মনের কথা ব্লগে বলে ফেলুন,নয়তো মনে কথার বদহজম হবে
সভ্যতা বিকাশের ধারায় মানবসমাজে উদ্ভব ঘটে দাসপ্রথার। কালের টানে একসময় বিলোপও হয়ে যায়। কিন্তু সভ্যতার গায়ে ক্ষতচিহ্নের মতো রয়ে গেছে এই অমানবিক প্রথার দাগ। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট বৈশ্বিক তারিখ নেই। একেক দেশে একেক দিন দাসপ্রথাকে বিলোপ করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রাচীন দক্ষিণ এশীয় প-িত কৌটিল্য দাসপ্রথা তুলে দিতে তার সম্রাটকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সম্ভবত এটাই দাসপ্রথা বিলোপের প্রথম উদ্যোগ। আর সর্বশেষ দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯৬৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ২ ডিসেম্বরকে পালন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এবলিউশন অব স্লেভারি’ হিসাবে। এদিন মূলত স্মরণ করা হয় সভ্যতা বিকাশে দাসদের অবদানের কথা, স্মরণ করা হয় গ্লানিময় এক প্রথার কথা।
দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রথম সমাজ হলো গ্রিক সভ্যতার সমাজব্যবস্থা। গ্রিক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দুহাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে। হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসির রচনাকাল আনুমানিক ৭৫০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই দুই মহাকাব্যে দাসত্ব এবং দাসপ্রথার টুকরো কিছু ছবি পাওয়া যায়। হোমার বা হেসিয়ডের রচনা থেকে জানা যায় গ্রিকরা দাসপ্রথাকে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিত।
হোমারের যুগে গ্রিকরা ক্রীতদাস বা ঝষধাব বোঝানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করত ‘অ্যানড্রোপোডন’ শব্দটি, ইংরেজিতে যার অর্থ পযধঃঃবষ ংষধাব. অ্যানড্রোপোডন কথাটির মানে মনুষ্যপদবিশিষ্ট জীব বা গধহ ভড়ড়ঃবফ পৎবধঃঁৎব অর্থাৎ মানুষের মতো জীব। শব্দটি এসেছিল টেট্রাপোডা শব্দের উপমা হিসাবে। টেট্রাপোডার অর্থ চতুষ্পদী গবাদি প্রাণী। গ্রিসের দাসপ্রথা ছিল প্রকৃতপক্ষে পযধঃঃবষ ংষধাবৎু. ক্রীতদাস হলো সেই মানুষ যে আইন ও সমাজের চোখে অন্য একজন মানুষের একটি পযধঃঃবষ বা অধিকার। পলিবিয়াস বলেছেন, জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন হলো গবাদিপশু আর ক্রীতদাস।
গ্রিসের অন্যতম প্রধান দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, দাসব্যবস্থা প্রকৃতিরই নিয়ম। গ্রিসের অভিজাতদের ৩০-৪০ জন দাস থাকত। কৃষি এবং শিল্প খাতে শ্রমের চাহিদা মেটানো হতো দাসদের দ্বারা। গ্রিকদের শিল্প যখন সমুদ্র পার হয়ে রফতানি শুরু হয় তখন দাসদের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। দাস বেচাকেনার জন্য ব্যবসা শুরু হয়।
এথেন্সের দাস ব্যবসায়ীরা এশিয়া মাইনর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে দাস আমদানি করত। ফিনিসীয় দাস ব্যবসায়ীরা নিজেরাই এথেন্সের বাজারে দাস নিয়ে আসত। সিরিয়া, মিসর, আরব প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও এথেন্স এবং অন্য গ্রিক রাষ্ট্রের দাস ব্যবসা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সের অর্থনীতি পুরোপুরিই দাসশ্রমনির্ভর হয়ে পড়ে। মনীষী এঙ্গেলসের মতে, এথেন্সের যখন চরম সমৃদ্ধি তখন স্ত্রী ও পুরুষসহ সমগ্র নাগরিকের সংখ্যা সেখানে ৯০ হাজার।
