চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!
বছর বছর এদেশের শত শত মানুষ শীতে প্রাণ হারাচ্ছেন। শীত জনগণের জন্য আজও এক জীবন-মরণ সংকট। জানুয়ারি, ২০০৩ এর শৈত্যপ্রবাহে ৭০০-রও বেশি মানুষ প্রাণ হারান, ২০১০এ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই মৃত্য হয় ১৭৬ জনের । এ সবই শীতে জনদুর্ভোগের খন্ডচিত্র। শৈত্যপ্রবাহ ও শীতজনিত রোগে পরোক্ষ মৃত্যু ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়।
কিন্তু কেন এই মৃত্যুর মিছিল?
বস্ত্র, বাসস্থান, খাদ্য উৎপাদন ও চিকিৎসা উন্নত করে সভ্য মানুষ শীতের সমস্যা দূর করেছে অনেক দিন আগে। বরফ জমা ঠান্ডা পরিবেশেও মানুষ বসবাস করছে। বিত্তবান ও মধ্যবিত্তের কাছে শীত উপভোগ্যও বটে। তবে ২০১০ সালে দাঁড়িয়ে কেন অসংখ্য মানুষকে শীতে মৃত্যুর সাথে লড়তে হবে? কারণ আজও এদেশের ২৪.২% মানুষের এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় পৌনে ৮কোটি মানুষ, এদের মধ্যে ৪০% মানুষের কোন শীতবস্ত্র নেই, ৩০% এর নেই দুটো জামা। মোট জনসংখ্যার ৭৫% মানুষ বাস করে কাঁচাঘর ও ঝুপড়িতে, অপুষ্টিতে ভুগছে ৫০% আর শিশুদের ৯২%।
ফলে শীতে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন, রুগ্ন এক বিশাল জনগোষ্ঠী শীতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে দিন কাটায়। তাই আমরা বলতে চাই, শীতের এই সংকট শৈত্যের সংকট নয় বা কোন প্রকৃতিসৃষ্ট সমস্যা নয় বরং চরম দারিদ্র্যই এজন্য দায়ী।
তাহলে এ দারিদ্র্যের শিকড় কোথায়?
সত্য আড়াল করায় যাদের স্বার্থ, তারা বলে “জনসংখ্যা বাড়ছে, দেশ গরিব, সম্পদ নাই। তাই মানুষের অভাবও যায় না। ” অথচ একাত্তর পরবর্তী ৩০ বছরে জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ আর মোট উৎপাদন বেড়েছে ৬০ গুণ।
কিন্তু প্রতিজনের আয় ৩০ গুণ বেড়েছে কি? না, বাড়েনি। বরং আয় বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০%। অমরা জানি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য সবার আগে দরকার অর্থনৈতক উন্নতি। আর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সবার আগে দরকার কৃষি সংষ্কার। অথচ এদেশের কৃষি আজও ক্ষুদ্র ও পশ্চাৎপদ।
সাম্রাজ্যবাদী সার, বীজ, কীটনাশক উচ্চমূল্যে কেনা, সরকারি ক্রয়কেন্দ্র ও ফড়িয়াদের কাছে সস্তায় ফসল বিক্রি, বর্গার ভাগ, এনজিও আর মহাজনী উচ্চ সুদ ইত্যাদি কেবলই নিংড়ে নিচ্ছে কৃষককে। এভাবে কৃষিকে অনুন্নত রেখে গ্রামীণ সমাজে সৃষ্টি করা হচ্ছে চরম বেকারত্ব আর অভাব, যাতে শহরাঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে গড়ে তোলা শিল্প-কারখানায় সস্তা শ্রমের যোগান পাওয়া যায়। মানুষও নিরুপায় হয়ে ছুটছে শহরে, কিন্তু শহরেও মিলছেনা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মত কাজ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে এদেশের শিল্প-কারখানা তৈরি করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের স্বার্থে। আর গত ৪০বছরে এদেশের শিল্পের ইতিহাস পুরোন ও দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় স্বার্থে শিল্পায়নের ইতিহাস।
বিদেশি বিনিয়োগের নামে গড়ে উঠছে ইপিজেড আর সেজ। সেসব জায়গায় কর্মসংস্থানের মূলো ঝুলিয়ে করা হচ্ছে গার্মেন্টস ধরনের সাম্রাজ্যবাদী মুনাফা বানানোর কারখানা। বিশ্বের সস্তাতম মজুরিতে সীমাহীন নির্যাতন নিপীড়ণ করে দেশি-বিদেশি শোষকেরা নিংড়ে নিচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিকদের। শুধু তাই নয়, গত ৪০ বছর ধরে এদেশের ব্যাংক, বৈদেশিক ঋণ, রাজস্ব, তেল, গ্যাস, বন্দর, বিদ্যুৎ সর্বত্র হরিলুট অব্যাহত রয়েছে। আর এর মধ্য দিয়েই ’৭২ সালে যেখানে হাতে গোনা কয়েকজন কোটিপতি ছিল, সেখানে এখন কোটিপতি আমানতকারীই রয়েছে প্রায় ২৪,০০০জন।
