এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি
নাজমুল করিম সাহেব দীর্ঘক্ষণ যাবৎ অস্বস্বিতে ভুগছেন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, ক্ষমতাবান মানুষদের ভেতর যেই চারিত্রিক শীতলতা থাকে, তা তাঁর ভেতর যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। সারাজীবন মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত তিনি, সাধারণত সরাসরি কারও সাথে কথা বলেন না, তাঁর পিএর মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। সরাসরি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে তাই কিছুটা অস্বস্তিতে তিনি ভুগেন। কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন।
মিস্ত্রী টাইপ এক লোক তাঁর বাসার একতলার বারান্দার বেতের চেয়ারে গত তিন ঘন্টা ধরে বসে আছে। পরনে ধূসর লুঙ্গি, যদিও এটি লুঙ্গির রঙ নয়। সাধারণত রাজমিস্ত্রীরা সারাদিন কাজ করলে সিমেন্টের যেই ধূসর আবরণ তার পোশাকে পড়ে, এই লোকের লুঙ্গির রঙ অনেকটা সেইরকম। অথচ লোকটা পড়ে আছে ধবধবে সাদা শার্ট, এতটাই সাদা, দেখলে মনে হয় মাত্র নতুন শার্ট গায়ে দেয়া হয়েছে, সেই শার্টের বুক পকেটের কাছে কালচে-খয়েরি একটা গাঢ় বৃত্ত, খুব সম্ভবত পানের পিক জাতীয় কোন কিছুর দাগ; নাজমুল করিম সাহেব ঠিক ধরতে পারছেন না।
লোকটার পায়ে একটা সাদা রঙের স্পঞ্জের স্যান্ডেল, উপরে নীল ফিতা।
স্যান্ডেলটার ফাঁক দিয়ে লোকটার নোংরা পায়ের আঙুলগুলো বের হয়ে আছে, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা বিভৎস ভাবে থ্যাতলানো।
নাজমুল করিম সাহেব বিষণ্ন ভঙিতে পাইপ টানছেন। এই মিস্ত্রীর অদ্ভূত স্থবিরতা তাঁকে বিচলিত করেছে বেশ ভালো ভাবেই। তারেকের কথা অনুযায়ী এই লোক এসেছে তিন ঘন্টা হয়েছে। নাজমুল করিম সাহেব নিজেও তিন ঘন্টা ধরেই বারান্দায়।
আজ মাসের তৃতীয় সোমবার। তাঁর নাপিত আসার দিন। তিনি বারান্দায় বসে চুল কাটেন, মাথা মালিশ করান এবং গুণে গুণে পনের মিনিট ধরে মাথা শ্যাম্পু করান। আজও তাঁর এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি লক্ষ্য করেছেন এই দীর্ঘ সময়ে এই লোক একবারও তাঁর দিকে তাকায়নি।
সাধারণত বিচারপতিদের দিকে মানুষজন চোখাচোখি তাকায় না, তাই এটা তিনি হয়তো অগ্রাহ্যই করতেন, কিন্তু এই লোক তিন ঘন্টায় অন্য কোন দিকেও তাকায়নি। নাজমুল করিম সাহেব ক্ষৌরকার্য শেষে চা খান, এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন। সাধারণত এই সময়ে কেউ তাঁকে বিরক্ত করে না, তাঁর আশেপাশেও কেউ থাকে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই লোক তাঁর মাত্র চার-পাঁচ হাত দূরে বসেও তাঁকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি, এমনকি, মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তাঁর আশেপাশে কেউ আছে।
নাজমুল করিম সাহেব রাশভরি ধরণের মানুষ, অত্যন্ত কায়দা করে তিনি গলা খাঁকারি দিলেন।
তাঁর এই শব্দে সাধারণত মানুষ চমকে যায়, কিন্তু এই মিস্ত্রীকে অবিচল দেখা যাচ্ছে। আরও একবার নাজমুল করিম সাহেব গলা খাঁকারি দিলেন। তাঁর অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে।
"স্যার, কিছু বলতে চাইলে বলেন, আমি শুনতেছি। "
নাজমুল করিম সাহেব কিছুটা ধাক্কার মতো খেলেন।
এই ধরণের মানুষদের সাধারণ কমনসেন্স থাকার কথা না। গলা খাঁকারি দিয়ে যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, সেটা এ কীভাবে জানে?
