আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস



দেশে এখন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠছে। অথচ আজ থেকে এক দশক আগে (২০০০ সালে) গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বিস্তারিত তদন্ত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই তদন্তে শুধু নোরাডের আলোচিত তহবিলই নয়, সুইডিশ এবং কানাডিয়ান সিডা ও কেএফডাবি্লউর অনুদানের টাকাও নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানান্তর করার বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠন ও এতে তহবিল হস্তান্তরে অনিয়ম, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনিয়ম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ড. ইউনূসের অবৈধভাবে বহাল থাকার বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে। এসব অনিয়মের বিস্তারিত উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে ২০০১ সালে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি মন্ত্রণালয়। এমনকি গত এক দশকেও এ বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। গত কয়েক দিন ড. ইউনূসকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর কালের কণ্ঠ অনুসন্ধান করে ৭৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন বের করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়ার কথা বলে বিদেশ থেকে অর্থ এনে সেই অর্থ নিজের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের তহবিলে স্থানান্তরের অভিযোগ ওঠার পর থেকে ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। প্রতিদিনই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে খবর পরিবেশিত হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রবিবার আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টির বিস্তারিত তদন্ত হওয়া উচিত। মুহাম্মদ ইউনূস তদন্তের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। দশ বছর আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ওই তদন্তে অংশ নেন তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক মনোয়ার আলী খান মজলিশ, উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম এবং কবির আহাম্মদ। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলেও কেন ব্যবস্থা নেয়নি_এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, শুরু থেকেই গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যাংক কম্পানি আইন থেকে অব্যাহতি দেওয়া আছে।

১৯৯৯ সালে প্রথম ব্যাংক কম্পানি আইনের ৪৪ ধারার ক্ষমতাবলে গ্রামীণ ব্যাংকে বিস্তারিত পরিদর্শনের বিষয়ে অনুমোদন দেয় সরকার। ফলে পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের ছিল না। প্রতিবেদনটির বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এম শাহজাহানের সঙ্গে টেলিফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে আরো কিছু অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অতীতের সরকারগুলোর অনীহার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। ' ওই প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে তৎকালীন বেশ কিছু অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়।

ওই সব অনিয়মের কয়েকটির এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম : বিদেশি দাতা সংস্থা সিডা (সুইডিশ), নোরাড, কেএফডাবি্লউ সিডা (কানাডিয়ান) থেকে রিভলভিং ফান্ড হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের পাওয়া অনুদান ছিল ৩৪৭ কোটি টাকা। সুদ থেকে আয়সহ এর স্থিতি দাঁড়ায় ৩৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ১৯৯৭ সালের ৭ মে গ্রামীণ ব্যাংক তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণের সঙ্গে তহবিল হস্তান্তর সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির প্রায় পাঁচ মাস আগের তারিখে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৬ গ্রামীণ ব্যাংক উভয় ফান্ডের ৩৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা হস্তান্তর করে।

অলৌকিকভাবে একই তারিখে গ্রামীণ ব্যাংক তা আবার গ্রামীণ কল্যাণ থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে, যা দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন ও আইনবহির্ভূত। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সাধারণ ও যৌথ ঋণ এবং গৃহায়ণ ঋণ কার্যক্রমের জন্য অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে দাতা সংস্থা সিডার সম্পাদিত চুক্তির শর্তাবলি নোরাডের চুক্তির অনুরূপ বিধায় সিডার অনুদানের টাকা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা যুক্তিসংগত নয়। প্রকৃতপক্ষে দাতা সংস্থা থেকে রিভলভিং ফান্ড হিসেবে নেওয়া অনুদান গ্রামীণ ব্যাংক এর সদস্য ও কর্মীদের ইতিমধ্যে ঋণ হিসেবে দিয়েছে বিধায় বাস্তবে তা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক একটি পেপার ট্রানজেকশন করেছে মাত্র। ঋণের টাকা অন্য প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর উক্ত অনুদানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

' ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ ব্যাংক তার ১৮টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ স্থানান্তর করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গ্রামীণ ব্যাংক তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে এবং হস্তান্তরের তারিখেই তা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। ব্যাংকের সম্পদ অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ' পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম : গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকের কাজ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের সার্বিক দায়িত্ব এর পরিচালনা পর্ষদের ওপর ন্যস্ত। সরকারের মনোনীত তিনজন (একজন চেয়ারম্যানসহ) এবং ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা-শেয়ারহোল্ডারদের নির্বাচিত ৯ জন নিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত।

পদাধিকারবলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য কিন্তু তাঁর কোনো ভোটাধিকার নেই। এ ছাড়া অধ্যাদেশের ১৮ ধারার আওতায় বিভিন্ন সময় জরুরি বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকার মনোনীত তিনজন পরিচালক ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সমন্বয়ে একটি নির্বাহী কমিটি রয়েছে। অথচ পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটিকে পাশ কাটিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ড. ইউনূস নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিদর্শনকালে দেখতে পান, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১৯৯৮ সালে চারটি ও ১৯৯৯ সালে তিনটি সভায় মিলিত হয়েছে। এই সাতটি সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিচালনা পর্ষদ শাখা খোলার প্রস্তাব অনুমোদন, অনাদায়ী ঋণের প্রভিশন রাখার প্রস্তাব অনুমোদন, অবলোপনের প্রস্তাব অনুমোদন, নিট মুনাফা বণ্টনের প্রস্তাব অনুমোদন, বাজেট অনুমোদন ইত্যাদি কাজ করে।

অন্যদিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেমন বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন কর্মসূচি, ২০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি, প্রভিশনের হার নির্ধারণ, ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয়ে পর্ষদ শুধু অবহিত হয়েছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই পরিচালনা পর্ষদ নেয়নি। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের সভাগুলোর কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে পর্ষদ সভার কার্যক্রমে ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা-শেয়ারহোল্ডার ৯ জন পরিচালকের কোনো কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। ' ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ড. ইউনূসের বহাল থাকা অবৈধ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনকালে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মুহম্মদ খালেদ শামস। গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর।

ড. ইউনূস ওই সময়েই অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ তারিখেই তা অতিক্রম করেন। সে অনুযায়ী, ২০১০ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রায় ১১ বছর ধরেই অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ দখল করে আছেন। অন্যদিকে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ড. ইউনূসের মেয়াদ বাড়াতে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও তা করেনি গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। তহবিল স্থানান্তরিত প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস : ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের সময় গ্রামীণ ব্যাংকের ২১টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মধ্যে একটির নিবন্ধন ছিল না, বাকি ২০টির মধ্যে ১১টি অলাভজনক ও ৯টি ছিল লাভজনক।

২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮টিরই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদে অন্যদের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগী প্রতিষ্ঠান কিংবা গ্রামীণ পরিবারের সদস্য দাবি করলেও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আইনগত সম্পর্ক নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কম্পানি আইনের আওতায় নিগমিত পৃথক আইনগত সত্তা। ' এমনকি গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যাংকটি এর সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠানকে গ্যারান্টি দিতে পারে না।

কিন্তু ওই সময়ে ব্যাংকটি বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ১৮ কোটি টাকার গ্যারান্টি দেয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, 'অন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক গ্যারান্টি দেওয়া গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। '

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।