১৯৯৭ সালে লেখা “দি গড অব স্মল থিংস” অরুন্ধতী রায়ের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র উপন্যাস। ১৯৯৭ সালেই তিনি এই উপন্যাসের জন্য সম্মানজনক বুকার পুরস্কার লাভ করেন। অরুন্ধতী রায় বাস্তবজীবনে খুব অনুভূতিশীল মানুষ, মানুষের দুঃখে কেঁদে ওঠেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারতের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়ান। বুক ফুলিয়ে অবলীলায় যা সত্য তাই বলে দেন। তাঁর আত্নজীবনীমূলক এই উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া যায় নি।
মানুষের হাসি, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, ভালোবাসা, বিরহ, ঘৃণা প্রভৃতি সব মানবিক ব্যাপারগুলোকে খুব সূক্ষভাবে দেখার একটা অদ্ভুত গুন আছে তাঁর মাঝে। এই উপন্যাসে মানব জীবনের ছোট ছোট মূহুর্তগুলোকে ছোট ছোট করে হৃদয়গ্রাহীভাবে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন সুনিপুণ মুন্সিয়ানায়। অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে যুগপৎভাবে পথ চলে পাঠককে একটা ঘোরের মধ্যে মোহিত করে রেখেছেন তিনি তাঁর লেখার জাদুতে। বর্ণবাদ, সমাজতন্ত্র, পুজিবাদ, প্রেম, প্রতিশোধ, দুই জমজ শিশুর দুঃখময় বেড়ে উঠা, একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসা, সব ঘটনাপ্রবাহ মিশেছে যেন এক মোহনায়।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র আম্মু এইমেনেমের মেয়ে, দুই ভ্রুনের দুই জমজ শিশু এস্থা ও রাহেলের মা।
দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের শীনাচল নদীর তীরে এক ছোট শহর এইমেনেম। মালাবার, কালিকট, কোচিনসহ প্রাচীন ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ এ কেরালা রাজ্যেরই। পর্তুগীজ, ইংরেজসহ ইউরোপীয় জাতিগুলোর সাথে এ রাজ্যের মানুষের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অনেক আগে থেকেই। এদের হাত ধরেই জলপথে খৃষ্টধর্ম এসেছিল, এসেছিলেন সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা। ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে তাই এই রাজ্যটা ব্যতিক্রম, এখানে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, শিক্ষার হারও বেশি।
মেধাবী মার্কসবাদী নেতা কমরেড ই.এম.এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে পৃথিবীর প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই রাজ্যে ১৯৫৭ সালে ও ১৯৬৭ সালে। সেই সময়টাকেই ধারন করেছে “দি গড অব স্মল থিংস”। ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে ব্যতিক্রম হলেও, এটি বর্ণবাদ, জাতিভেদ, সন্ত্রাস ও প্রশাসনিক দূর্নীতিকে এড়িয়ে যেতে পারেন নি। পৃথিবীর অন্য এলাকার খৃষ্টধর্মের সাথে এর মিল নেই, মিল নেই বামপন্থার সাথেও। যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণেরা খৃষ্টধর্ম গ্রহন করেছিলেন, তাঁরা নিজেদেরকে সমাজের প্রভুই বানিয়ে রাখেন।