এরা ছাড়াও ছিল ৩ লাখ ৬৬ হাজার স্ত্রী ও পুরুষ দাস এবং ৪৫ হাজার বিদেশি ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আশ্রিত। অতএব, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকের অনুপাতে ছিল অন্তত ১৮ জন দাস এবং ২ জনের বেশি আশ্রিত। প্রাচ্যে গ্রিকদের তিনটি সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিলÑ নীলনদের মুখে আলেকজান্দ্রিয়া, টাইগ্রিসের তীরে সেলিউসিয়া এবং সিরিয়ায় আরোন্টাসের তীরে এন্টিওক। গ্রিক ভূস্বামীরা প্রাচ্যে বিলাস ও আলস্যের জীবনযাপন করত। গ্রিকদের প্রাসাদ, সুরম্য অট্টালিকা দাসদের শ্রমেই তৈরি হয়েছিল।
প্রাচীন রোম সভ্যতাতেও ছিল দাসপ্রথার প্রচলন। রোমান সাম্রাজ্যের বিজিত প্রদেশগুলোকে রোমে দাস সরবরাহ করতে হতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে গ্রিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার দাস। খ্রিস্টপূর্ব ২য় এবং ১ম শতকে রোমসহ সারা ইতালিতেই দাস শ্রমের ব্যবহার চরম আকার ধারণ করে। দাসদের প্রধানত খাটানো হতো জমি এবং খনিতে।
কৃষির চেয়ে খনির কাজে দাসদের শোষণ করা হতো বেশি। গৃহকার্য এবং কৃষির দাসদের শাস্তি দেওয়ার জন্য খনিতে পাঠানো হতো। রোমান দাস-মালিকরা গ্রিকদের মতোই দাসকে মানুষ মনে করত না। দাসদের বিবাহিত পারিবারিক জীবনযাপন করতে দেওয়া হতো না। রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন আইন এবং রাষ্ট্রীয় সনদ থেকে জানা যায়, ক্রীতদাস তার প্রভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা আদৌ বিবেচনা করা হতো না বরং তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো।
নাট্যকার অ্যারিস্টোফানিস ঠাট্টা করে বলেছিলেন, পাইস (চধরং) শব্দটি এসেছে পেইন (চধরবরহ) থেকে। পাইস অর্থ ক্রীতদাস বা শিশু। আর পেইন মানে প্রহার।
সিন্ধু সভ্যতার যুগ
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, সিন্ধু সভ্যতা ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে অস্তিত্বমান ছিল। পাঞ্জাবের রোপার, কোয়েট্টার কাছে ডাবরকোট, ওমান সাগরের কাছে সুৎকাজেনদোর এবং কাথিয়াবাড়ের লোথালে ধ্বংসস্তূপগুলোর অস্তিত্ব থেকে এর প্রভাবের ব্যাপ্তি চোখে পড়ে।
পরস্পর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো শহর দুটি ছিল সেই সমাজের কেন্দ্র। বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেছেন গ্রামীণ জনসমষ্টির মধ্যেই দাসদের অস্তিত্ব ছিল। শহরে যে এরা ছিলেন তা আরো নিশ্চিত। শহরে কমপক্ষে তিন ধরনের সামাজিক অস্তিত্ব স্বীকৃত শাসকবর্গ (পুরোহিত ও নগরশাসকরা দুটি পৃথক গোষ্ঠী ছিল কিনা তা জানা যায় না), বণিক এবং কারিগর। এই তিনটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থেকে বোঝা যায় ভৃত্যশ্রেণী নিয়ে গঠিত একটি চতুর্থ শ্রেণীর অস্তিত্বের কথা।
এই ভৃত্যেরা বেতনভোগী শ্রমিক অথবা দাসও হতে পারতেন (যুদ্ধ বন্দি, ঋণ-দাস ইত্যাদি) গৃহদাস ও ভৃত্যদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দাস আর বেতনভোগী শ্রমিকও নিয়োগ করতেন বলেই ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস। মহেঞ্জোদারোয় ব্যারাকের মতো দুসারির বাসগৃহের আবিষ্কার এ তথ্যের প্রমাণ দেয়। সব মিলিয়ে এটা বলা যায়, সিন্ধু সভ্যতার গ্রাম ও শহর দুজায়গাতেই দাস শ্রমিকদের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। সিন্ধু সভ্যতার কোনো লিখিত তথ্য পাওয়া যায় না (সিলমোহরগুলোর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি)। তাই সিন্ধু সভ্যতার দাসপ্রথা বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
বৌদ্ধযুগে দাসপ্রথা
