কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!!
২৮
তারস্বরে অ্যালার্ম বাজছে সিমুলেশনের সর্বত্র। প্রতিযোগীদের অনেকেই জাগিয়ে তোলা হয়েছে।
হুড়মুড় করে যত্রতত্র দৌড়াচ্ছে সবাই। নিশু সবাইকে গাইড করে নিয়ে যাচ্ছে পরাবাস্তবে দেখা সেই এক্সিটের দিকে।
এক্সিটের সামনে গিয়ে নিশু দেখল, গেটের সামনে একটা পর্দা।
পর্দাটা তুলল সে।
অবাক হয়ে তারা সবাই দেখল, ওখানে কোন এক্সিট নেই। নিরেট দেওয়াল।
***
উল্টোদিকে দৌড়াচ্ছে নিশুরা। তারা জানে না কোথায় যেতে হবে।
তারা শুধু জানে পালাতে হবে।
হঠাৎ পানির প্রচণ্ড তোড়ে ভেঙ্গে পড়ল নিশুর পাশের দেয়াল। পানির ধাক্কায় ছিটকে গেল নিশু। অপর দেয়ালের একটা কিছু ধরে প্রাণপনে দাঁড়িয়ে থাকল সে।
পানির তোড়টা একটু কমতেই সে দেখল, ভাঙ্গা দেয়ালের মধ্যে বড় একটা কাঁচের ঘর দেখা যাচ্ছে।
সেই কাঁচের ঘরের মধ্যে কেউ একজন শুয়ে আছে।
নিশু অনেক কষ্টে সেই কাঁচের ঘরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হল। সে দেখল, ভিতরে একজন মানুষ, তার সারা শরীর কৃশকায়, শুধু মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে বড়। মুখে ব্যান্ডেজ। মাথার পিছনে ঢুকানো আছে ইন্টারফেস।
নিশু দেখল, তার আশে পাশে আরো বেশ কয়েকটা ইন্টারফেস। তারই একটা চটপট মাথার পিছন দিয়ে ঢুকিয়ে দিল নিশু।
হঠাৎ জগতটা অন্ধকার হয়ে এল তার।
***
“নিশু, ওঠ। ওঠ, নিশু”।
নিশু চোখ মেলে তাকাল। সে একটা সাগরের পাড়ে বসে আছে। তার পাশে দাঁড়ানো এক সুদর্শন তরুণ।
তরুণ বলল, “তুমি পালাও নি? ”
নিশু বলল, “পালাচ্ছি। কিন্তু আমি একা যাব না, তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব”।
“এটা সম্ভব নয়। আমার শরীর বলতে এখন কিছুই নেই”।
“মানে? ”
“আমার মগজ স্টেম সেল গ্রহণ করেছে। ওরা প্ল্যান করেছে নিউক্লিযার ব্যাটারি দিয়ে আমার শুধু মস্তিষ্কটাকে বাঁচিয়ে রাখবে, বাকি শরীরটাকে মেরে ফেলবে। আমার শরীরের সাথে ইতোমধ্যে নিউক্লিয়ার ব্যাটারি সংযুক্ত হয়েছে”।
“আমি তোমাকে নিয়ে যাব”।
“পারবে না। আমাকে যেভাবে রাখা হয়েছে তাতে পারমাণবিক বোমা মারলেও কিছুই হবে না”।
“কিন্তু...........তুমি........”