বর্ণবাদ, জাতিভেদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে যে ছোট জাতের মানুষগুলো খৃষ্টধর্মের পদতলে আশ্রয় খুঁজে ছিল, তাঁরাও নতুন ধর্মে এসে অচ্ছুৎই থেকে যায়। সাম্যবাদ, মার্কসবাদের লালপতাকা উপরে তুলে ধরে যে উচ্চবর্ণের কমরেডরা ক্ষমতার সাধ পায়, তাঁদের বাড়িতেও অচ্ছুৎ থেকে যায় নিম্নবর্ণের এই কমরেডরা। তাই আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে সশস্ত্র নকশালবাদী বামপন্থী আন্দোলন।
আম্মু এইমেনেমের এক প্রভাবশালী সিরিয় খ্রিষ্টান ইপে পরিবারের মেয়ে। তাঁর পিতা পাপাচি (শ্রী বেনান জন ইপে) ব্রিটিশরাজের অধীনে দিল্লীতে ‘রাজকীয় পতঙ্গবিদ’ হিসেবে কাজ করে অবসরে যান, দাদা পুণ্যান কুঞ্জু (রেভারেন্ড ই. জন ইপে) সিরিয় খৃষ্ট সম্প্রদায়ের মাঝে খুব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন, বড়ভাই চাকো ছিলেন অক্সফোর্ডের নামকরা বিদ্বান।
এইমেনেমে তাঁদের ছোটখাটো জমিদারী ছিল, ছিল ‘প্যারাডাইস পিকলস অ্যান্ড প্রিজার্ভস’ নামে একটি আচার কারখানা। আচার কারখানাটি প্রথমদিকে তাঁর মা মামাচি (সোশাম্মা ইপে) চালালেও, পাপাচি মারা যাওয়ার পর এটি চাকোই দেখাশুনা করতে থাকেন। তাঁদের পরিবারে আরেক সদস্য বেবী কোচাম্মা (নবমী ইপে), আম্মুর ফুপু। বেবী কোচাম্মা দাদা রেভারেন্ড ইপের খুব আদরের মেয়ে ছিলেন। বেবী কোচাম্মা যখন আঠার বছরের, তিনি ভালোবাসেন এক সুদর্শন আইরিশ যাজক, ফাদার মুলিগানকে।
কাজ দিয়ে তাঁকে মাদ্রাজ থেকে কেরালায় পাঠানো হয়েছিল। সপ্তাহে একদিন ধর্ম বিষয়ে রেভারেন্ড ইপের সাথে আলোচনা করতে ফাদার মুলিগ্যান আসতেন তাঁদের বাড়িতে। ফাদার মাদ্রাজে ফিরে গেলে, বেবী কোচাম্মা তাঁর পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রোমান ক্যাথলিক হলেন। তিনি ভ্যাটিকানের বিশেষ অনুগ্রহে মাদ্রাজের এক কনভেন্টে শিক্ষানবীশ হিসাবে শপথও নেন। তাঁর ধারনা ছিল, এতে তিনি ফাদারের কাছাকাছি থাকতে পারবেন।
কিন্তু বাস্তবে বেবী কোচাম্মার ফাদারের ভালোবাসা আর পাওয়া হয় নি। ফাদার মুলিগান পরে হিন্দু ধর্মে দিক্ষিত হন এবং ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। বেবী কোচাম্মা পরে কুমারী থেকে যান।
পাপাচি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে যে বছর দিল্লি থেকে এইমেনেমে ফিরে আসেন, সে বছর আম্মু সবে মাত্র তাঁর স্কুলের পড়া শেষ করেছেন। পাপাচি মনে করত, কলেজে মেয়েদের পড়া অপ্রোজনীয় ও বাজে খরচ।
তাই আম্মুকেও পরিবারের সাথে এইমেনেমে চলে যেতে হল। তখনকার দিনে এইমেনেমের ছোট মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাবের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় ছিল। আম্মু দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবার তেমন সঙ্গতি না থাকায় যৌতুকের মাত্রাও ছিল কম। দুবছর কেটে গেল, কোনো বিয়ের প্রস্তাব এল না। এভাবেই আঠার বছরের জন্মদিন পার হয়ে গেল।
কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁর বাবা মায়ের মাঝে কোনো তোড়জোর ছিল না। আম্মু ভিতরে ভিতরে বিয়ের জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠে। সারা দিন তাঁর মাথায় ঘুরত এইমেনেমে তাঁর বদ মেজাজী বাবার কাছ থেকে পালানোর কষ্ট কল্পনা। পাপাচি তাঁকে গরমের ছুটিটা কলকাতায় এক দূর সম্পর্কের ফুপুর কাছে কাটানোর অনুমতি দিলেন। সেখানে একজনের বৌভাতের অনুষ্ঠানে আম্মু তাঁর ভবিষ্যৎ স্বামীকে পছন্দ করেছিলেন।
ভদ্রলোক আসামের এক চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের চাকরি করত। তাঁর পরিবার ছিল বিত্তশালী জমিদার। সে দেখতে বেটেখাটো হলেও, সুঠাম ও সুদর্শন ছিলেন। তবে মদ্যপান করে সব সময় মাতাল হয়ে থাকতো। ছুটি কাটাতে কোলকাতায় এসেছিলেন।
পরিচয়ের মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই সে আম্মুকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। আম্মু তাঁকে ভালোবাসার ভান করে নি, সে শুধু তাঁর চারপাশের অস্থির, অনিশ্চিত, পাথুরে সময়ের কাছে থেকে মুক্তি চাইছিল। আম্মু যেন ছিল একটা খালি চেয়ার, আর ভদ্রলোক সেখানে বসে পড়লেন। আম্মু ভেবেছিলেন, এইমেনেমে ফিরে যাওয়ার চেয়ে অন্য যে কোনো কিছুই তাঁর জন্য ভালো হবে। আম্মু তাঁর মা-বাবাকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন, কিন্তু তাঁরা উত্তর দেবার প্রয়োজনও মনে করেন নি।
অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে আম্মুর বিয়ে হল। আম্মু শ্বশুর ছিলেন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান, কেম্রিজ বক্সিংএ ব্লু পদকপ্রাপ্ত, দি বেঙ্গল এমেচার বক্সিং এসোসিয়েশনের সচিব। তিনি নব দম্পতিকে অনেক গয়না আর উপহারের সাথে, গোলাপী রঙের সুন্দর একটি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। বিয়ের পর আম্মু তাঁর স্বামীর সাথে আসামে চলে এলেন।
১৯৬৭ সালের অক্টোবরে চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ লেগে গেল।
আম্মু তখন আট মাসের গর্ভবতী। নভেম্বরে এক দিন আম্মুর প্রসব বেদনা উঠল। আম্মু তাঁর স্বামীকে নিয়ে শিলঙের পথে রওনা দিলেন। বাসে অসংখ্য যাত্রীর চাপাচাপি। গর্ভবতী আম্মুকে দেখে গরিব সহযাত্রীদের একটু দয়া হল।
তাঁরা একটু বসার যায়গা পেল। বাসের প্রচন্ড ঝাঁকুনির তীব্র ব্যথা তাঁকে দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হয়েছে। সারা পথ আম্মুর পেট চেপে রেখেছিল তাঁর স্বামী। লোকজন বলাবলি করছিল, চীন ভারতকে দখল করে নিয়েছে। হাসপাতালের সব বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে মোম বাতি জ্বালানো হয়েছিল, জানালাগুলো পর্যন্ত অন্ধকার করে দেয়া হয়েছিল।
