"বাউল মানুষ"
বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার কে? বছর দশেক আগেও এ প্রশ্নের উত্তরে একটা নামই উচ্চারিত হতো: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টেছে। দশ বছরে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে চীনসহ কয়েকটি দেশ তাদের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে, পণ্য উৎপাদন ও রফতানির পরিমাণ বাড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে সফলকামও হয়েছে তারা, বিশেষ করে চীন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি নিজ প্রচেষ্টায় উন্নয়নশীল দেশের সারি থেকে উন্নত দেশের কাতারে উঠে এসেছে। এমনকি আগামী বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার বলা হচ্ছে দেশটিকে। অনেকে অবশ্য এখনই চীনকে ঐ খেতাবে ভূষিত করতে শুরু করেছে। কিন্তু চীন সত্যিই কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে?- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা নিউজউইকে সমপ্রতি প্রকাশিত লোয়ানিস গাটসিওনিসের 'দ্যা চায়না ড্রিম' নামক প্রবন্ধে।
চীনের উত্থান বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
চীনকে শিরোনাম করে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও পত্রিকায় লেখা ছাপা হচ্ছে, সপ্তাহ অন্তর প্রকাশিত হচ্ছে অন্তত একটি করে বই। চীনের জয়গাঁথা বর্ণনাই এসব লেখার মূল বিষয়বস্তু। কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে আমেরিকার সাথে তুলনা করে চীনকে 'চাইমেরিকা' বলে সম্বোধন করছে। তাদের মতে অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকা নয়, চীনই এই পৃথিবীকে শাসন করবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো পত্রিকাও চীনের অর্থনৈতিক খবরকে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছে।
চীন নি:সন্দেহে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব রয়েছে, চীন এখনো তা অতিক্রম করতে পারে নি। ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিমাণ পুঁজি খাটছে, সে তুলনায় চীন অনেক পিছিয়ে। কিন্তু প্রচারের দিক দিয়ে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কোনো দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা সহায়তার খবর অথবা বিপুল পরিমাণ কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে চীনের সাথে কারো চুক্তি সম্পাদনের খবর যতোটা ফলাও করে প্রচারিত হয়, একই পরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি আর্থিক সহায়তা বা আর্থিক চুক্তি করেও যুক্তরাষ্ট্র সেরকম প্রচার পাচ্ছে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন ও আমেরিকার আর্থিক বিনিয়োগ এবং আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হিসেব করে সেই সব দেশে এ দুটি রাষ্ট্রের কার কতবেশি প্রভাব রয়েছে, তা বলে দেয়া যায়। অবশ্য সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত হিসাব-নিকাশে চীন এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, এমনকি দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি জাপানকে গত মাসে টপকে গেলেও আমেরিকাকে এখনো ছুঁতে পারেনি।
গত কয়েক বছর যাবৎ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উলেস্নখযোগ্য হারে। তবুও এখনো আমেরিকা থেকে অনেক পিছিয়ে চীন।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার হচ্ছে চীন। যদিও এক্ষেত্রে মূলত খেলনা, কলম, কাপড়চোপড়ের মতো সস্তা পণ্যের ব্যবসার প্রতিই ঝোঁকটা বেশি। অন্যদিকে এশিয়ায় আমেরিকার ব্যবসা মূলত খাদ্যদ্রব্যকে ঘিরে, যেখানে বিশাল অংকের অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে।
এশিয়া, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকায় মানবিক সাহায্য প্রদান এবং এসব এলাকায় সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে। এসব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক প্রভাবও যথেষ্ট বেশি।
এ প্রসঙ্গে আফ্রিকান সাংবাদিক চার্লস ওনিয়াংগো-ওবু সমপ্রতি একটি পত্রিকায় লেখেন, "আমেরিকার শিক্ষা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি (গান-বাজনা ও হলিউডি ছবি), ব্যবসা ও খেলাধুলার প্রভাব আফ্রিকায় প্রচন্ড মাত্রায় রয়েছে, যা অতিক্রম করা চীনের পক্ষে সম্ভব নয়। চীন বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে, কিন্তু প্রধান শক্তি নয়।
আফ্রিকায় গত কয়েক বছর যাবৎ চীন ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। এই অঞ্চলের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে সহায়তা দিচ্ছে চীন। সস্তায় পণ্য উৎপাদন করে ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে আফ্রিকাকে সাহায্য করছে দেশটি।
ঋণের সাথে তারা পশ্চিমাদের মতো 'মানবাধিকার রক্ষার' শর্ত জুড়ে দিচ্ছে না। এসবের বিনিময়ে চীন পাচ্ছে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। এতকিছুর পরও চীন যুক্তরাষ্ট্রের পেছনেই পড়ে রয়েছে। আমেরিকা আজও আফ্রিকার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আফ্রিকার মোট বাণিজ্যের ১৫ শতাংশই সম্পাদিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, চীনের সাথে হয় মাত্র ১০ শতাংশ।
