আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শী তে র প দা ব লী : সাহিত্যে শীতকাল ( দ্বিতীয় কিস্তি )

Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience
চমৎকার লাগে এইসময়ে আবহাওয়ার ওঠানামা ৷ রাত্রিজুড়ে ভীষণ শীত ৷ সকালে সূর্যমামার আসার পর থেকে হীমকণাগুলো গুটিয়ে আসে ৷ ভয়ে না পরাজিত হয়ে তা যেটাই হোক ভোরের এসময় থাকে শীতের থাকে দারুণ জয় জয় রব ৷ সারারাত ঘরে শীতের পিঠা বানানোর কাজ চলে ৷ রাতে গরম গরম পিঠা খাওয়ার ধুম ৷ সকালেও গরম গরম পিঠা বানানো হয় ৷ ভোরের কুয়াশা আর সকালের গরম পিঠার ভাঁপ একত্রে মিশে শীতের সকালকে অফুরন্তু আনন্দময় করে তোলে ৷ কোনও কোনও পিঠা রাতে বানানোর পর সকালে ঠান্ডা আমেজে খাওয়ার হয় ৷ রসে ভিজে ঘন কুয়াশার মতো নরম হয়ে ওঠে রাতে রসের ভেজানো পিঠাগুলো ৷ সুফিয়া কামালের শীতের পিঠা খাওয়ার আনন্দকে দারুণভাবে উপলব্ধি করেছেন ৷ সেই পিঠার সাথে যে মায়ের বকুনি আনন্দকে কত বাড়ায় তা বেশি করে শীতের আনন্দের সাথে যুক্ত হয়৷ তার লেখনীতে, "পৌষপার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, / আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে ৷" সত্যিই, শীতের দিনে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায় ৷ নানারকম পিঠা ৷ তেলে ভাজা পিঠা, তেল ছাড়া পিঠা, আরো রসের পিঠা ৷ সামর্থ্যে না কুলালেও প্রত্যেকেই চায় একটু পিঠার আয়োজন করতে ৷ সবাই তার সাধ্যের মধ্যে কমবেশি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করে থাকে ৷ ভাঁপা, পুলি, চিতই যেন রসনার বাড়তি আয়োজন হয় ৷ এই পিঠা খাওয়ার আনন্দটুকু সবাই যেন একটু হলে পরখ করে তৃপ্ত হতে চায় ৷ এ সময় রসের আয়োজন সত্যি সব কিছুকে আরো উন্মুখ করে তোলে ৷ চারিদিকে রসের মৌ মৌ গন্ধ ৷ শহরাঞ্চলে দেখা যায় বাণিজ্যিক ভাবে পুরো শীতজুড়ে পিঠা তৈরি ও বেচাকেনা চলতে থাকে ৷ এতে অবশ্য ভাঁপা ও চিতই পিঠাই বেশি দেখা ৷ পিঠার উত্সব হয় ৷ বড় বড় খাবার দোকানগুলোতে পিঠা বিক্রি হয় ৷ তবে এতে আর যাই হোক ঘরে পিঠা বানানোর আমেজই থাকে না ৷ কৃত্রিম একটি পিঠাভোজের আয়োজন চলে তাতে৷ স্বতঃস্ফূর্ত উত্সবের অভাব তাতে দেখা যায় ৷ কিন্তু শীত কোনও কৃত্রিমতা মানে না ৷ সকল কৃত্রিমতাকে সে বরং দূরে ঠেলে নিজের স্বকীয়তাকেই উচ্চকিত করে তোলে৷ তার আগমন বার্তায় তীব্রতা আছে৷ কখনো সে খুব ম্রিয়মান হয়ে দিন কাটায় ৷ কখনো সব কিছু ভেঙেচুরে হাড়হাড্ডির কাঁপোন লাগিয়ে সে আসে ৷ চারিদিকে গোলাভরা ধান ৷ খেঁজুরের রস জ্বাল দেয়া হচ্ছে সকালবেলা ৷ ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ ৷ শীতে জড়োসড়ো হয়ে সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা ৷ এরকম পৌষের দিনের ডাক দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ তিনি পাকা ফসলেও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খুশিতে ৷ তার খুশি তিনি ধরে রাখতে পারেননি - "পৌষ তাদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে / আয় আয় আয় / ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, / মরি হায় হায় হায় / হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ধানের ক্ষেতে- / রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হায় হায় হায় ৷" এভাবে যদি পৌষের আহক্ষানে সাড়া দেয়া যায় তাহলে কার না ভালো লাগে ৷ শীতের আনন্দ মাঝে মধ্যে মনে হয় যেন অর্থবিত্তের সাথে ওঠা নামা করতে থাকে ৷ যে যতটুকু গরমকে ক্রয় করতে পারে তার যেন তত আনন্দ৷ যদিও কথাটা পুরোপুরি ঠিক না, তবুও শীতের সাথে গরম পোশাক অবশ্যই জড়িত ৷ শীত আসলেই বোঝা যায় শীত এসেছে ৷ শীতকালে ভোজনেও তৃপ্তি পাওয়া যায় ৷ স্বপ্নও দেখা যায় ইচ্ছেমতো ৷ সকল জীর্ণ-শীর্ণতাকে দূর