এরকম অস্থির সময়ে এস্থা আর রাহেলের জন্ম। এস্থার জন্মের আঠার মিনিট পরে রাহেলের জন্ম। আম্মু ভয়ে ভয়ে ওদের দেখল, ওরা কোনো অঙ্গ বিকৃতি নিয়ে জন্মেছে কিনা। আম্মু গুনে দেখল চারটে চোখ, চারটে কান, দুটো মুখ, দুটো নাক, বিশটা আঙুল আর বিশটা নিঁখুত নখ। আম্মুর ভয় কাটল, তারপর চোখ বুজে এল অবসাদে ক্লান্তিতে।
আম্মু অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। পিঠখোলা কালো ব্লাউজ পড়তেন। সোনালী রঙের শিকল লাগানো ভ্যানিটি ব্যাগ সাথে রাখতেন। লম্বা সিগারেটের পাইপে টান দিয়ে ঠোঁট গোল করে ধোঁয়ার বৃত্ত বের করতে শিখেছিলেন। সে চা-বাগানের মালিকদের ক্লাবে বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠলেন।
সাদা চামড়ার মালিকেরা এর আগেই শ্রমিকদের ভিতরে সাদা চামড়ার ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে চলেছিলেন, এবার নজর পড়ল কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের দিকে। চা বাগানের মালিক আম্মুর স্বামীকে ছাঁটাইয়ের হুমকী দিয়ে আম্মুর সেবা পেতে চাইলেন। আম্মু শুনে হতবাক হয়ে কথা হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মদ্যপ স্বামী নীরবতা দেখে প্রথমে অস্বস্তিতে ভুগলেও, পরে ভয়ানক রেগে তাঁর চুলের মুঠি ধরে কিল ঘুসি মেরে অজ্ঞান হয়ে যান। আম্মুও বইয়ের তাক থেকে সবচেয়ে ভারি বইটি নামিয়ে তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে স্বামীর মাথায়, পায়ে, ঘাড়ে, পিঠে আঘাত করেন।
পরবর্তীতে এটা একটা রুটিনমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। মাতলামী আর মারামারি। আম্মু তেতো বিরক্ত হয়ে উঠলেন। যখন স্বামীর মারামারি স্ত্রী থেকে সন্তান পর্যন্ত গড়াল তখন আম্মু স্বামীকে ছেড়ে অনাহূতের মতো এইমেনেমে মা-বাবার কাছে ফিরে এলেন। সেখানেই সে ফিরলেন যেখান থেকে কয়েক বছর আগে সে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
শুধু পার্থক্য এই যে এখন তাঁর দুটো জমজ সন্তান। তাঁর আর কোনো স্বপ্ন নেই।
আম্মুর কাছে তাঁর জমজ সন্তান ছিল একজোড়া আশ্চর্য ব্যাঙের মতো। যারা একজন আরেক জনের ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল। রাহেল আর এস্থাও নিজেদের অভিন্ন ভাবত।
ভাবত, দুজনে মিলে তারা একজন। দুজনের শরীর দুটো হলেও পরিচয় এক। এস্থা রাতে যে স্বপ্ন দেখত, রাহেল সকালে তা শুনে এমনভাবে হাসত যেন স্বপ্নটা সেই দেখেছে। দুই জমজের মধ্যে মাঝে মাঝে খুনসুটিও হত। এস্থা মামাচির আচার কারখানায় সাহায্য করতে যেত মাঝে মাঝে।
সে একদিন আচারের কালো কড়াইয়ে লাঠি দিয়ে খেলার ছলে নৌকা বাইছিল। এমন সময় রাহেল সেখানে উঁকি দিল।
“এস্থা না তাঁকিয়েই বলল - কী চাস?
রাহেল বলল – কিছু না।
- এখানে এলি কেন?
রাহেল উত্তর দিল না। হিংসুটে নীরবতা নিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রাহেল জিজ্ঞেস করল – জ্যামের মধ্যে নৌকা বাইছিস কেন?