লোকটা আবার বলল, "স্যার, বেয়াদপি নিয়েন না, আমি আপনার জন্যই এই খানে আসছি। কিছু বলতে চাইলে আপনি বলেন। "
"কে তুমি? আমি কি তোমাকে চিনি?"
"জ্বী না স্যার। আপনি আমাকে কী করে চিনবেন? আমি আপনাকে চিনি।
"
"তুমি নাকি আমার দারোয়ান তারেককে বলেছ আমি তোমাকে চিনি?"
"জ্বী স্যার, এইটা বলছি। আপনি গুণীজন, সাক্ষাৎ চাইলেই সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। আপনার সাক্ষাতের জন্য আমাকে টুকটাক মিথ্যা বলতে হইছে। "
"তুমি দীর্ঘক্ষণ ধরে এইখানে নিশ্চল হয়ে বসে আছ, কোন রকম শব্দ করনি। বিষয়টা কী?"
"আপনি চুল কাটতেছিলেন স্যার, এরপর পত্রিকা পড়লেন।
দুইটাই মনোযোগের বিষয়, এই জন্য ত্যক্ত করি নাই। যখন আপনি জানান দিলেন যে আপনি আমার সাথে কথা বলার জন্য তৈরি, তখন আমি আওয়াজ দিছি। এইটাই বিষয় স্যার। "
"তুমি কর কী? আমার কাছে কী ব্যাপারে তুমি মিথ্যা বলে বাসায় ঢুকেছ?"
"আমি মশা মারি স্যার। "
"মশা মার, মানে?"
"মানে স্যার, মশা মারা আমার পেশা।
"
"তুমি কি সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করছ? মশার ওষুধ স্প্রে কর ঘুরে ঘুরে?"
"জ্বী না স্যার। আমি গেরামে থাকি। কোন চাকরি আমি করি না। "
"আমার কাছে কী ব্যাপারে এসেছ?"
"আপনি মশা মারার জন্য লোক খুঁজতেছিলেন, ভাবলাম, আপনের কাজ কইরা দেই। "
নাজমুল করিম সাহেব ভয়াবহ চমকে উঠলেন।
গত কিছুদিন ধরে মশার যন্ত্রণায় তিনি সত্যি ঘুমাতে পারছেন না। দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও কোন লাভ হচ্ছে না। কয়েল-স্প্রে এগুলোকে মনে হয় মশারা খেলা সামগ্রী হিসেবে নিয়েছে। কয়েকদিন ধরে তাঁর সত্যি সত্যি আসমার কথা মনে পড়ছে। বিয়ের পর আসমা সারা রাত জেগে মশা মারত, তিনি আরাম করে ঘুমাতেন।
তিনি গতরাতেও মনে মনে ভাবছিলেন, আসমা যদি আবার বেঁচে ফিরত, আবার যদি আগের মত রাত জেগে মশা মেরে দিত।
"স্যার, চাচী আম্মার কোন তুলনা নাই। "
নাজমুল করিম সাহেব একটু বিরক্ত হলেন, "চাচী আম্মাটা কে?"
"আপনের স্ত্রী। নববধূ সারা রাত জাইগা মশা মাইরা দেয়- এইটা উনি ছাড়া সম্ভব না। "
নাজমুল করিম সাহেব একটু বিস্মিত হলেন, থট রিডিং জাতীয় কিছু জানে নাকি এই লোক? কিন্তু তাঁর জানামতে থট রিডারদের ক্ষমতা বর্তমানেই সীমাবদ্ধ, তিনি এখন যা ভাবছেন সেটা হয়তো এই লোক বুঝতে পারবে, কিন্তু গত কয়েকদিন তিনি যা ভেবেছেন, সেটা এই লোক কী করে বুঝল? বিশেষত যখন তাঁকে এই লোক চেনে না?
একটু সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, "কী নাম তোমার?"