“আমি এখানেই থাকব। এই সাগরতীরের পরাবাস্তব জগতটা আমিই ডিজাইন করেছি।
এখানে থাকতে আমার কোন সমস্যা হবে না। আর রাকিবিল হাসানাতের প্রতি কি তুমি দুর্বল? লাভ নেই। আসল রাকিবিল হাসানাতকে ওরা আগেই মেরে ফেলেছে। তোমার সামনে যে রাকিবিল হাসানাত আসত সে আসলে আমার তৈরি একটা হলোগ্রাফিক প্রোগ্রাম। ঐ প্রোগ্রামের চেহারা যেরকম ইচ্ছা সেরকম রাখা যায়, শুধু তোমার পূর্বপরিচিত হবে ভেবে আমি রাকিবিল হাসানাতের চেহারাটা প্রোগ্রামে ডিফল্ট হিসেবে সেট করি।
আমি একসময় সব ভুলে যেতে শুরু করেছিলাম, তখন ও-ই আমাকে সব মনে করিয়ে দিত।
যাও, আর দেরি করো না। আর হ্যাঁ, তোমার হাজবেন্ডের সাথে যে বাসায় তুমি থাকতে সেটার মাস্টার বেডরুমের অ্যাটাচড টয়লেটের বেসিনের নিচে একটা চিঠি টেপ মারা অবস্থায় আছে। ওটা পড়ো”।
নিশু প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল, “এতকিছু তুমি জানলে কিভাবে? কে তুমি? ”
“যাও”, যুবক বলল, “আর দেরি কোর না”।
“আর তুমি? তুমি কি সারাজীবন এখানেই থাকবে? ”
“যতদিন না কেউ আমাকে উদ্ধার করে, এখানেই থাকব। যাও”।
“শুধু একটা কথা বল, তুমি আমাকে হেল্প করলে কেন? ”
যুবক এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে হঠাৎ করে শক্ত হাতে নিশুর গলা টিপে ধরল। প্রবল আতঙ্কের সাথে মারা গেল নিশু।
***
জেগে উঠল নিশু।
ঘ্যাঁচ করে ইন্টারফেস খুলে ফেলল সে।
পানি আসছে। প্রবল বেগে।
পানির ধাক্কায় দূরে সরে যাবার আগে হঠাৎ কৃশকায় মানুষটা, যার নাম দেয়া হয়েছে দ্যা শ্যাডো, যে কিনা কোন এক ভাবে তাকে সিমুলেশনের জায়গায় অন্য একটা প্রোগ্রামের মধ্যে লোড করে দিয়ে পালানোর কথা বলেছে, চেষ্টা করেছে পালানোর পথগুলো বাতলে দেবার, এর জন্য গভীর মমতা অনুভব করতে লাগল নিশু। যাবার আগে ওর ইন্টারফেসটা খুলে দিতে গিয়েও খুলল না সে।
থাক, এই ক্লেদাক্ত পৃথিবীতে নয়, দ্যা শ্যাডো বেঁচে থাক তারই সৃষ্ট পৃথিবীতে।
২৯
নিশু বসে আছে একটা ওপেন ওয়ার রেস্টুরেন্টে। সে একটা পত্রিকা পড়ছে। পত্রিকায় হেডলাইন এসেছে-
“অবশেষে ধরা পড়ল সিমুলেশন। শেষ হল অমানবিকতার এক পৈশাচিক অধ্যায়।
”
নিশু পড়া শুরু করল।
“সিমুলেশন। মানবতার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ...”
“...ইন্টারপোল অফিসার ডেভিড সিমকক্সের তত্ত্বাবধানে সফল একটি অভিযানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় সিমুলেশন হেডকোয়ার্টারস। এর জন্য ইন্টারপোলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
...
...পরাবাস্তবে যুক্ত হবার ইন্টারফেস তৈরী করে অসংখ্য মানুষের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিল সিমুলেশন। পরাবাস্তব মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে এটাই ছিল তাদের গবেষণার বিষয়। ...
...টাকা জোগাড় করার জন্য তারা বছরে একবার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং বাজির ব্যবস্থা করে। সেই বাজির টাকার সাথে ডোনারদের টাকা মিলে উঠে আসে তাদের সব খরচ। বছরের বাকি সময়টা এরা পরাবাস্তব সংক্রান্ত নানাবিধ এক্সপেরিমেন্ট করে কাটায় এবং গিনিপিগ বানায় অসহায় মানুষদের।
যারা একবার ওখানে যায় তারা আর ফিরে আসে না। ...