তাই এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সীমাহীন দারদ্র্যের শিকড় বৈষম্য আর শোষণ-লুন্ঠনের এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মাঝেই রয়েছে।
কার স্বার্থ রক্ষা করছে এই শোষণমূলক ব্যবস্থা?
আমাদের দেশের লাখ লাখ শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে গড়া তৈরি পোশাক নাকি দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য, অথচ এদেশের মানুষের শীতে বস্ত্র নেই। খাদ্যাভাব আর জনস্বাস্থ্যের দূরবস্থার এই দেশে চলে ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতাল আর ক্লিনিকের প্রসার আর দরিদ্রদের উচ্ছেদ করে চলে রমরমা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আর আবাসন প্রকল্প। অথচ এই শীতে অসুস্থ বহু মানুষের জোটেনা একটু চিকিৎসা, একটু নিরাপদ বাসস্থান। নিঃসন্দেহে এ ব্যবস্থা এদেশের সংখ্যাগড়িষ্ঠ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করছে না।
এ ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় সম্পত্তিশালী ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে, যারা দুর্নীতি, শোষণ, লুটপাট, দেশ বিক্রির কালো টাকা আর সস্তা শ্রমের যোগানদার হয়ে দালালির টাকায় ধনবান হয়েছে। ফলে এদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের দালাল বহুদলে বিভক্ত এদেশের ধনিক ও শাসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করছে।
তবে এই কি আমাদের ‘স্বাধীনতা’, এই কি আমাদের ‘গণতন্ত্র’!
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হলেও এদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রধানত সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিকভাবে ভারতের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। এদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের দালাল শাসকশ্রেণী গত ৪০ বছর ধরে কখনও সামরিক, কখনও সংসদীয় উপায়ে জনগণের উপর শোষণমূলক ব্যবস্থা বজায় রেখেছে এবং রাখছে। জনগণের ভাত-কাপড় নিশ্চিত না করে, প্রকৃত ক্ষমতার মালিকানা না দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে কেবল ভোট দেওয়াকেই শিখিয়েছে।
‘টেকসই উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধি’র ধারণায় সাম্রাজ্যবাদের সেবার অর্থনীতি কায়েম করেছে আর ‘সুশাসন’এর নামে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ব্যাপক জনগণের উপর কায়েম করেছে স্বৈরাচারি ব্যবস্থা। সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী মহাজোট সরকার। ধারাবাহিক উর্ধ্বগতিতে কেবল গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসেই দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১৬%। গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শ্রমিকদের জন্য অন্যায্য মজুরি কাঠামো, শিল্প-পুলিশ গঠন, ভারতকে ট্রানজিট প্রদান ও দেশবিরোধী যৌথ ইশতেহার, সাম্রাজ্যবাদের হাতে তেল-গ্যাস-কয়লাসহ খনিজ সম্পদ তুলে দিতে কয়লানীতি, মডেল পিএসসি ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিল পাশ করেছে। বন্দর ও গভীর সমুদ্র সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে।
সমাজের সকল স্তরে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। শ্রমিক হত্যা ও নির্যাতন, ছাত্র হত্যা, পাহাড়িসহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার ওপর দমন, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম সীমা ছাড়িয়েছে। চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন, ইভ টিজিং, শিক্ষক হত্যা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোহাই দিয়ে চলছে লুটপাট আর দেশ বিক্রির মহোৎসব। এসবের বিপরীতে জনগণও নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে।