এস্থা বলল – ভারত স্বাধীন দেশ।
কারো কিছু বলার ছিল না। ভারত ছিল স্বাধীন দেশ। ”
আম্মু এস্থাকে আচারের রেসিপি লিখে রাখার অনুমতিও দিয়েছিল। সে আম্মুর দেয়া তাঁর নোটখাতায় খুব সুন্দর করে মামাচির আচারের রেসিপি লিখে রাখত।
“কলার জ্যাম।
কলা চটকাও। পানি মেশাও, ঢেকে দাও, তারপর জ্বাল বাড়িয়ে দাও। যতক্ষণ না নরম হয় ফোটাও ততক্ষণ। হালকা কাপড়ে চিপে চিপে রস ছেঁকে নাও।
সমান মাপের চিনি মেপে পাশে রেখে দাও। রস জ্বাল দিতে থাকো বেগুনি রঙ হওয়া পর্যন্ত। রসটা অর্ধেক শুকিয়ে গেলে জ্বাল কমাও। গেলাটিন (পেকটিন) তৈরী করো এভাবে-
পরিমাণ ১ : ৫, অর্থাৎ - টেবিল চামচ পেকটিন : ২০ চা চামচ চিনি। ......জমাট বেঁধে আসা রসে পেকটিন মেশাও।
সামান্য কয়েক (পাঁচ / ছয় ) মিনিট জ্বাল দাও। জ্বাল বাড়িয়ে দাও চারিদিকে যেন আগুন ওঠে। চিনি মেশাও। জ্বাল দিতে থাক যতক্ষণ না চটচটে ভাব না আসে। ধীরে ধীরে ঠান্ডা করো।
আশা করি এ রান্নাটা করে আনন্দ পাবে। ”
এস্থা এলভিস প্রিসলির গান খুব ভালো বাসত। খুব সুন্দর করে তাঁর গান গাইতে পারত। একবার আম্মু, বেবী কোচাম্মা, রাহেল ও সে কোট্টাইমে (এইমেনেমের পাশে অবস্থিত কেরালার অন্যতম বড় শহর) সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সিনেমার মাঝখানে এলভিস প্রিসলির গান চলে আসায় সেও গেয়ে উঠল।
আশেপাশের দর্শকেরা বার বার অনুরোধ করে, ভয় দেখিয়েও তাকে থামাতো পারছিল না দেখে বাইরে চলে যেতে বলছিল। এস্থাও নিজেকে থামাতে পারছিল না দেখে, ভয়ে ভয়ে আম্মুকে বলল, আম্মু আমি বাইরে গিয়ে গানটা গেয়ে আসি। আম্মু বিরক্ত হয়ে বলল, তুই এত মানুষের সামনে আমাদের অপমান করলি! এরপর এস্থা সবাইকে ডিঙিয়ে বাইরে যেয়ে মন খুলে তার প্রিয় এলভিস প্রিসলির গান গেয়েছিল।
সোফি মল চাকো আর মার্গারেট কোচাম্মার মেয়ে। চাকো অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়ে মার্গারেটের প্রেমে পড়ে যায়।
ইংরেজ মহিলা মার্গারেটকে সে বিয়েও করে। চাকো ছিল অগোছালো ও অলস। তাই শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়েটা টিকে নি। মার্গারেট পরে চাকোকে ডিভোর্স দিয়ে জো নামে এক ইংরেজকে বিয়ে করেন। সোফি মল জো এর পরিবারেই বড় হতে থাকে, তাঁকেই আসল বাবা ভাবে, চাকো শুধুই তাঁর জন্মদাতা পিতা।
জো এক দুর্ঘটনায় মারা গেলে, মার্গারেট শোক কাটাতে সোফি মলকে নিয়ে এইমেনেমে আসেন চাকোর বাড়িতে। সোফি মলের তখন নয় বছর, আর জমজ ভাই-বোনদের সাত।
