আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

| অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব | পর্ব: ৩/৮ |

``চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল। ' -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
[ ডিসক্লেইমার: লেখার বিষয় সংবেদনশীল এবং কিঞ্চিৎ গবেষণাধর্মী। ইতঃপূর্বে এটি মুক্ত-মনা বাংলা ব্লগে সিরিজ আকারে আটটি পর্বে প্রকাশিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে ই-বুক আকারে সেখানে সংরক্ষিত হয়েছে। রিপোস্ট সিরিজ হলেও বিষয়বস্তুর কারণে আশা করি কারো বিরক্তির কারণ হবে না।

তাছাড়া পাঠক হিসেবে অনায়াসে এড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা তো রয়েছেই ! ] পর্ব-১ পর্ব-২ -এর পর..... ০২ মনুষ্য সমাজে সন্তান জন্ম নিলে তার একক পরিচিতির জন্যে একটি নামের প্রয়োজন হয়। অবশ্য পালনীয় বৈদিক বিধি মনুসংহিতায় তা অস্বীকার করা হয়নি। তবে বর্ণপ্রথার কঠিন নিগড় নামকরণ ব্যবস্থার মধ্যেও পরিয়ে দেয়া হয়েছে সুকৌশলে। বিধি অনুসারে এমনভাবে নামকরণ করতে হবে, নাম থেকেই যেন বুঝা যায় কে উচ্চবর্ণের প্রভুবংশীয় এবং কে নিম্নবর্গীয় দাসজাত শূদ্রবংশীয়। মঙ্গল্যং ব্রাহ্মণস্য স্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য বলান্বিতম্।

বৈশ্যস্য ধনসংযুক্তং শূদ্রস্য তু জুগুপ্সিতম্। । (২/৩১) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক শব্দ (‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম’; সেই ধর্মের সাধক ‘মঙ্গল্য’; ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবতাবাচক শব্দ বা ঋষিবাচক শব্দ মঙ্গলের সাধন, তাই ‘মঙ্গল্য’; যেমন- ইন্দ্র, বায়ু, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি); ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলসূচক শব্দ (যেমন, প্রজাপাল, দুর্যোধন, নৃসিংহ প্রভৃতি); বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক অর্থাৎ পুষ্টিবৃদ্ধিসমন্বিত (যেমন ধনকর্মা, গোমান, ধনপতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নাম হবে জুগুপ্সিত (নিন্দা বা হীনতাবোধক, যেমন- কৃপণক, দীন, শবরক ইত্যাদি)। শর্মবদ্বাহ্মণস্য স্যাদ্ রাজ্ঞো রক্ষাসমন্বিতম্। বৈশ্যস্য পুষ্টিসংযুক্তং শূদ্রস্য প্রৈষ্যসংযুতম্।

। (২/৩২) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নামের সাথে শর্মা এই উপপদ যুক্ত হবে (অর্থাৎ আগে মঙ্গলবাচক শব্দ তারপর ‘শর্মা’ এই উপপদ যুক্ত হবে; যেমন শুভশর্মা), ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে ‘বর্মা’ বা এইরকম কোনও রক্ষাবাচক উপাধি যুক্ত হবে; (যেমন বলবর্মা), বৈশ্যের নামের সাথে যুক্ত হবে ‘বৃদ্ধ, গুপ্ত, ভূতি’ প্রভৃতি পুষ্টিবোধক উপপদ (যেমন গোবৃদ্ধ, ধনগুপ্ত, বসুভূতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নামের উপাধি হবে প্রৈষ্য (দাস বা ভৃত্য) বাচক শব্দ (যেমন দীনদাস, ব্রাহ্মণদাস, দেবদাস প্রভৃতি)। আর স্ত্রী-জাতির নামের ক্ষেত্রে ? স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্। মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ। ।

(২/৩৩) বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)। যাই হোক, পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক ক্ষেত্র বা আবহ তৈরি করে, বৈদিক ঈশ্বরের মনেও তা রেখাপাত করতে পেরেছে বলে মনে হয়। ভাবতে ভালোই লাগে, ঈশ্বর কি তাহলে পুরুষ সম্প্রদায়ের কেউ ? অবশ্য মনুসংহিতায় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ব্রহ্মা তো পুরুষগুণবাচকই। সেভাবেই তাঁকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যাবার আগে এই সংহিতা বা শাস্ত্র রচিত হবার শাস্ত্র-বর্ণিত ইতিহাস অতি সংপ্তিভাবে জেনে রাখলে শাস্ত্রবিধিগুলো অনুধাবনে সহায়তা হতে পারে।