শিল্পাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিক হত্যা-নির্যাতন বিরোধী ধারাবাহিক শ্রমিক বিক্ষোভ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্ধিত ফি ও অগণতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, বিকশিত হচ্ছে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, জাতিসত্ত্বার আন্দোলন। ভূমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধেও চলছে গণপ্রতিরোধ। শাসকশ্রেণীর ভুয়া ‘স্বাধীনতা’ ‘গণতš’¿র বিপরীতে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শর্ত তৈরি হচ্ছে ।
কোন পক্ষে দাঁড়াবেন?
একদিকে মত্যুর অপেক্ষায় প্রবল শীতে কান্নারত অসুস্থ খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন, চিকিৎসাহীন অসংখ্য শিশু-বৃদ্ধ আর অন্যদিকে সুস্বাদু খাবারের রেসিপি, শীতপোশাকের ফ্যাশন প্যারেড, ব্যয়বহুল হাসপাতাল ও ক্লিনিক, রিহ্যাব মেলা, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের চাকচিক্য আর শপিংমলের জৌলুস। একদিকে এদেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণ অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল ধনিক শ্রেণী।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদের ভুয়া উন্নয়ন আর সুশাসনের ধারণা অন্যদিকে জনগণের ক্ষমতা আর অর্থনৈতিক মুক্তি। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের দাসত্ব আর তার দালালদের সামনে অবনত থাকা অন্যদিকে জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা। স্পষ্টতই, দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণীর তীব্র শোষণ-লুন্ঠণই শীত সংকটের মূল কারণ। অথচ শীত সংকটের মূল কারণ কী- সে প্রশ্নটি উহ্য রেখে, জনগণের দুর্দশা নিয়ে সৌখিন মানবিক বোধের বুদবুদ ছড়ায় শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া আর এনজিও। চেষ্টা চালায় জনগণকে বিভ্রান্ত করতে।
কেবল শীত সংকটই নয়, সমগ্র দেশ-জাতি-জনগণের মুক্তির জন্য প্রয়োজন শোষণ-লুন্ঠন-বৈষম্যের এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করা। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। নিজস্ব অর্থনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
তাই আসুন, শোষণমূলক এই সমাজের সেবা নয়, বরং পরিবর্তনের লক্ষ্যে, শীত সংকটের সমাধানসহ সমগ্র জাতি ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে দালাল শাসকশ্রেণী ও তাদের শোষণমূলক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে জাতি ও জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হই!
* শীতার্ত জনগণের জন্য অর্থ, বস্ত্র ও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সহযোগিতা করুন!
* জরুরি ত্রাণ সহযোগিতা পাঠাতে নিরুদ্বেগ সরকারের কাছে সোচ্চার দাবি তুলুন!
* শাসকশ্রেণীর ছড়ানো বিভ্রন্তির বিরুদ্ধে সঠিক মত তুলে ধরুন!
* বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করুন!
* স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হোন!
প্রগতির পরিব্রাজক দল- প্রপদ এর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেট। প্রকাশকাল ০৬ ডিসেম্বর ২০১০।
যোগাযোগ- ডাকসু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল: +৮৮০১৯১৩৩০৫২১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।