আফ্রিকা থেকে তেল আমদানির দিক দিয়েও চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেকখানি এগিয়ে। আফ্রিকার ৫টি দেশ থেকে উত্তোলিত তেলের ১৭ শতাংশ আমদানি করে থাকে চীন। আর নাইজেরিয়া, ঘানা ও উগান্ডাসহ তেলসমৃদ্ধ কয়েকটি দেশের উত্তোলিত খনিজ তেলের ২৯ শতাংশ আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। উলেস্নখিত তিনটি দেশের তেল ক্ষেত্রগুলোর প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদারও হচ্ছে শেলসহ পশ্চিমা বিভিন্ন কোম্পানি।
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অ্যাঙ্গোলা ও নাইজেরিয়ার সাথে চীনের ব্যবসায়িক লেনদেন বেশি।
২০০৬ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে চীন ও নাইজেরিয়ার মধ্যে ৭শ কোটি ডলারের ব্যবসা হয়। অথচ কেবল ২০০৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ৪২০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে নাইজেরিয়া। এখন ব্যবসা আরো বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের হিসেবে এ বছর নাইজেরিয়ায় আমেরিকার রফতানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ এবং সে দেশ থেকে খনিজ তেলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির পরিমাণও ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবিক এবং সামরিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেও চীনের চেয়ে আমেরিকা অনেক এগিয়ে।
অন্যদিকে জিম্বাবুয়ে ও সুদানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সমগ্র আফ্রিকায় চীনের সামরিক উপস্থিতি খুবই সামান্য এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে তো প্রায় নেই বললেই চলে। বরং চীনের সীমান্তের কাছেই এখন আমেরিকান সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুপার পাওয়ার হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্তই হচ্ছে সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি অর্জন করা এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষার নামে সামরিক কতর্ৃত্ব স্থাপন করা। এই শর্ত খুব ভালোভাবে পূরণ করছে আমেরিকা যা চীন এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। চীনের নিজ মহাদেশ খোদ এশিয়াতেই এখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে চীন ভীতি প্রকট হয়ে উঠছে।
আর এর সুযোগ নিচ্ছে আমেরিকা। গত মাসে হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রকে দাওয়াত করা হয়। এশিয়ার নিরাপত্তা বিষয়ক বৃহত্তম এই বৈঠকে চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং প্যারাসেল ও সপ্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের ওপর চীনা দাবির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনও ঐ দ্বীপগুলোর অংশবিশেষের দাবিদার। চীনের সাথে এশিয়ার ঐ দেশগুলোর বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা এই এলাকায় তার প্রভাব আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র-আসিয়ান দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছেন যা কয়েক মাসের মধ্যেই হবে। আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পূর্ব এশিয়া সম্মেলনেও যুক্তরাষ্ট্রকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকাতেই এত আয়োজন। ওয়াশিংটন সমপ্রতি লাওস ও কম্বোডিয়ায় মানবিক সাহায্য ও সামরিক সহায়তা প্রদান বৃদ্ধি করেছে এবং ঐ অঞ্চল দুটিকে কালো বাণিজ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে সে সব অঞ্চলে এবং সেইসঙ্গে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত জুলাইতে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী তো ঘোষণাই দিয়ে দিলেন যে, আমেরিকা আর ভিয়েতনাম অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে আগাচ্ছে।
তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে। তাদের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০২ সালে যেখানে ছিল ২শ' ৯১ কোটি ডলার, গত বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫শ' ৪০ কোটি ডলারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা সন্তোষজনক। গত এপ্রিলে দেশ দুটির মধ্যে একটি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার ফলে ইন্দোনেশিয়ায় আমেরিকার পুঁজি প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে এশিয়ার অর্থনীতিতে এখনো পর্যন্ত চীনা কতর্ৃত্ব বজায় রয়েছে।
২০০৮ সালে চীনের সাথে এশিয়ার অপরাপর দেশগুলোর যেখানে ২৩ হাজার ১শ' কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮০ কোটি ডলার। চীন মূলত সস্তায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে নানা পণ্য তৈরির পর সেগুলো বিভিন্ন দেশে রফতানি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশর্্ববর্তী ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে চীনের ব্যবসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে চীনকে তাদের বাণিজ্যিক অংশীদার করে নেয়। এছাড়া ভেনিজুয়েলা, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা এবং আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশিদার চীন।
তবে ল্যাটিন আমেরিকায় পুরো এশিয়ার মোট বাণিজ্যের পরিমাণ গত এক দশকে যেখানে ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে বৃদ্ধি পায় ১১৮ শতাংশ।
অর্থাৎ সার্বিক বিচারে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার এবং সম্ভবত আরো বহুদিন এ অবস্থান ধরে রাখতে পারবে দেশটি। আর অন্যদিকে চীনকে বড়জোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি বলা যেতে পারে, তার বেশি নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।