করে হিম রাতের ভিতর নিজের স্বপ্নকে লুকিয়ে রেখে রবীন্দ্রনাথ তার ভাবনাকে ছড়িয়ে দেন- "শীর্ণ শীতের লতা / আমার মনের কথা / হিমের রাতে লুকিয়ে রাখে / নগ্ন শাখার ফাঁকে ফাঁকে, / ফাল্গুনেতে ফিরিয়ে দেবে ফুলে / তোমার চরণ-মূলে- / যেথায় তুমি, প্রিয়ে, / একলা বসে আপন মনে / আঁচল মাথায় দিয়ে ৷" পৌষ মাসের শীত প্রায় শেষ হয়ে গেলেও, বাকি থেকে যায় মাঘের শীত ৷ শুরু হয় আরো প্রবল বেগে ধেয়ে আসা শীতের দাপট ৷ কে তা গ্রহণ করল না করল তাতে মাঘের কিছু আসে যায় না ৷ শীতের হাওয়াকে গ্রহণ করা না করার কোনো ধার সে ধারে না ৷ শীতের কনকনে হাওয়া উপেক্ষা করা যায় না কোনোভাবেই ৷ এ হাওয়া কাউকে কষ্ট দেয় আবার কাউকে দেয় আনন্দ ৷ আসলে কারোর কোনও কিছু ভালো লাগা না লাগাকে বিবেচনায় রেখে মাঘ আসে না ৷ সে আসে প্রাকৃতিক নিয়মেই ৷ সে আসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে তার নিয়ম রক্ষার্থে ৷ তাকে যে আসতেই হবে ৷ পৌষের পরেই যে মাঘ মাস ৷ এমাসও তো শীতের কিছু বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের মধ্যে দিয়েই মৌসুমী হাওয়া বদল করে থাকে ৷ বর্তমান বৈরী আবহাওয়া অনেক কিছু পরিবর্তন করলেও প্রকৃতির খেয়ালকে কি সহজে পরিবর্তন করা যায় ৷ মাঘ শীতকে ভরপুর করে তোলে ৷ সবখানে কুয়াশা আর কুয়াশা ৷ কুয়াশা ভেদ করে সকালের সূর্য বেরিয়ে আসতে পারে না ৷ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানও যেন হয় না ৷ সারারাতের হাড়কাঁপুনী শীত সহ্য করতে হয় সকালের সূর্যের উত্তাপের অপেক্ষায় ৷ সূর্য ওঠে ঠিকই কিন্তু সে তার উত্তাপ সাথে সাথে ছড়াতে পারে না ৷ তাকে কুয়াশার চাদর ভেদ করে মানব সন্তানের চামড়ার চাদর ভেদ করে আরামের ব্যবস্থা করতে অনেক কষ্ট করতে হয় ৷ যুদ্ধ করতে হয় কুয়াশার সাথে ৷ তবু শেষ পর্যন্ত উঁকি দেয়া সূর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটায় ৷ তাপের বিকিরণে দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে স্বস্তি আনে । কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শীতের এমন অপেক্ষাকে অনেক মানবিক দৃষ্টিতে দেখেছেন ৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি শীতের সকালের প্রত্যাশিত সূর্যের জন্য যে প্রতীক্ষা তার ব্যকুলতার কথা বলেছেন ৷ তার 'প্রার্থী'কবিতায় শীতের কাছে আকুতি ভরা কণ্ঠে চেয়েছেন এক- “টুকরো রোদ্দুর "হে সূর্য! শীতের সূর্য! / হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় / আমরা থাকি, / যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ, / ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্য / ... ... ... / হে সূর্য, তুমি তো জানো, / আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব! / সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে, / এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে, / কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই ! / সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর- / এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী৷ / ঘর ছেড়ে আমরা এদিক- ওদিকে যাই- / এক- টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায় ৷" শীতঋতু ওমওম ঋতু ৷ আলসেমীতে পেয়ে বসে সহজেই ৷ কোনও কাজ শুরু করাটাই যেন কঠিন হয়ে পড়ে ৷ তবু বাধ্য হতে হয় যেসব কাজে তা একবার শুরু করলে সহজেই ঠান্ডার সাথে মানিয়ে যাওয়া যায় ৷ পারতপক্ষে না পারলে কোনও কাজে হাতই দিতে মন চায় না ৷ আড়মোড়া ভেঙে আলস্যকে দূর করা সত্যি কষ্টকর মনে হয় ৷ নেহায়েত নিরূপায় হয়েও অনেক কাজ করতে হয় ৷ কখনও এমন হয় যে বিছানা গড়াগড়ি দিয়েই বেলা কেটে যায় ৷ নাওয়া খাওয়াও নেহায়েত অসহায় ৷ অথচ শীত নাচাল৷ তাকে তার নিয়ম রক্ষা করতে হয় ৷ পুরো বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রাখতে হয়৷ পাছে কেউ আবার অভিযোগ করে শীত আসলো অথচ টেরই পেলাম না ৷ শীতকে নিয়ে অনেকেই অনেক ভাবে চিন্তা করে থাকে ৷ একেকজনের দেখা একেক রকম ৷ প্রত্যেকেই যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে শীতকে দেখে থাকে ৷ ভালো খারাপ উভয় রকম, এমনকী মিশ্র অনুভূতিও থাকে ৷ কেউ যদি রাত জেগে জেগে ভোর দেখে সেই বুঝবে রাতের শীতের ধরন কেমন ৷ এটাও একটি অভিজ্ঞতা ৷ এ অভিজ্ঞতা কি সকলেই লাভ করি? 'সিলেট স্টেশনে একটি শীতের প্রভাত' নামে এক কবিতায় ফররুখ আহমদ একটি শীতের প্রভাতের চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছেন৷ ইরানী ছুরির মতো তীক্ষ্ম ধার হাওয়াকে তিনি উপমা শীতের কনকনে হাওয়ার উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছে ৷ তাঁর কবিতায়- "অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণী ও প্রাণের / সাড়া নেই ৷ এখানে জালালাবাদে দেখি এসে / হিম-সিক্ত কম্বলের মতো রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে / সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের৷ / ইরানী ছুরির মতো তীক্ষ্ম ধার হাওয়ার উত্তরের / বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে / তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে / সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের ৷" মাঘের শীতের সময় আবহাওয়া যেন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ এসময় শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়৷ প্রচন্ড-ভাবে শীত তখন জেঁকে বসে ৷ মানুষের অনেক কষ্ট হয় ৷ দুর্যোগের মধ্যেই ফেলে দেয় বলা যায় ৷ সারারাত আরো কষ্ট ৷ অবর্ণনীয় কষ্ট হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ৷ আর সকল জায়গায় গরীব মানুষের ৷ এই শৈত্যপ্রবাহ এমনকী গৃহপালিত পশুদের নিদারুণ কষ্টভোগে বাধ্য করে থাকে ৷ তবু মানুষ প্রকৃতির প্রয়োজনেই শীতের আগমন আশা করে থাকে ৷ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী শীতের একটি বর্ণনা দিয়েছেন- "তুষারি শিশির রিতু হিম চারি মাস / খুল্লনার শীত খন্ডে রবির প্রকাশ ৷" বাহারি ফুলের সৌরভে যুক্ত হয় হরেক রকম ফুল ৷ শীতের সবজি তো রুচির মধ্যে বৈচিত্র্য এনে থাকে ৷ দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়াতেও যথেষ্ট রুচি পাওয়া যায় ৷ সব কিছু মিলে শীত নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরার চেষ্টা করে ৷ শিশিরসিক্ত ভোর আর কুয়াশা ঢাকা প্রকৃতি তো আছেই ৷ কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হিমের এমন বিষয়টি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেন; "শিশিরের কোলে হিমঋতু আসে, / নিশি-অশ্রুজলে তরুদল ভাসে ৷" শীত সত্যি দরিদ্র মানুষের জন্য কষ্ট এনে থাকে ৷ তারা সারারাত অপেক্ষায় থাকে একটু রোদের জন্য ৷ সকালের সূর্যের প্রতীক্ষায় কাটে তাদের প্রহর ৷ শীতের মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয় না বললেও চলে ৷ তবু হঠাত্ বৃষ্টি হয়ে যায় কখনো কখনো ৷ সে কষ্ট আরো নিষ্ঠুর হয়ে আসে গরীবের জন্য ৷ প্রকৃতি যেন এক নিষ্ঠুর খেয়ালে মেতে আনন্দ পায় ৷ অথচ শীতের রোদকে বিলাসী করে উপভোগ্য করে তোলে অভিজাত মানুষেরা ৷ ভ্রমণ আর ঘুরে ঘুরে আনন্দ মেতে থাকে তারা এসময় অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি ৷ ধনী-গরীব ভেদে একই বিষয় একেক জনের কাছে একেক রকম ৷ মাঘের রাত্রিগুলো বড় কষ্টকর ৷ মাঘের শীত বাঘের শীতের মতোই ৷ তখন মনে হয় এক মাঘে আসলেই শীত যায় না ৷ এই ব্যবধান কবে ঘুচবে কে জানে ?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।