অন্যায়ভাবে সংঘটিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই । ।
মনিপুরের ইরম শর্মিলা ২ নভেম্বর তার ‘আমৃত্যু অনশন’-এর ১০ বছর পূর্ণ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার নিজ রাজ্যের সরকার তার দাবি মেনে নেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তার দাবি হলো-সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্ট ১৯৫৮ বাতিল করার।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের বিচারপতি জেবি জীবন রেড্ডির সুপারিশ ছিল ওই অ্যাক্ট বাতিল করার। এতদসত্ত্বেও মনে হয়, তাকে বছরের পর বছর ধরে অনশন চালিয়ে যেতে হবে। ইতোমধ্যে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে।
শর্মিলা ২০০০ সালের নভেম্বরে যখন অনশন শুরু করেন তখন তার বয়স ছিল ২৮। ইম্ফল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মালমে আসাম রাইফেল বাহিনীর একজন সদস্য ১ নভেম্বর ১০ জন নিরপরাধ লোককে হত্যা করে।
আসাম রাইফেলসের ওই দলটা তুলিহল বিমানবন্দরের কাছে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসছিল। এ সময় মনিপুরের সশস্ত্র সংগ্রামীরা ব্যাটারিচালিত ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে কেউ হতাহত হননি। কিন্তু সৈন্যরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ওই নিরপরাধ লোকগুলোকে প্রধান রাস্তার ওপর তারা প্রকাশ্যে হত্যা করে।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাসের জন্য বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল অন্যরা বাড়ি ফিরছিল। যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিল এল আইবেটম্বি নামে ৬২ বছর বয়সী একজন মহিলা এবং ১৯৮৮ সালে জাতীয় শিশু সাহসিকতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৮ বছর বয়সী সিনাম চন্দ্র মানি। এরা আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের আক্রমণ করেছিল এমন মিথ্যা দাবি করে তাদের মেরে ফেলার এবং পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা নিরপরাধ লোকদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোক কর্তৃক হত্যা করার ক্রমবর্ধমান রিপোর্টে শর্মিলা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন। সর্বশেষ ওই ঘটনায় তার ধৈর্যের শেষ সীমা ভেঙে যায়। একই দিন তিনি অনশন শুরু করেন।
তার দাবি ছিল সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্ট ১৯৫৮ বাতিল করার। ওই অ্যাক্টের অধীন ইচ্ছামতো গুলি ছুড়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে খুশি হওয়া সৈন্যকে শাস্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ভীতিগ্রস্ত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তাই তারা দিন-দুপুরে খুন করতে থাকে। প্রথম দিকে শর্মিলার অনশনকে কেউ গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেনি। পরে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, তার অনশন শুধু প্রচারের জন্য করা হয়নি।
তিনি অনশন অব্যাহত রাখায় পুলিশ তাকে ভারতীয় দন্ডবিধির ২০৯ ধারার অধীন (আত্মহত্যার চেষ্টা) ৬ নভেম্বর গ্রেফতার করে। বন্দি অবস্থায় তিনি কিছু খেতে অস্বীকার করলে তাকে ভিটামিন, মিনারেল, তরল জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত প্রোটিন ও ডাল খাওয়ানো হয় নাকের মধ্য দিয়ে নলের সাহায্যে। তার দেখাশোনার জন্য মনিপুর সরকার প্রতি মাসে ৪০ হাজার রুপি ব্যয় করে। তাকে জে এন হাসপাতালের একটি কামরায় রেখে সেটাকে উপ-জেল ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০৯ ধারার অধীন তাকে একনাগাড়ে এক বছর আটকে রাখা যেতে পারে।
প্রতিবছর শর্মিলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক বছরে কয়েক বার ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি কখনো বাড়িতে যাননি। প্রতিবার জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই মেইরা পাইবির কর্মীরা তাকে ঘিরে ফেলে এবং মেইরা পাইবির যে কোনো একটা অফিসে তিনি তার অনশন অব্যাহত রাখেন। ওই সংগঠনের সদস্যরা রাতদিন তাকে পালাক্রমে পাহারা দেয়। মেইরা পাইবি হলো স্বতঃস্ফূর্ত মহিলাদের আন্দোলন।
শর্মিলার জন্য তাদের জোর সমর্থন রয়েছে। প্রতি পরিবার থেকে একজন মহিলা এ আন্দোলনে যোগ দেবে বলে আশা করা হয়। তার খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য তাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি শর্মিলাকে অনশন ভাঙার অনুরোধ করেছেন। তাকে এমন অঙ্গীকারও করা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্ট বাতিল করার সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
ওই অ্যাক্ট বাতিল না হওয়া পর্যন্ত শর্মিলা দৃঢ়তার সঙ্গে অনশন না ভাঙার শপথ রক্ষা করে চলেছেন।
২০০৬ সালের ২ অক্টোবর শর্মিলাকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হলে আশা করা হয়েছিল, তিনি কর্মীদের মাঝে অবস্থান করে অনশন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে মুক্তির কয়েক মিনিটের মধ্যে বিমানে করে দিল্লি নিয়ে যান। নতুন দিল্লিতে তিনি রাজঘাটে তার অনশন অব্যাহত রাখেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া তার এ অনশন নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে।