বৌদ্ধযুগের সূচনার কিছুদিন আগে (খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে) কোনো মানুষ বিভিন্ন কারণে অপর একজনের সম্পূর্ণ ক্ষমতাধীন হয়ে পড়লে তাকে দাস বলা হতো। তবে দেশের আকৃতিগত বিশালতার কারণে কিছু সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠী দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলÑ গোষ্ঠীর বাইরে যাদের বিবাহ ছিল নিষিদ্ধ। পরবর্তী যুগের রচনায় অভিজাত গোষ্ঠী শাসনতন্ত্রের ধাঁচের এই গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বের সাক্ষ্য মেলে। এই সম্প্রদায়গুলোতে একটা সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীই দাস বলে গণ্য হতো, ফলে এক্ষেত্রে ‘দাস’ শব্দটির শুধু বৈধ ধারণাই নয়, একটি ছদ্ম জাতিগত তাৎপর্যও ছিল। প্রভুরা অনেক সময় দাসীদের উপপতœী হিসাবে গ্রহণ করতেন।
বৌদ্ধ যুগের সূচনায় দুধরনের রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠান দেখা যায়। প্রথম ধরনটিতে ছিল বজ্জী (৮টি রাজ্যের সংযুক্তি), মল্ল, সক্য, কোলীয় ও ভগ্গদের রাজ্যÑ এগুলো ছিল গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র ঘাতক ধরনের জনশাসন। অন্যগুলোতে ছিল রাজতন্ত্র।
রাজতন্ত্রে সেনাবাহিনীতে দাসদের অংশগ্রহণ ছিল। এদের বলা হতো ‘দাসকপুত্ত’ অর্থাৎ ‘দাসের ছেলে’।
রাজ অশ্বশালায়ও দাসদের নিয়োগ করা হতো। অন্যদিকে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রে সেনাবাহিনীতে দাসদের নিয়োগ দেওয়া হতো না।
রাজতন্ত্রে মধ্যম কৃষকরা কৃষি কাজে অল্প কয়েকজন দাস-দাসী নিয়োগ করতেন। ধনী ভূস্বামীদের জমি চাষ করতেন দাসরা। রাজ-অধিকৃত অঞ্চলে অবিরতই নতুন জমি উদ্ধার করা হচ্ছিল।
গাঙ্গেয় উপত্যকার বিশাল অংশ অনেকটাই অরণ্যময়। লোহার কুঠার ব্যবহার করে প্রচুর গাছ কেটে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে পরিষ্কার করা ভূমি লোহার তৈরি লাঙলের ফালের সাহায্যে কৃষিযোগ্য করে তোলা হতো। এই কাজকর্ম চালাতেন দাস ও ভৃত্যরা। বিপরীতপক্ষে, তথ্যের অভাব সত্ত্বেও ধারণা করা হয় গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রে দাসপ্রথা ছিল জন্মগত।
গোষ্ঠীশাসকদের দাসেরা প্রভুদের জন্য কাজ করতে বাধ্য ছিল। সর্বোপরি কৃষির পুরো কাজই চালাতেন দাস ও ভৃত্যরা।
দাস ও ভৃত্যরা অন্য যে কাজটি করতেন তা হলো অনুচরবৃত্তি। রাজাসহ পরিবারের সব সদস্যেরই অনুচর থাকত। ধনী ব্যক্তিদের নিজস্ব অনুচর থাকত।
ধনী ব্যক্তির অনুচর প্রভুর ভ্রমণ বা পদচারণার সঙ্গী হতে।
ধাত্রী বা ধাতীরা শিশুপালনের কাজ করত। তারা দাসী ছিল, নাকি বেতনভোগী স্বাধীন ভৃত্যা ছিলÑ এই আইনগত পদমর্যাদা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত, রাজকন্যার স্তন্যদায়িনী ধাত্রী ছিলেন তার সারাজীবনের সঙ্গিনী এবং কর্ত্রীর পতিগৃহেও ধাত্রী তাকে অনুসরণ করতেন। এখানে দাসত্বের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
‘ধাত্রী-দাসী’, ‘দাসী-ধাত্রী’ শব্দগুলো তাদের দাসত্বসূচক অবস্থানকে নির্দেশ করে কিনা তা নিশ্চিত প্রমাণিত হয়নি। দাস-দাসীদের পক্ষে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন এবং অস্বাস্থ্যকর কাজ ছিল রন্ধনশালায়। তদের খুব ভোর থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত, কখনোবা গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। দ্বাররক্ষক বা দোবারিকের কাজেও দাসদের নিয়োগ করা হতো। এরা অতিথিকে স্বাগত জানাত এবং গৃহস্বামীর কাছে অতিথির আগমনের কথা ঘোষণা করত।
গৃহদ্বারের তত্ত্বাবধানে যে দাস থাকত সে অতিথির পা ধুইয়ে দিত ও তাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেত। যেমন মগধরাজকে তার কোষাধ্যক্ষের গৃহে এভাবেই স্বাগত জানান হয়েছিল। আদেশ পেলে দোবারিক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে গৃহে প্রবেশ করতে বাধা দিত। নারীদের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটিও দেখাশোনা করত দ্বাররক্ষক, যাতে কোনো স্ত্রী ইচ্ছামতো বাড়ি থেকে বেরুতে না পারে। রাজকীয় বাগিচার রক্ষক দাস ছিলেন, না ভৃত্য ছিলেন তা জানা যায় না।
