আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ তুমি বিস্মৃত

চার বছর পরে আজ এত বিশাল করে কেন আমি এই শোকগাঁথা লিখতে বসেছি? কারণ যাদের আদিষ্টকালে তোমাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল আজ তাদেরও সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে কিন্তু আজও জানা হয়ে ওঠেনি কেন তোমাকে বিনা অপরাধে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সবকিছু বিস্তারিতভাবে লিখতেও ভয় পাচ্ছি। কারণ আজ তোমার হত্যার বিচার চাওয়াটা যেন চলমান ঘটনাকে অন্য দিকে প্রবাহিত করার মত গর্হিত অপরাধ। কিন্তু আমি তো সবসময়ই তোমার নির্মম হত্যার বিচার চেয়ে এসেছি। দেশমাতৃকার নিরাপত্তায় তুমিও তো সীমান্তে কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছ; কিন্তু তবুও জাতির কাছে আজ তুমি পুরোটাই বিস্মৃত।

আজ তোমাকে স্মরণ করা হয় ওবিচুয়ারি কলামে চার ইঞ্চির এক বিজ্ঞাপন দিয়ে। আজ সীমান্তে লাশের পরে লাশ তন্দুরি মুরগীর মত ঝুলছে, কিন্তু সবাই মুখে তালা লাগিয়ে আছে কারণ তোমার মত অকুতোভয় বীর সেনানী একজনও নেই যে প্রভাবশালীর রাঙা চোখকে অবজ্ঞা করে দেশের মানচিত্র অক্ষুণ্ণ রাখবে। আজ তোমাকে অনেক মিস করছি বলে আবেগের বন্যা বইয়ে দিতে চাচ্ছিনা কারণ শুধু আজকে নয়, বিগত ১৪৬০ দিনের প্রতিটা মুহূর্তেই তোমার অনুপস্থিতি আমার জীবনটাকে অনেক বিন্দুতেই থামিয়ে রেখেছে। ২৫শে ফেব্রুয়ারির সেই সকালটাকে আজও আমি ভুলতে পারিনা। শেষ যে কথাটা হয়েছিল তোমার সাথে তাও খুব আহামরি কিছুই ছিল না।

একটিবারের জন্যও মনে হয়নি আর কখনো তোমার সাথে কথা হবেনা। গোলাগুলির খবর শোনার পরও ভাবিনি এরকম এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবে। তারপরও যদি তোমার সাধারণ মানুষের মত তোমার লাশটা পাওয়া যেত, তাও কিছুটা সান্ত্বনা থক্ত। মৃত্যুর পরেও তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। নর্দমা থেকে যখন তোমাকে টেনে বের করা হল, তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, হায়রে আমার দেশ এভাবেই তুমি তোমার বীরদের মর্যাদা দাও, এভাবেই আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেল তোমার সূর্যসন্তানদের।

তোমার লাশ আগুনে পোড়াতে যারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি, আজ তাদের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কোথায় থাকে এই মানবাধিকার যখন সেই দিনের সত্যি কথাগুলো জনসমক্ষে বলা থেকে আমাদের বিরত রাখা হয়। কোথায় লুকায় মানবাধিকার যখন নির্মম হত্যার ন্যায়বিচার চাইলে আমাদের দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়। প্রতি বছর এই দিনটি আসার আগে তড়িঘড়ি করে কিছু রায় দেওয়া হবে যেন তারা বলতে পারে আমরা রায় দিয়েছি। এরকম প্রহসনের রায়ই কি আমরা চেয়েছিলাম? আজ একবারও বলতে পারি না, ভাইয়া কেমন আছ? তুমিও ফোন করে জিজ্ঞেস কর না, আমার পড়ালেখা কেমন চলছে।

ওই বছর আমাদের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া হয়ে ওঠেনি আর, আজও পাসপোর্টটা দেখি আর ভাবি, এক মুহূর্তেই জীবন কেমন পাল্টে যায়। তুমি তো কখনো তোমার সোলজারদের সাথে খারাপ আচরণ করনি। উপরন্তু তাদের বিপদের সময়ে সহায় ছিলে। সেই তারাই তোমাকে কি নির্দয়ভাবে মেরে ফেলল।

এমন অভাগা দেশে জন্মিয়েছিলে তুমি যে তোমার করুণ মৃত্যু নিয়েও আজ নিত্যনতুন রাজনীতি হয়। একপক্ষ বলে এইটা নিছকই বিদ্রোহের ফল আর অন্যপক্ষ বলে এইটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু কেউ একটিবারের জন্যও বলে না এরুপ কালো অধ্যায়ের জন্য তারা লজ্জিত, অনুতপ্ত। কেউ একবারও স্বীকার করতে চায় না, এটি কেবলই বিদ্রোহ নয় কিংবা কোন রাজনৈতিক চালও নয়। দেশের সার্বভৌমত্বের উপর এত বড় আঘাতের পরেও তারা ঘটনাকে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি দিয়েই থামিয়ে রেখেছে।

এই সময় এসব বিষয় নিয়ে কথা বলাও হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কারণ ওইদিনের পর থেকে পরিবারের সদস্যদের জনসমক্ষে মুখ খোলার ব্যাপারে যেমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, তেমনি অনেককে বাইরেও পুনর্বাসন করা হয়েছিল যেন সত্যগুলো অপ্রকাশিতই থাকে। প্রতি বছর এই দিনটিতে বাসায় মিডিয়ার কিছু কর্মী আসে গৎবাঁধা কিছু প্রশ্ন নিয়ে যার উত্তরও তারা নিজেরাই সাজিয়ে নিয়ে আসে। শুধুমাত্র শোকার্ত মানুষদের তাতে কিছু আবেগ ঢালতে বলা হয় আর সবশেষে দুফোঁটা অশ্রুর সাথে বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে তারা তাদের মহান (!) কর্ম সম্পাদন করে। আজ তোমাদের নামে তাই কোন স্মৃতিস্তম্ভও হয়নি, করা হয়নি ২৫শে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে ২ ঘণ্টার কয়েকটা মোমবাতির আলোতেই তাই তোমার স্মৃতি আজ ম্রিয়মাণ। দেশের সত্যিকারের বীরদের যারা সম্মান দিতে জানে না, তাদের কাছে ন্যায্য দাবি নিয়ে তাই আর কখনো ছুটে যেতেও মন চায় না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।