কেন্দ্রীয় সরকার এতে বেশ বিব্রত হয়। তিনি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছেও সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্ট বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে আবেদন করেন। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ৬ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে রাখা হয়। এখানে ইরানের মানবাধিকার কর্মী ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার প্রতি নিজের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন।
শর্মিলার অবস্থা খারাপ হলে দিল্লি পুলিশ অতি দ্রুত তাকে মনিপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শর্মিলার অনুপম ও অক্লান্ত আন্দোলনকে মর্যাদাপূর্ণ অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৭ সালের ১৮ মে দক্ষিণ কোরিয়া তাকে গোয়াঙ্গজু হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে-তার আত্মতাগের স্বীকৃতিস্বরূপ। এ বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তাকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিস প্রাইজ’ দেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব প্লানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রদত্ত ওই প্রাইজ হিসেবে তাকে নগদ ৫১ লাখ রুপি, গোল্ড মেডেল, সম্মাননাপত্র ও একটি শাল দেওয়া হয়।
অভিভূত শর্মিলা বলেন, তিনি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য অনশন করেননি। তিনি ওই অর্থ জনগণের জন্য ব্যয় করবেন বলে জানান। ভারতের সায়েন্স অ্যান্ড ন্যাশনালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশন ১ মার্চ দাবি করে, তার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করা হোক।
শর্মিলার উদ্বেগের কারণ হলো সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্টের ৪ নম্বর ধারার অধীন তাদের প্রদত্ত অপ্রতিহত ক্ষমতা। এ ধারার অধীন একজন নন কমিশন্ড সৈনিককেও ‘শুধু সন্দেহবশত’, ‘বলপ্রয়োগ ও মেরে ফেলার’ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রের পূর্বানুমোদন ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। এ ধরনের মামলার অনুমোদন কখনো দেওয়া হয়নি – পাছে তা সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনিপুরে বিতর্কিত হত্যার তদন্তে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এবং বিচার বিভাগীয় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তা জনগণের প্রতিবাদ থেকে দৃষ্টি ঘোরাবার জন্য করা হয়েছে। সব তদন্ত কমিশন রিপোর্ট পেশের আগেই অকার্যকর হয়ে যায়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাশ কমিশনই কেবল তার রিপোর্ট পেশ করে।
ওই কমিশন রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের একজন মেডিকেল ছাত্রসহ নয়জনকে হত্যার বিষয়টি তদন্ত করে। ভীতিকর আক্রমণের পর দাঁড়িয়ে থাকা নিরপরাধ লোকদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য ওই কমিশন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী কখনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
২০০৪ সালের ১১ জুলাই ১৭ আসাম রাইফেলসের কথিত কিছু সদস্য কর্তৃক একটি যুবতী মেয়েকে গণধর্ষণ ও হত্যার পর ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। ১৪ জুলাই ১৭ আসাম রাইফেলস ক্যাম্পে ১২ জন মহিলাকে নগ্ন করা হয়।
তাদের তীব্র আর্তনাদের মধ্যে তাদেরকেও সৈন্যরা ধর্ষণ ও হত্যা করে। মনিপুর সরকার ও আসাম রাইফেল অপরাধ তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন এবং কোর্ট অব ইনকোয়ারি গঠন করে। এটা নিষ্ঠুর ঠাট্টা বলে প্রমাণিত হয়। কারণ কেন্দ্র থেকে সৈন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য কখনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বে একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে।
সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) অ্যাক্ট বাতিল বা অন্য কোনো পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওই কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন ২০০৫ সালের ৬ জুন ১৪৭ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করে। ওই রিপোর্টে এ আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সুপারিশের বিরোধিতা করে। ফলে রিপোর্টের ওপর ধুলো জমতে থাকে।
শর্মিলাকে তার হাসপাতালের কামরায় মহিলা কারারক্ষীরা পাহারা দিয়ে রাখে। বছরের পর বছর ধরে থাকায় কারারক্ষী, ডাক্তার ও নার্সরা তার বন্ধু হয়ে পড়েছে। শর্মিলা তার সময় কাটান বই পড়ে। তিনি কবিতা ও নিবন্ধ লেখেন এবং স্থানীয় পত্রিকায় তার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন এলাকা ও বিদেশ থেকে আসা লোকদের সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে দেখা করেন।
অনেক সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। সুস্বাদু খাবারের প্রতি সব ধরনের ইচ্ছা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়। তিনি বলেন, তার একমাত্র ইচ্ছা হলো তার বৃদ্ধ মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো। এ কথা শুনে তার মা সাথি সান্ত্বনাহীনভাবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন। শর্মিলার দেখাশোনার জন্য যেসব ডাক্তার আছেন তারা বলেন, যে কোনো সময় চূড়ান্ত দুর্ঘটনাটি ঘটে যেতে পারে।
-ফ্রন্টলাইন থেকে ভাষান্তর
সূত্র/সংগ্রহ: সাপ্তাহিক বুধবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।