তবে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো একটি তাকে হতেই হতো, কেননা রাজার সাজভৃত্য তাকে দাস বা ভৃত্যরূপে ‘ভনে’ বলে সম্বোধন করত। দাস ও ভৃত্যদের এই সমস্ত কাজ তত্ত্বাবধায়নের ভার ছিল রাজার আস্থাভাজন ব্যক্তি বা গৃহপ্রধানের ওপর (প্রধানত ভূস্বামী কৃষক, সাধারণ বণিক)। মধ্যশ্রেণীর পরিবারে গৃহের নারীদের গৃহকর্মে সহযোগিতার জন্য দু-একজন দাস থাকত। গ্রামীণ পরিবারে স্ত্রী খাদ্য প্রস্তুত করতেন আর দাসরা তা ক্ষেতে পৌঁছে দিত। গৃহশ্রমের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী শাসনতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মধ্যে কোনো মৌলিক ভেদ ছিল না।
মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সময় দাসপ্রথার অবসানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ব্রাহ্মণমন্ত্রী কৌটিল্য। তিনি দাসপ্রথা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সম্রাট অশোকের সময় প্রথম সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়। অশোকের রাজত্বকালে বিচার ও দ-ের ব্যবস্থা সবার পক্ষে একই করা হয়।
বৌদ্ধ সঙ্ঘারামে দাসদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। চীনা পরিব্রাজক ই-ৎসিং এক সঙ্ঘারামে দাসদের দেখেছিলেন। তিনি এক ভিক্ষুর ত্যাগ করা ভূমি, গৃহ, দাস ইত্যাদির কথা বলেছেন। ফা-হিয়েনও মধ্যদেশে রাজা ও গৃহস্থদের দ্বারা সঙ্ঘকে দান করা ভূমি, গৃহ, বাগান, মানুষের পরিবার, গবাদিপশু থাকার কথা বলেছেন। সঙ্ঘারামের যে দাস গ্রহণের অধিকার ছিল সে তথ্যের প্রমাণ মেলে এক কোরীয় পরিব্রাজক হুই-চি আও-এর রচনায়।
তিনি অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে ভারতে আসেন। গান্ধারের রাজার কথা বলতে গিয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন, কেমন করে এই ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধটি ভিক্ষুদের হাতে তার সম্পদ ও স্ত্রীদের দান করতেন এবং আবার তাদের কিনে নিতেন। চীনে বৌদ্ধ সঙ্ঘারামে দাসের অস্তিত্ব প্রমাণের বহু উল্লেখসূত্র আছে। রাজবংশের একসূত্রে সেই শাসনতন্ত্র নিয়ে দুঃখ করা হয়েছে, যেখানে ‘ত্রিরতœ’ অধিকৃত দাসসমেত সংঘের সমস্ত জিনিস প্রশাসন ব্যবহার করে। অন্যত্র জানা যায় সঙ্ঘারাম অধিকৃত অহল্যা ভূমি এবং পার্বত্য ভূখ- চাষ করতেন দাসরা।
ভিক্ষুনীদের ক্ষেত্রে পালিগ্রন্থে মহিলা সঙ্ঘারামে দাসগ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
কম্বোডিয়ায় হিন্দু মন্দিরগুলোর মতো বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতেও দাস ছিল। খমের মন্দিরের অর্থনীতিতে প্রাধান্য ছিল দাস শ্রমের। মন্দিরে যাদের দান করা হতো তাতে স্ত্রী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর দাসের মধ্যে শিশুরাও ছিল। দাসদের সঙ্গে ব্যবহারে সব সময় যথেষ্ট দয়া দেখানো হতো না।
ভিক্ষু রাহুল তার সিংহলে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস বইটিতে সিংহলি সঙ্ঘারামগুলোতে দাসপ্রথার কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘… যে প্রাচীনকাল থেকেই স্ত্রী-পুরুষ উভয়শ্রেণীর দাসরা সঙ্ঘারামের নিযুক্ত হতেন এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ গচ্ছিত রাখা হতো। সিংহলি রাজাদের হাতে ধৃত যুদ্ধবন্দিরাও এই দাসদের মধ্যে ছিলেন।
দাস বিদ্রোহ