...শোনা যায়, গিনিপিগ মানুষদের মস্তিষ্কের ক্ষয়ে যাওয়া স্নায়ু কোষ পুনরুদ্ধারের জন্য তারা বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে নিউইয়র্কের স্টেম সেল রিসার্চ ল্যাবের সহকারী বিজ্ঞানী সুকুমা কাবোদাচোকে হাত করে। কাবোদাচোর সহায়তায় তারা স্টেম সেলগুলো নিজেদের কব্জায় নিয়ে নার্ভাস ডিজানারেশনের প্রতিযোগীদের মস্তিষ্কে ঢুকায় এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুষ্ঠিত করে........
...সিমুলেশন হেডকোয়ার্টার্সে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন প্রতিযোগী আর দর্শক ছাড়া আর কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। পুলিশ বলছে, গার্ডরা সব আগে থেকেই মরে পড়ে ছিল। হয়তো ধরা পরার সাথে সাথে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করাই বিধান ছিল তাদের।
...
...সিমুলেশন বিল্ডিং থেকে সিমকক্সের দলের এক অংশ বের হয়ে আসার পরপরই বিল্ডিং প্রবল শক্তিতে বিস্ফোরিত হয়। কয়েকজন পুলিশ সদস্য, দর্শক ও প্রতিযোগী বিল্ডিং এর ভিতরে থাকা অবস্থায়ই মারা যান। ...”
নিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ফোনে ব্লিপ করে একটা শব্দ হয়েছে।
নিশু মোবাইল বের করল।
একটা ই-মেইল এসেছে। বাংলাদেশে তার এক বান্ধবী বেসিনের নিচ থেকে টেপমারা চিঠিটা উদ্ধার করে ছবি তুলে ই-মেইল পাঠিয়েছে।
নিশু ফাইলটা ওপেন করল। চিঠিটা পুরোটা স্ক্যান করা হয়েছে। চমৎকার কাজ।
নিশু পড়তে শুরু করল।
“ডিয়ার নিশু,
এই চিঠি তুমি পড়ছ, তার মানে তুমি বেঁচে আছো এবং ভালোভাবেই বেঁচে আছো। তোমার মনে আছে আমরা কত সুখী ছিলাম? কত দারুণভাবে চলছিল আমাদের সংসার?
ঠিক এমন সময় আমার সমস্যাটা ধরা পড়ল। আমি সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করলাম। ডাক্তার বললেন এর কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয় নি।
মনে আছে?
তুমি কখনো জানতে না, আমি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রোগ্রামিং করতাম। সেই সূত্রে আমার পরিচয় হল সিমুলেশনের সাথে। ওদের অঢেল টাকা। ওরা আমায় বলল, ওরা আমাকে স্টেম সেল দেবে। তাতে করে আমার রোগের উপশম হবে।
আর বিনিময়ে ওদের দিতে হবে বাংলাদেশ থেকে ভালো দুজন প্রতিযোগী। দক্ষিণ এশিয়ায় নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে চায় তারা। সময় মাত্র তিন মাস।
তুমি চিন্তা কর, অন্য দেশে বছরের পর বছর সিমুলেশন কোচিং করে মানুষ চান্স পায় না, আর আমি মাত্র ছয় মাসে এরকম mentally rough and tough এবং বুদ্ধিমান মানুষ পাব কোথায়? যেখান সেখান থেকে যাকে তাকে ধরে আনলে তো হবে না। তখনই আমার মাথায় এল তোমার কথা।
তুমি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছ, মামার কাছে ধর্ষিত হয়েছ - তবু শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছ নিজের জোরে। Mentally strong হতে আর কি লাগে?