স্বয়ম্ভু ভগবান কর্তৃক পূর্বে অপ্রকাশিত এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি ও সংহারের পর্যায়ক্রমিক বিশদ বর্ণনার এক পর্যায়ে এসে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে- এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্। সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ। । (১/৫৭) বঙ্গানুবাদ: এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন। এরপরই আমরা পেয়ে যাই এই শাস্ত্র প্রস্তুতির উল্লেখ- ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাসৌ মামেব স্বয়মাদিতঃ।

বিধিবদ্ গ্রাহয়ামাস মরীচ্যাদীংস্ত্বহং মুনীন্। । (১/৫৮) বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে আমাকে যথাবিধি অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং আমি (মনু) মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করিয়েছি। প্রখ্যাত শাস্ত্রভাষ্যকার মেধাতিথি মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৫৮ সংখ্যক শ্লোকের ভাষ্যে বলেন- “নারদশ্চ স্মরতি। শতসাহস্রো গ্রন্থঃ প্রজাপতিনা কৃতঃ স মন্বাদিভিঃ ক্রমেণ সংক্ষিপ্ত ইতি।

” অর্থাৎ এখানে নারদ বলছেন- “এই গ্রন্থ শতসাহস্র বা লক্ষ সন্দর্ভাত্মক; প্রজাপতি (ব্রহ্মা) এটি রচনা করেছেন। তারপর ঐ লক্ষ সন্দর্ভটিকে ক্রমে ক্রমে মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ সংক্ষিপ্ত করেছেন। ” এই একই শ্লোকের টিকায় কুল্লুকভট্ট নারদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন- ব্রহ্মা প্রথমে স্মৃতিগ্রন্থটি প্রণয়ন করেন; তারপর মনু নিজ ভাষায় তার সারসংক্ষেপ করেন এবং সেই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটিই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন। পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি।

প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে। মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে (শ্লোক ৩২-৩৫) দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে বিরাট্ পুরুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং সেই বিরাট্ পুরুষ তপস্যার দ্বারা মনু-কে সৃষ্টি করেছিলেন।

মনু আবার প্রজাসৃষ্টির অভিলাষে ক্লেশকর তপস্যা করে যে দশজন প্রজাপতি (এঁরা সকলেই মহর্ষি) সৃষ্টি করলেন তাঁরা হলেন- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু এবং নারদ। প্রথম অধ্যায়ের শ্লোক ৫৮-৫৯ অনুযায়ী বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা মনুসংহিতায় আলোচনীয় শাস্ত্র অর্থাৎ বিধিনিষেধসমূহ প্রস্তুত করে প্রথমে মনু-কে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং তারপর মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পড়িয়েছিলেন। ভৃগুমনি এই সম্পূর্ণশাস্ত্র মনুর কাছে অধ্যয়ন করলেন। চারটি বর্ণের ও সঙ্কর জাতিগণের ধর্মসমূহ জানার উদ্দেশ্যে মনু-সমীপে আগত মহর্ষিদের মনু জানালেন যে, তিনি এইসব শাস্ত্র ভৃগুকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই ভৃগুই ঐ শাস্ত্র আদ্যোপান্ত সকলকে শোনাবেন। মনুকর্তৃক এইভাবে আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি ভৃগু খুশি হয়ে সকল ঋষিকে তাঁদের জিজ্ঞাস্যের উত্তর দিতে লাগলেন- এভাবেই মনুসংহিতা ভৃগু কর্তৃক সংস্কার ও সংকলিত হয়ে প্রচারিত হলো।

এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের অন্তিম শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়- ইত্যেতন্মানবং শাস্ত্রং ভৃগুপ্রোক্তং পঠন্ দ্বিজঃ। ভবত্যাচারবান্নিত্যং যথেষ্টাং প্রাপ্লুয়াদ্ গতিম্। । (১২/১২৬) বঙ্গানুবাদ: ভৃগুর দ্বারা কথিত এই মনু-সৃষ্ট-শাস্ত্র নিয়মিত পাঠ করতে থাকলে দ্বিজগণ সতত আচারনিষ্ঠ হন এবং যথাভিলষিত উৎকৃষ্ট গতি অর্থাৎ স্বর্গ লাভ করেন। কিন্তু এ মুহূর্তে স্বর্গ লাভের বদলে আমাদের প্রয়োজন মনুসংহিতা গ্রন্থটি অলৌকিকতার মোড়কে লৌকিক বর্ণাশ্রমপ্রসূত কী ভয়ানক জাতি-বিভেদ ও বর্ণ-বিদ্বেষে দুষ্ট তা অনুধাবন করা।

তাই প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ফিরে আসাই উত্তম। (চলবে....) [পরবর্তী পর্ব: ৪/৮ এখানে]
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।