প্রাচীনকালের অধিকাংশ বড়মাপের দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ অব্দের মধ্যে। অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের একটি বিশেষ পর্বে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে।
যেমন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩৬-১৩২ সময়কালে সিসিলির প্রথম যুদ্ধ, ১৩৩-১২৯ সময়কালে এশিয়াতে অ্যারিস্টোনিকাসের অভ্যুত্থান, ১০৪ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সিসিলির দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৭১ সময়কালে বিখ্যাত স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ। এসব বিরাট দাসযুদ্ধ উসকে দিয়েছিল অনেক ছোট সংঘর্ষকে। যেমন : ইতালির বিভিন্ন শহর, অ্যাটিকার খনি অঞ্চল এবং ডেলস দ্বীপে ঘটে যাওয়া নানা অভ্যুত্থান। তবে স্পার্টাকাসের পরাজয়ের পর এ মাপের দাস বিদ্রোহ তার ঘটেনি।
স্পার্টাকাস, ইতিহাসের অনন্য নায়ক।
প্রাচীন রোমের এই দাস বিদ্রোহী সম্পর্কে ফরাসি চিন্তাবিদ ভলতেয়ার বলেছেন ‘তার যুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধÑ হয়তো ইতিহাসের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ। ’ ইতিহাসে তার প্রিয় চরিত্র কে? কন্যার এই প্রশ্নের জবাবে মহামতি কার্ল মার্কস উত্তর দিয়েছিলেন ‘স্পার্টাকাস’।
লাতিন স্পার্টাকাস মানে স্পার্টা নগরী থেকে আগত। স্পার্টাকাস ছিলেন একজন গ্লাডিয়েটর। গ্লাডিয়েটরদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন স্পার্টাকাস।
স্পার্টাকাসের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, স্পার্টাকাস তার অনুগামীদের সঙ্গেই যুদ্ধে মারা গেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্রীতদাস মারা গেলেও প্রায় ছ হাজার বিদ্রোহী প্রাণে বেঁচে যায়। এদের রোম এবং কাপুয়ার সংযোগ সড়কে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। স্পার্টাকাসকে নিয়ে অসাধারণ একটি উপন্যাস লিখেছেন মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড ফার্স্ট।
স্পার্টাকাসকে নিয়ে হলিউডে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। আধুনিককালে দাসপ্রথাবিরোধী বিদ্রোহের তাৎপর্যময় দৃষ্টান্ত হাইতির দাস বিদ্রোহ।
হাইতির দাস বিদ্রোহ (১৭৯১-১৮০৩) পৃথিবীব্যাপী দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমস হাইতির দাস বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একমাত্র সফল দাস বিদ্রোহ। ’ হাইতির দাস বিদ্রোহ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
হাইতির আদি নাম সেন্ট ডোমিঙ্গো। হাইতি নামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি। হাইতি ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় হাইতিতে চারটি সম্প্রদায় ছিলÑ ১. শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়, ২. অশ্বেতাঙ্গ স্বাধীন সম্প্রদায়, ৩. কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস শ্রেণী এবং ৪. পলাতক ক্রীতদাসদের সম্প্রদায় বা গধৎড়ড়হ. বিদ্রোহের প্রাক্কালে হাইতিতে প্রায় ২০ হাজার শ্বেতাঙ্গ ছিল। এদের অধিকাংশই ফরাসি।
সে সময় হাইতিতে ছিল প্রায় ৩০ হাজার অশ্বেতাঙ্গ স্বাধীন মানুষ। ১৭৭০-এর দশকের গোড়ায় হাইতিতে ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। স্বাধীন মানুষের সঙ্গে দাসদের সংখ্যার অনুপাত ছিল ১ঃ১০। হাইতির দাসব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত অমানবিক এবং নিষ্ঠুর। অবস্থা এতই ভয়ানক ছিল যে, আমেরিকায় অবাধ্য দাসদের এই বলে ভয় দেখানো হতো যে কথা না শুনলে তাদের সেন্ট ডোমিঙ্গোতে বিক্রি করে দেওয়া হবে।