"স্যার আমার নাম আকবর।
আকবর আলি বেপারি। নিজের কারবার নাই, দাদার কারবার ছিল বইলা বেপারি উপাধি ছিল। বাবায় জুয়া খেইলা সব নষ্ট করছিল। শখের বসে দাদায় মরার আগে আমার নাম বেপারি দিয়াই রাইখা গেছে। "
"আকবর।
তুমি স্পষ্ট ভাষায় বল কেন এসেছ আমার কাছে? কী চাও তুমি? আমি মশা মারার লোক খুঁজছি এই অদ্ভূত কথাই বা তোমাকে কে বলল?"
"স্যার, গত দশ বচ্ছর ধইরা একটা অদ্ভূত বিষয় ঘটতাছে। প্রচুর চিকিৎসা করাইছি, কোন ফল পাই নাই। শেষমেষ ছাড়ান দিছি চিন্তা ভাবনা। "
"কী অদ্ভূত বিষয় ঘটছে?"
"স্যার, আমার সামনে আইলে মশাগুলান সব পোষ মাইনা যায়। আমি মাইরা ফালাইলেও কোন সমস্যা নাই, আরও বেশি কইরা পোষ মানে।
"
"ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা। "
"স্যার, আমি যেইখানে থাকি, যত মশা আছে সব উইড়া আইসা আমার শইল্যে বসে, কামড়ায় না, খালি বইসা থাকে। আমি চাইলে এক ডলায় কয়েকশ মশাও মারতে পারি। মাঝে মাঝে মনে হয় মশাগো লগে কথা কইতে পারতেছি। হেরা আমারে কইছে আমার শইল্যের রক্ত নাকি গন্ধ কয়।
হেরা খাইতে পারে না। খাইলে মৃত্যু নিশ্চিত। এইজন্যে চুপচাপ বইসা থাকে। আপনে যে মশা মারতে লোক বিছরাইতাছেন এইটাও হেরা আমারে কইছে। "
"আকবর আলি।
তুমি যে অবাস্তব কথা বলছ সেটা বুঝতে পারছ? মানুষের পক্ষে অন্য প্রাণীর কথা বোঝা সম্ভব নয়। আমরা হয়তো কুকুর-বেড়াল জাতীয় গৃহপালিত প্রাণীদের অনুভূতি বুঝতে পারি, আদর ভালবাসা বুঝতে পারি, কিন্তু ভাষা বুঝতে পারি না। মশা তো আরও ক্ষুদ্র প্রাণী, ওদের ক্ষেত্রে তো অনুভূতিটুকুও বোঝা সম্ভব না। তোমাকে আমি বের করে দিতে পারছি না কারণ, তুমি কোন একভাবে বুঝতে পেরেছ আমি হঠাৎ করেই আমার মৃত স্ত্রীর কথা স্মরণ করছি। কীভাবে বুঝেছ এটা জেনে আমি তোমাকে বের করে দিব।
"
"স্যার আমি তো বললাম কেমনে বুঝতে পারছি। স্যার, আপনে আমারে অবিশ্বাস করলেন? আপনে গুণীজন, মিথ্যা আপনের সামনে আমি বলমু না। আমি শুধু মশাই না, অন্যান্য জানোয়ারের সাথেও মাঝে মাঝে কথা বলতে পারি, কিন্তু মশার মতো এত সুন্দর কথা অন্যগুলানের লগে হয় না। "
আকবর এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, "স্যার। আজকে ঢুকার সময় আপনের বিশাল কুত্তা গুলারে বলতে পারছি আপনের সাথে কথা বলনের সময় যেন ত্যক্ত না করে।
খিয়াল কইরা দেখেন স্যার, কুত্তা গুলান কিন্তু নাই। "
নাজমুল করিম সাহেব ভয়াবহ চমকে উঠলেন। তাঁর বাসায় সত্যি সত্যি দুটো বিশাল গ্রে-হাউন্ড রয়েছে, এগুলো তিনি যেদিন ক্ষৌরকার্য করান, সেদিন তাঁর আশেপাশে বসে থাকে, আজ একটাও নেই। নাজমুল করিম সাহেব তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকালেন। জোরে জোরে ডাকলেন, "তারেক! তারেক!"
