আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড় কোন পরিবর্তনই আপনাকে ভালো কিছু এনে দিতে পারে - অং সান সু চি


বার্মার গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সুচি মুক্ত হওয়ার পর প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিবিসির কাছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসির ওয়ার্ল্ড এ্যাফেয়ার্স এডিটর জন স্যামসন। প্রশ্ন: আমি জানি এটা খুব সাধারণ প্রশ্ন হবে, আমি এও জানি যে এই প্রশ্ন এরই মধ্যে আপনাকে অনেকেই করে ফেলেছে। তারপরও বলি, আমরা জানি আপনি ৬/৭ বছর নিজঘরে বন্দি ছিলেন। আপনি আপনার নিজ দেশের মানুষের কাছাকাছি যেতে পারছিলেন না।

এখন ঘর থেকে বের হয়ে নিজের মানুষগুলোর কাছাকাছি গিয়ে আপনার ভেতর কেমন অনভূত হচ্ছে? সু চি: আমি জানি এখন আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে এটা সত্য যে আমি সব সময় নিজেকে বন্দি মনে করিনি। আমি নিজেকে মুক্ত ভেবেছি। শুধুমাত্র ঘরের মধ্যে বন্দি করে আমাকে কেউ মুক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে আমার কাছে বই ছিল।

আমি তো নিজ ঘরেই ছিলাম। আমি বিবিসি শুনতে পেতাম। আমি ম্যাগাজিন ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়তে পারতাম। আমি গানও শুনতে পেতাম। আমি আমার পুরো বাড়িটিতে ঘুরতে পারতাম।

এই বিষয়গুলো তো আপনি জেলে-হাজতে পাবেন না। সুতরাং আমি যে মুক্ত নয় এটা আমি কখনই অনুভব করিনি । বরং আপনি বলতে পারেন যে আমি কিছু জিনিসপত্রের উপর নির্ভর ছিলাম। আগের সাথে বর্তমান সময়টার পার্থক্যটা আমি ঠিক এখনও বুঝতে পারছি না। এতো দ্রুত সবকিছু হয়ে যাচ্ছে যে আমি বুঝেই উঠতে পারছি না কি হচ্ছে।

প্রশ্ন: অনেক অনেক মানুষ আপনাকে দেখতে এসেছেন। সবাই আপনাকে একনজর দেখার জন্য পাগল হয়ে ছুটে আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। কেউ হাত মেলাতে চাচ্ছে। কেউ আপনাকে একটু ছুতে চাচ্ছে। কখনও কখনও একটু সাবধানতারও প্রয়োজন আছে।

আপনি জানেন, এতো কিছুর মাঝে কিছু ঘটে যদি যায়। সু চি: না না। এখানে সাবধানতার কিছু নেই। বরং এটা খুব আবেগপ্রবণ হওয়ার মতো। আমি গতরাতে বিবিসিকে বলেছিলাম, অনেক মানুষ আমার কাছে আসতে চাবে।

আমাকে শুভেচ্ছা জানাবে। তাদের মধ্যে অনেকেই খুব কঠিন সময় পার করেছে। এতো কঠিন সময়ের মাঝেও তারা খুব আনন্দিত। আমি মুক্ত তাই তারা এতো খুশি। এটা আমাকে আবেগপ্রবণ করে দেয়।

আমাকে ছুয়ে যায়। প্রশ্ন: এখন এই পর্ব শেষ। আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে দেখবো গত ৭ বছর কিংবা তারও আগে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ত্যাগ আছে। আপনার দুই সন্তান। তারা তাদের মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।

বিশেষ করে আপনার স্বামীর বিষয়টি। তিনি অনেক কঠিন সময় পার করেছেন। সু চি: আমি মনে করি না এখানে খুব একটা ত্যাগের কথা আছে। আমি মনে করি না। কিন্তু কিছু করার ছিল না।

আপনি যখন এতোগুলো মানুষের সামনে দাড়িয়ে তখন আপনি সব কি করবেন? আমার বিবেকই বলে দেয় আমার পরিবারের সাথে থাকা সম্ভব নয়। প্রশ্ন: কিন্তু আপনি কি মনে করেন না যে, আপনি দেশ ছাড়তে পারেননি কিছু শর্তের কারণে। এটা অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত ছিল। আপনার স্বামী মৃত্যুর সামনে কিন্তু তারপরও আপনি যাননি। সু চি: হ্যা।

এটা অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ও জানতো আমি এই ধরনেরই একটা সিদ্ধান্ত নেবো। এবং একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ও আমাকে সাপোর্ট করেছে। প্রশ্ন: আপনি মুক্ত হওয়ার পর আপনার ছোট ছেলের সাথে কথা বলেছেন। সু চি: হ্যা।

আমি আমার দুই ছেলের সাথেই কথা বলেছি। প্রশ্ন: ও আচ্ছা। আপনি দুজনের সাথেই কথা বলেছেন। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, সেটা হলো- মোবাইল ফোন নিয়ে। মোবাইল ফোন এখন সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে।

আপনার কেমন লেগেছে যখন এই ছোট্ট বস্তুটি আপনি দেখলেন। সু চি: সত্যি কথা বলতে কি- আমি একটু অবাকই হয়েছি। আমার বাড়ির গেটেই দেখলাম অনেক মানুষ ছোট্ট একটা বস্তু দিয়ে আমার ছবি তুলছে। এবং আমি খুব অবাক হলাম যে অধিকাংশের হাতেই মোবাইল ফোনটা আছে। এবং আমি প্রথম যখন আমার ছোট ছেলের সাথে ব্যাংকক-এ কথা বলছিলাম তখনই প্রথম আমি এই বস্তুটি ব্যবহার করলাম।