ঘরগৃহস্থালির রাঁধুনির কাজ, খাস ভৃত্য এবং নানা ধরনের কারিগরের কাজ করত প্রায় লাখখানেক দাস। এরা প্রভুদের কাছ থেকে কিছুটা সদয় আচরণ পেত। বাকি প্রায় চার লাখ দাস কাজ করত মাঠে-ময়দানে। হাইতির কঠিন আবহাওয়ায় এদের পশুর মতো খাটানো হতো। গধৎড়ড়হ বা পলাতক দাসরা প্রভুদের কাছ থেকে পালিয়ে জঙ্গলে এবং পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নিত।
বিদ্রোহের প্রথম দিকের দুজন গুরুত্বপূর্ণ দাস সেনাপতি ছিলেন এই পলাতক দাসদের মধ্য থেকে আগত।
হাইতির দাস বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯১ সালের ২২ আগস্ট। দাসদের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বিদ্রোহীরা বাগিচা মালিকদের হত্যা করে। প্রায় ১ হাজার ফরাসি নিহত হয়।
উত্তরাঞ্চলের বিদ্রোহী দাসরা কেপ ফ্রাঁসোয়া ঘিরে ফেলে। এই বিদ্রোহে এক লাখের বেশি ক্রীতদাস যোগ দিয়েছিল। দাসত্বের শৃঙ্খলে আজীবন নির্যাতিত দাসরা মুক্তির আশায় উন্মত্ত আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে। টানা তিন সপ্তাহ ধরে দাসরা দ্বীপের অগণিত খামার আর বাগিচা পুড়িয়ে দিয়েছিল। শ্বেতাঙ্গরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় উপকূলবর্তী শহরগুলোতে।
বিদ্রোহের দুই মহানায়ক ছিলেন ফ্রাঁসোয়া ডোমিনিক তুসাঁ এবং দেসালিনে। তুসাঁর বিদ্রোহের শুরুতে দাসদের উজ্জীবিত করেছিলেন। নেপোলিয়ন তুসাঁকে পরাজিত করতে হাইতিতে ২০ হাজার সেনা পাঠান। তুসাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ১৮০২ সালে ফরাসিদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে তুসাঁ নিজের খামারে ফিরে যান।
১৮০৩ সালে ফরাসিরা আলোচনা করার জন্য ডেকে এনে তুসাঁকে গ্রেফতার করে এবং ১৮০৩ সালের এপ্রিলে তুসাঁ ফরাসিদের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তুসাঁর বিদ্রোহের হাল ধরেন জ্যাঁ জ্যাক দেসালিনে। ফরাসি সেনাপতি লেকলার্ক এবং জ্যাঁ ব্যাপটিস্ট রোশাম্বোর সঙ্গে দেসালিনের ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৮০৩ সালের নভেম্বরে রোশাম্বো জ্যামাইকায় পালিয়ে যান। ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি দেসালিনের নেতৃত্বে জন্ম হয় স্বাধীন হাইতির।
ফ্রাঙ্কলিন নাইটসের মতে, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সবচেয়ে নিñিদ্র বা সর্বাত্মক একটি দৃষ্টান্ত হলো হাইতির বিপ্লব। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে হাইতির এই বিপ্লব দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে নতুন গতি এনে দেয়। হাইতি বিপ্লবের প্রভাব পড়ে ব্রিটেনেও। ১৮০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের আটলান্টিক জোড়া দাস ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। আর ব্রিটেনে দাস ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে।
ফ্রান্সে দাস প্রথার বিলোপ হয় ১৮৪৮ সালে।
আমেরিকার দক্ষিণাংশের ১১টি রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দাসশ্রম। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন।
লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশে দাসপ্রথা বিলোপের সময়কাল
সুইডেন : ১৮৪৬
আর্জেন্টিনা : ১৮৫৩
মেক্সিকো : ১৮২৯
ডেনমার্ক : ১৮৪৮
কিউবা : ১৮৮৬
ব্রাজিল : ১৮৮৮
মাদাগাস্কার : ১৮৯৬
চীন : ১৯১০
আফগানিস্তান : ১৯২৩
ইরাক : ১৯২৪
ইরান : ১৯২৮
মিয়ানমার : ১৯২৯
সৌদি আরব : ১৯৬২
সংযুক্ত আরব আমিরাত : ১৯৬৩
নেপাল : ১৯২৬
মানব সভ্যতার লজ্জাকর এই প্রথা নিয়ে ফিচার তৈরি করেছেন শানজিদ রশিদ অর্ণব
লিঙ্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।