ভেলুথা এক নিম্নবর্ণের অচ্ছুৎ পারাভান। সে কেরালা কমুনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিল। ভালো কাঠের কাজ, যন্ত্রপাতির কাজ জানত সে।
সে নিজেকে কখনো অচ্ছুৎ ভাবতে পারে নি। সে দুই জমজ ভাইবোনের খুব ভালো বন্ধু ছিল, খেলার সাথী ছিল, এটা ওটা বানিয়ে দিত; মোটকথা ওদের বাবার অভাব পূরন করতে পেরেছিল। বিষয়টি আম্মুও বুঝতে পারে। আম্মু উচ্চবর্ণের সিরিয়ান খ্রিষ্টান হয়েও তাই ভেলুথার সাথে নিষিদ্ধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে। ভেলুথার বাবা বিষয়টি ধরতে পেরে খুব ভয় পেয়ে মামাচিকে জানিয়ে দেন।
মামাচি জানতে পেরে খুব রেগে যান। ভেলুথাকে ডেকে যাচ্ছেতাই ভাবে গালমন্দ করেন। সেখানে বেবী কোচাম্মাও উপস্থিত ছিলেন। বেবী কোচাম্মা বামপন্থীদের ঘৃণা করতেন। ইতোপূর্বে বামপন্থীদের এক মিছিলের মাঝখানে পড়ে গিয়ে লাল পতাকা নেড়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সেই মিছিলে ভেলুথাও ছিল। বেবী কোচাম্মার প্রতি ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকে সে অপমান হিসবেই দেখেছিল, এর জন্য মনে মনে ভেলুথাকেই দায়ী করেছিল। আজ শিকার হাতে পেয়ে তিনি উচিত শিক্ষা দেওয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। প্রথমেই আম্মুকে কৌশলে ঘরে বন্দী করে পুলিশের কাছে মামলা করতে ছুটে যান, ভেলুথা আম্মুকে ধর্ষণ করেছে।
আম্মু তাঁর জমজ দুই ছেলেমেয়েকে খুব ভালো বাসতেন।
ওদের নিষ্পাপ বড় বড় চোখের আকর্ষণ, অন্য মানুষকে ভালোবাসার ইচ্ছা যারা ওদেরকে ভালো বাসে না, এই ধরনের ভাবনাগুলো আম্মুকে খুব জ্বালতন করত, ওদের ধরে মারতে ইচ্ছে করত। ওদের বাবা চলে গেছে, সেই জানালাটা ওরা খুলে রেখেছে, অন্য কেউ আসবে বলে এবং এলে স্বাগতম জানাবে। তাঁর দুই জমজ নিষ্পাপ বাচ্চার প্রতি অসীম মায়া মমতা আর ভালোবাসা দেখে আম্মু ভেলুথার উপর দুর্বল হয়ে পড়ে। এর জন্যই আম্মুকে আজ লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। “আম্মু চিৎকার করে বলল – তোদের জন্য।
যদি তোরা না জন্মাতি, তবে আমার এখানে থাকতে হত না। এসবের কোনো কিছুই ঘটনা। আমি এখানে থাকতাম না। আমি মুক্ত থাকতে পারতাম। যেদিন তোরা জন্ম নিয়েছিলি আমার উচিত ছিল তোদের এতিমখানায় ফেলে আসা।
আমার ঘাড়ের উপর তোরা পাথরের মতো বোঝা। ..... আম্মু বলল – তোরা এখান থেকে চলে যা। তোরা চলে যেতে পারিস না। আমাকে একটু একা থাকতে দিতে পারিস না?