তাঁর দারোয়ান-কাম-মালি, তারেক, দৌড়ে এল।
"জ্বে স্যার। "
"কুকুরগুলো কই? ওদের ছেড়ে দাওনি সকালে?"
"স্যার, ছাইড়া দিছি তো। এইগুলান ঘর থিকা বাইর হইতাছে না। আমি দুই-তিনবার ডাকাডাকি করছি, বাঁশি বাজাইছি, কিন্তু দুইটাই চুপচাপ বইসা আছে। "
নাজমুল করিম সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।
ইশারায় তিনি তারেককে যেতে বললেন। এসব হচ্ছে কী? কি সাংঘাতিক বিষয়। কুকুরদুটো অত্যন্ত ট্রেইন্ড, তাদের প্রতিদিনের রুটিনের ব্যতিক্রম কখনোই হয় না, আজ কী করে হল? ক্লান্ত স্বরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "আকবর, তুমি চলে যাও। আমার শরীর ভালো লাগছে না। "
"স্যার, আপনের ঘরের মশা মাইরা যাই।
একটা রাত শান্তিতে ঘুমান। "
নাজমুল করিম সাহেব অনুভব করলেন আকবর আলিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। ধীরে ধীরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, শক্তি পাচ্ছেন না পায়ে, মনে হচ্ছে পড়ে যাবেন। বিচার একটা যৌক্তিক বিষয়, যুক্তি ছাড়া জীবনে তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেননি, আজ অযৌক্তিক একটা ব্যাপার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে, এতক্ষণ তিনি অস্বস্তি বোধ করছিলেন, সেই অস্বস্তিটুকু এখন ক্লান্তিতে পরিণত হয়েছে। ভয়াবহ অবসাদগ্রস্ত এক ক্লান্তি।
"আসো আমার সাথে। " থেমে থেমে বললেন নাজমুল করিম সাহেব।
সিঁড়ি ভেঙে উঠতে খুবই কষ্ট হল তাঁর, নিজের ঘরে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি। তাঁর ঠিক মুখোমুখি বসল আকবর আলি বেপারি, তার চোখ বন্ধ। কিছুক্ষণের মাঝেই অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল।
নাজমুল করিম সাহেব দেখতে পেলেন শত শত মশা পিনপিন করে তাঁর ঘরে ঢুকছে, অনেকটা সন্ধ্যার সময় যেভাবে ঢুকে, অথচ এখন দুপুরটাও ঠিক করে হয় নি। মশাগুলো এসে আকবর আলি বেপারির হাতে পায়ে বসা শুরু করল, চেহারাতেও বসতে থাকল, আকবর আলি একসময় তার শার্ট খুলে ফেলল, মশায় ঢেকে গেল তার শরীর, তবু থামছে না মশার ঝাঁক, একটানে আকবর আলি খুলে ফেলল তার ধূসর লুঙি, মশা তার নোংরা পায়ে, উরুতে বসতে থাকল, হাজার হাজার মশা, আকবর আলি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল, মশায় ঢেকে গেল সে সম্পূর্ণ। তবু মশা মারছে না সে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন সে; এদিকে কুল কুল করে ঘামছেন রিটায়ার্ড জাস্টিস নাজমুল করিম চৌধুরী, অস্বস্তির যেটুকু ক্লান্তিতে পরিণত হয়েছিল, সেইটুকু এখন তীব্র ভয়ে পরিণত হচ্ছে, প্রচন্ড পানির পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তাঁর, সুতির ফতুয়া ভিজে জবজব করছে গায়ে, পাজামাও ভিজে গেছে ঘামে; ঠায় বসে আছেন তিনি, মশার ঝাঁকে অন্ধকার হয়ে গেছে ঘর, বিচিত্র হলেও তাঁর গায়ে কোন মশা বসে নেই, লক্ষ লক্ষ মশা আকবর আলিকে ঘিরে ঘুরছে, পনপন পনপন শব্দ করছে।
"স্যার", হঠাৎ মুখ খুলল আকবর আলি, "আমি আকবর আলি ব্যাপারি, দশ বছর আগে নারায়নগঞ্জে একটা রেপ ও মার্ডার কেসের আসামী ছিলাম। সাথে আরও দুইজন আসামী ছিল।
