৃতীয়-বার ধরনী-চ্যূত কর এই কামনা নিয়া সংসার কারাগারে দিন যাপন করিতেছি।
আশীর্বাদক-------
তোমার বাবা--
কত না দীর্ঘ-শ্বাসে আঁকা এই চিঠি। যা অতীতে মানুষ লিখত। আজও লেখে। ভবিষ্যতেও লিখবে। ---------------
--------------------------কারণ, সে যে হারায় না,
--------------------তাকে ফিরে পাওয়া যায়,
-------------ফিরে ফিরে পড়া যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।