ওরা মায়ের কথা রেখেছিল। ”
এস্থা অনেক সময় অদ্ভুতভাবে বাস্তবটাকে উপলব্ধি করতে পারত।
“জ্যাম নাড়তে নাড়তে এস্থা ভাবল, দুটো ভাবনা – এক. যে কারো যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। দুই. যে-কোনো অবস্থার জন্য তৈরী থাকা ভালো। ” এস্থা তাই তার প্রিয় বোনটিকে নিয়ে পালাতে চাইল। যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। ওরা সোফি মলকে নিতে চাই নি, সেও গেল জোর করে।
তিনজন ছোট নৌকা নিয়ে ছোট শীনাচল নদী বেয়ে চলল। হঠাৎকরে স্রোতের টানে নৌকাটা উল্টে গিয়ে সোফি মল হারিয়ে গেল। পড়ে তার লাশ এক জেলে খুঁজে পেল।
ভেলুথা এইমেনেমের স্থানীয় বামপন্থী নেতা কমরেড পিল্লাইয়ের সাহায্য চেয়েছিল, বর্ণবাদী স্বার্থপর কমরেড তাঁকে কোনো সাহায্য করে নি। পরে ছয় জন পুলিশ, বর্ণপ্রথার রক্ষার ছয় যুবরাজ ভেলুথাকে নির্মমভাবে পিটুনি দিল দুই জমজ এস্থা আর রাহেলের সামনে।
বেবী কোচাম্মা এস্থা ও রাহেলকে ভেলুথার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বলল, সেই সোফি মলকে ডুবিয়ে হত্যা করেছে। এস্থা ও রাহেল প্রথমে মিথ্যে সাক্ষী দিতে রাজী হয় নি। বেবী কোচাম্মা ভয় দেখালো মিথ্যা সাক্ষী না দিলে, “তোদের জেলে যেতে হবে, তোদের জন্য তোদের মাকেও জেলে যেতে হবে, ভালো লাগবে? তোরা তোর মাকে ভালো বাসিস না?” সে রাত্রেই ভেলুথার মৃত্যু হল। মৃত্যুর আগে সে জেনে গেল সে ধর্ষণকারী, শিশু অপহরণকারী, শিশু হত্যাকারী। ভেলুথা ছিল দুই জমজ, আর তাদের মায়ের কাছে দেবতা।
ছোট মানুষের দেবতা, ছোট দেবতা। বড় দেবতারা যখন হিংসায় আক্রোশে ছোট দেবতাকে মারতে আসে, তখন ছোট দেবতা সাধারণ মানুষ হয়ে যায়, রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর সম্মান মর্যাদার আর বালাই থাকে না। দুই জমজ মনে করতে থাকে ভেলুথার মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী। ভেলুথারা স্মৃতি তাদেরকে ছিড়ে কুড়ে খায়।
আম্মু মনে করত, ভেলুথাকে সেই হত্যা করেছে।
সোফি মলের মৃত্যুর জন্য মার্গারেট কোচাম্মা এস্থাকে দায়ী করত, ওকে কাছে পেলেই চড় বসিয়ে দিত। চাকো আম্মুকে তার দুই জমজ সন্তান নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। আম্মু এস্থাকে তাঁর মাতাল বাবার কাছে পাঠিয়ে দিল। আট বছরের এস্থা।
আম্মু এস্থার যাওয়ার সময় নেক জামা কাপড়, ডাইরি, চিঠির ঠিকানা লেখা খাম দিয়ে এস্থার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। বিদায়ের সময় বলল, “তুই কথা দে আমাকে লিখবি। তুই কথা দে, কখনো রাহেলকে ভুলে যাবি না, রাহেলকে ছেড়ে কোথাও যাবি না। .... আমি একটি ভালো চাকরি পেলে তোকে আবার নিয়ে আসবো। আমরা একটি স্কুল খুলবো।
সেই স্কুলে তোরা পড়বি। ” এস্থার সাথে আম্মুর আর কখনো দেখা হয় নি। আম্মু চাকরি খুঁজতে গিয়ে এক সস্তা হোটেলে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। আম্মু তখন সারাক্ষন কাশত, বমি করত। রাহেল আম্মুকে তখন এই অবস্থার জন্য ঘৃণা করত।
আম্মুর অন্ত্যষ্টিকৃয়ার জন্য কোনো পাদরী রাজী হয়নি। তাই আম্মুকে কোট্টাইমের এক শশ্বাণে নিয়ে পোড়াতে নিয়ে যায় চাকো আর রাহেল। পোড়ানো শেষ হলে ছাই সাথে করে নিয়ে আসে রাহেল, রশিদটি হারিয়ে যায়। এস্থা নেই, এস্থা থাকলে ঠিকই রশিদটি যত্ন করে রেখে দিত। টুকিটুকি সব জিনিস এস্থা গুছিয়ে যত্ন করে রাখে।
এস্থা বাবার কাছে ফিরে যাবার পর দ্রুত পালটে যেতে থাকে। নিজেকে চারপাশ থেকে গুটিয়ে নেয়। নিরব হয়ে যায়। কারো সাথে কথা বলত না। শুধু হেঁটে যেত একাকী, এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায়।
সে যেন হেঁটে যেত মহাকালের পথে....