আমি ওদের বললাম তোমার কথা। শর্ত দিলাম, তোমার পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব ওদের নিতে হবে। ওরা বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেল।
কিন্তু তোমাকে একা ছাড়তে আমার মন চাইল না।
দ্বিতীয় প্রতিযোগী হিসেবে নিজের নাম প্রস্তাব করলাম আমি। ওরাই সব প্ল্যান করে দিল। আমি ইচ্ছা করে প্রেম করলাম ওদের ঠিক করা মেয়ের সাথে। তুমি খুন করলে অবিকল আমার মত স্কিন গ্রাফট নেয়া ওদেরই ঠিক করা একটা ছেলেকে আর ঐ মেয়েকে। স্কিন গ্রাফটটা অবশ্য সিমুলেশনেরই নতুন একটা প্রজেক্টের অংশ ছিল।
তোমার ফাঁসি হল, ওরাই তোমাকে মৃত্যুমুখ থেকে টেনে তুলে নিয়ে ওদের হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে গেল। আর তখনই এই চিঠিটা লিখে বেসিনের নিচে স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখলাম আমি। তারপর কিছুদিন পর আমাকেও ওখানে নিয়ে যাওয়া হল।
এখন পর্যন্ত শুনেছি তিনটা সিমুলেশনের তৃতীয়টা হবে আমারই করা প্রোগ্রাম। আমি চেষ্টা করব তিনটিতেই তোমাকে হেল্প করার।
হয়তো এরই মধ্যে তুমি তিনটা সিমুলেশনেই দেখেছ কোন না কোন প্রতিযোগী নিজেকে স্যাক্রিফাইস করে তোমাকে ফার্স্ট বানানোর চেষ্টা করছে। হয়তো ওটাই আমি।
নিশুর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে এখন জানে প্রথম সিমুলেশনে তার বুকে গুলি করে হার্টবিট শূণ্য করে দিয়েছিল কে। সে এখন জানে দ্বিতীয় সিমুলেশনে তার ডাটা ইরেজ না করে কেন নিজের ডাটা ডাটাবেস থেকে ইরেজ করেছিল দ্বিতীয় অ্যামান্ডা।
সে এখন জানে কার হস্তক্ষেপে তৃতীয় সিমুলেশনের বদলে অন্য একটা প্রোগ্রামে লোড হয়েছিল সে, যেখানে তাকে বলা হয়েছিল পালিয়ে যেতে…
“যদি চিঠির লোকেশন তুমি রাকিবিল হাসানাতের কাছ থেকে পেয়ে থাক, তাহলে হয়তো তোমার সাথে আমার দেখা হয় নি। আর যদি অন্য কেউ, সেটা এ পৃথিবীতেই হোক আর পরাবাস্তবেই হোক, তোমাকে বলে থাকে, তার মানে আমার সঙ্গে তোমার আবার দেখা হয়েছে”।
ইতি,
তোমার ...
নিশু চেয়ার থেকে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল। সে নিজ হাতে তার স্বামীকে পরাবাস্তবে চিরদিনের মত বন্দী করে রেখে এসেছে।
৩০
সাগরপাড়ে বসে আছে এক যুবক।
সাগরের ঢেউ তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে।
যুবক জানে, এই দৃশ্য হতে তার মুক্তি নেই। এই দৃশ্যে চিরদিনের যত আটকা পড়ে গেছে সে। তার বাস্তবের মস্তিষ্কের নিউক্লিয়ার ব্যাটারি কখনো ফুরোবে না। ফুরোবে না।
যুবক হাসল। বড় বিষন্ন সেই হাসি।
(বন্ধুরা, কেমন লাগলো? জানালে খুশি হব। সিজন ওয়ান শেষ হয়ে গেল এই এপিসোডের সাথে সাথে। যদি কোনদিন ইচ্ছা হয় তাহলে সিজন টু লেখার চিন্তা করা যাবে।
যারা দশ টা এপিসোড মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তাদের জন্য শুভকামনা। আপনাদের মত পাঠকরা আছে বলেই আমরা তেলাপোকা লেখকেরা টিকে আছি। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।