প্রশ্ন: আপনি এর আগে কখনও ব্যবহার করেননি?. সু চি: না না। আমি দেখেছি। আমার নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে দেখেছি। ম্যাগাজিনের বিভিন্ন ছবিতে আমি দেখেছি। কিন্তু কখনও ব্যবহার করা হয়নি।

আসলে আমার কাছে খুব অদ্ভুতই লেগেছে। এটা এতো ছোট আর এর কোন মাউথস্পিকার নাই। শুধুমাত্র কানের সাথে লাগিয়ে রাখা আর মুখের কাছাকাছি থাকলেই কথা বলা ও শোনা যাচ্ছে। ব্যপারটা খুবই চমৎকার। প্রশ্ন: কিন্তু আপনি কি জানতেন এটা দিয়ে ছবিও তোলা যায়? সু চি: হ্যা আমি জানতাম।

কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি এই দেখে যে এটা অনেকের কাছেই আছে। প্রশ্ন: এখন আমি একটু আক্রমনাত্বক প্রশ্ন করবো। হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিলে আপনার ক্ষতিও হতে পারে। তারপরও করি। আপনি কি চান সামরিক সরকারের পতন হোক? সু চি: না।

আমি চাই না তাদের পতন হোক। আমি এটা দেখতে চাই না যে আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর পতন হচ্ছে। আমি দেখতে চাই, আমাদের সেনাবাহিনীরা তাদের দেশপ্রেম দিয়ে অনেক উপরে উঠে আসছে। তাদের মূল কাজটাই তারা খুব সুন্দর মতো করবে। প্রশ্ন: এবং কি করবে? সু চি: এবং তারা তাই করবে যা এই দেশের জনগণ চায়।

এটাই স্বাভাবিক যে জনগণের মতই থাকতে হবে। জনগণ কি চায়? জনগণ অবশ্যই চায় সুন্দর জীবন। নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা। আমি অনেক মানুষের সাথেই কথা বললাম। তাদের আমি প্রশ্ন করেছি যে, তোমরা সবচাইতে বেশী কি চাও? কেউ কেউ বলেছে- আমি মুক্ত থাকতে চাই।

আবার কেউ বলেছে- আমি নিরাপত্তা চাই। কেউ বলেছে- অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা। সুতরাং আমরা দুইটা বিষয়েই একমত হয়েছি। এক. স্বাধীনতা এবং দুই. নিরাপত্তা। এবং আমি মনে করি কোন সমাজে এই দুইটি বিষয়েরই খুব প্রয়োজন।

আমাদের বার্মাতেও প্রয়োজন স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা। প্রশ্ন: কিন্তু এই প্রয়োজনগুলো কি সেনা সরকার পূর্ণ করতে পারবে কিংবা এটা কি সম্ভব? সু চি: আমি আশা করি আমাদের সেনাবাহিনী পদক্ষেপ নেবে। এবং তারাই প্রমাণ করে দেখাবে যে, আমাদের দেশেও নিরাপত্তা এবং স্বাধীন মতামতের ক্ষেত্র তৈরী করা সম্ভব। আমি তাদেরকে বলবো- তারা জনগণের হাতেই সব ছেড়ে দিক। কি ধরনের নিরাপত্তা এবং কি ধরনের স্বাধীনতার আমাদের বার্মাতে প্রয়োজন এটা জনগণই ঠিক করুক।

আমি মনে করি এতে তারাই নায়ক হয়ে যাবে। কেন না? এতে করে তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। এবং তারাই বার্মাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। প্রশ্ন: অনেক দেশেই এই ধরনের মুহূর্তে বিপ্লব হয়েছে। বার্মা কি ঠিক ঐ জায়গাতেই আছে যেখান থেকে তাদের বিপ্লবের প্রয়োজন আছে? সু চি: আমি যদিও চাই না যে সেনাবাহিনীর পতন এধরনের কোন বিপ্লবের মাঝে হোক।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের চেষ্টার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন: চেষ্টা মানে কি ধরনের চেষ্টা? সু চি: হ্যা। মানে আমি বিপ্লব শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না। এটাকে বলতে পারেন, নন ভায়োলেন্ট বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ ভাবে বিপ্লব ঘটানো।

কারণ, একটা বিরাট পরিবর্তন মানেই হলো বিপ্লব হয়ে যাওয়া। এটা এখন শান্তিপূর্ণভাবেও হতে পারে আবার শান্তিপূর্ণভাবে নাও হতে পারে। কিন্তু আমি চাই একটা শান্তিপূর্ণ বিপ্লব। প্রশ্ন: যদি আমি বলি আপনার এই শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ফলাফল আবার গৃহবন্দী হয়ে যাওয়া। তাহলে আপনি বিষয়টি কিভাবে নেবেন? সু চি: আমি জানি না আপনার কাছে বিপ্লবের মানে কি।

তবে আমার কাছে বিপ্লব মানে হলো একটা আমূল পরিবর্তন। অথবা দেখার মতো পরিবর্তন। বিপ্লব মানে হলো চমৎকার অসাধারণ পরিবর্তন। বড় কোন পরিবর্তনই আপনাকে ভালো কিছু এনে দিতে পারে। এটা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মধ্যে দিয়েও আসতে পারে।

---------------------------------------------------------- বঙ্গানুবাদ: শেরিফ আল সায়ার ২২ নভেম্বর, ২০১০
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।