আম্মু মারা যাবার পর চাকো আর মামাচি রাহেলকে পড়তে মিশনারী স্কুলের এক হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়। রাহেলকে নিয়ে চাকো বা মামাচির কোনো উদ্বেগ ছিল না। তারা ওর খোঁজ খবরও নিত না। অবশ্য মাস শেষে খরচের টাকাটা ঠিকমত পাঠাত। স্কুলের পড়া শেষ হলে, দিল্লির এক সস্তা আর্কিটেক কলেজে ভর্তি হয়।
সেখানে পিএইচডির এক আমেরিকান ছাত্র ল্যারি ম্যাককাস্লিনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। রাহেল তাঁর জীবন সম্পর্কে ছিল উদাসীন, তার চোখটা ছিল অন্য রকম সুন্দর, সেখানে ছিল রাজ্যের মায়া আর বিষাদ। ল্যারি রাহেলের চোখের প্রেমে পড়ে যায়। ওরা বিয়ে করে, আমেরিকা চলে যায়। কিছুদিন পর ল্যারির মোহ কেটে গেলে বিয়ে ভেঙে যায়, রাহেল আবার একা হয়ে যায়।
তেইশ বছর পর এস্থা আবার এইমেনেমে ফিরে এসেছে। এস্থার বাবা নতুন চাকরি পেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। এস্থাকে নেওয়া সম্ভব হয়নি, তাই এস্থা এইমেনেমে ফিরে এসেছে। এস্থা এইমেনেমে ফিরে এলে বেবী কোচাম্মা রাহেলকে চিঠি লিখে জানায় ও ফিরে এসেছে। রাহেল ভাইকে দেখার জন্য আমেরিকা থেকে এইমেনেমে ফিরে আসে।
ওদের চোখাচোখি হয়। কেউ কথা বলে না। ওদের বয়স এখন একত্রিশ বছর। আম্মু একত্রিশ বছর বয়সেই মারা গিয়েছিল। একত্রিশ বছর খুব কমও নয়, বেশিও নয়।
কিন্তু মৃত্যুর জন্য বয়সটা যথেষ্ট।
বইটি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।
********************************
এক নজরেঃ
The God of Small Things By Arundhati Roy
পেপার ব্যাক ও শক্ত মলাটে বাঁধাইঃ ৩৩৬ পৃষ্টা
প্রকাশকঃ Harper Perennial; First Edition edition (৬ মে, ১৯৯৮)
মূল্যঃ $৩.৫০
ধরনঃ উপন্যাস
ভাষাঃ ইংরেজী
আইএসবিএন - 10: 0060977493
আইএসবিএন - 13: 978-0060977498
********************************
লেখক পরিচিতিঃ
ভারতের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী, বুকার জয়ী ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায় ভারতের মেঘালয়ের শিলঙে ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর মা ছিলেন কেরালার এক সিরিয়ান খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে মেরি রায়, বাবা ছিলেন বাঙালি, শিলঙে চা-বাগানের কর্মকর্তা রঞ্জিত রায়। অরুন্ধতি রায় তাঁর ছেলেবেলা কাটিয়েছে কেরালার এইমেনেমে, কোট্টাইমের করপাস ক্রিস্টি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন।
এরপর, দিল্লির স্কুল অব প্ল্যানিং এন্ড আর্কিটেকচারে স্থাপত্যবিদ্যার উপর শিক্ষা নেন। ১৯৮৪ সালে ফিল্ম মেকার প্রদীপ ক্রিশেনের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর এক মাত্র উপন্যাস “দি গড অব স্মল থিংস” এর জন্য ১৯৯৭ সালে বুকার পুরস্কার পান। তিনি ২০০৪ সালে সিডনী শান্তি পুরস্কার পান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।