রেপ করছিলাম এলাকার একটা স্কুল ছাত্রীরে, মূলত আমিই করছিলাম, ওরা করে নাই। রেপের পরে মেয়েটা অজ্ঞান হয়া গেছে দেইখা ভয় পায়া আমিই খুন করি মেয়েটাকে, ওরা আমাকে নিষেধ করছিল খুব, আমি শুনি নাই। আমার মাথার ঠিক ছিল না স্যার। ভয় পায়া খুন কইরা ফালাই। আমার বাবা মনসুর আলি বেপারি ঝানু লোক আছিল, জেলা আদালতের মামলা সে কায়দা কইরা উপরের আদালতে তুলছিল, আপনে সেই মামলার ফাইনাল রায় দিছিলেন।
"
নাজমুল করিম সাহেবের সামনে স্মৃতি থেকে স্পষ্ট হয়ে আসছিল এই ঘটনার ছবিগুলো, তিনি ঘামতে ঘামতে শুনতে লাগলেন আকবর আলির কথা।
"স্যার দোষী আমি আছিলাম, আমার বন্ধুগুলা নির্দোষ আছিল, অথচ আপনে ওগোরে ফাঁসির আদেশ বহাল রাইখা আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন। স্যার, এর পর থিকা আমার শইল্যে মশা আইসা বইসা থাকে, কামড়ায় না, আমি পিষ্যা পিষ্যা মারি, ওরা কয় পাপী মানুষের রক্ত ওরা খায় না। আমি কী করুম স্যার, আমি জানি আমি পাপ করছি, মাইয়াটারে খুন কইরা যা না পাপ করছি, এর চেয়েও বড় পাপ করছি নির্দোষ দুইটা মানুষরে ফাঁসিতে ঝুলায়া। স্যার, আপনে রায় দেওনের পরে আমি চিল্লায়া উঠছিলাম-আমার একটা কথা শুনেন জজ সাব, আপনে শুনেন নাই, উইঠ্যা চইলা গেছিলেন।
আপনের কারণে দুইটা নির্দোষ মানুষ ফাঁসিতে ঝুলল স্যার, কাজটা আপনে অনুচিত করছেন। আপনের কারণে নিজের কান্ধে দোষ নিয়া আমি বাঁইচ্যা আছি স্যার। "
নাজমুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন, তাঁর কথা বলার মতো কোন অবস্থা নেই।
"আমি এখন চইলা যামু স্যার। আমি বাপজানের মৃত্যুর আগে শুনছি, আপনে তখন খুব বিপদে আছিলেন, বাপজান আপেনেরে অনেকগুলা টাকা দিছিল আমারে খালাস করানির লাইগা।
আপনেরে আল্লায় বিচারক বানাইছে, আপনে সুবিচার করেন নাই স্যার। টাকার কাছে নিজের ইজ্জত বেইচ্যা দিছিলেন। এই মশার কষ্ট আমার আর ভাল লাগে না স্যার, আমি কী করুম আপনে কয়া দেন। "
নাজমুল করিম সাহেবের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ হয়েছে, তাঁর নিঃশ্বাস নেয়ার মতোও ক্ষমতা নেই। চারপাশে তাঁর লক্ষ লক্ষ মশা, সম্ভবত মশার ঝাঁক আকবর আলিকে ছেড়ে তাঁর দিকেই চেপে আসছে, অথচ কামড়াচ্ছে না, তাকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য অগুণতি মশা।
কোন বাতাস নেই চারপাশে, মশার পাল আটকে দিয়েছে বাতাস আসার ন্যুনতম পথটুকুও। চোখ উল্টে আসতে চাইল তাঁর, সোফা থেকে পড়ে গেলেন ঠান্ডা মেঝেতে, সংবিৎ হারানোর আগে শুনতে পেলেন পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, সাথে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ, চলে যাচ্ছে আকবর আলি।
পরদিন সকালে পত্রিকাগুলোতে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হল একটি খবর- অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নাজমুল করিম চৌধুরীর নিজ বাসগৃহে রহস্যজনক মৃত্যু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।