'উন্মুক্ত না, বিদেশি না, রপ্তানি না’, এবং ‘বহুজাতিক কোম্পানি বা দেশি লুটেরা গোষ্ঠী নয়, গ্যাস-কয়লা-তেল-সমুদ্রসহ সকল সম্পদের মালিক দেশের জনগণ’
‘বাসায় বিড়ালের পাঁচটা বাচ্চা হয়েছে। ওদের চোখ ফোটেনি। দেশ ভাগ হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার ওই বিড়ালের বাচ্চাগুলোকে ফেলে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছিল না।
মনে হচ্ছিল, ওদের চোখ ফুটবে তো? নাকি একলা বাসায় কেউ ওদের মেরে ফেলবে—এই চিন্তায় আমি খুব অস্থির ছিলাম। আজ বাংলাদেশে এসে আমার মনে হচ্ছে এক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে দেখি, বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটেছে কি না। অথচ মাঝখানে ৬২টি বছর আমার জীবন থেকে উড়ে গেছে। আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে, আমি যেন সেই নয় বছরের খুকিটি রয়েছি। ’ রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র উত্সবে যোগ দিতে এসে আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজশাহীতে হোটেলে বসে এভাবেই বলছিলেন ঋত্বিক ঘটকের মেজ বোন বিখ্যাত আঁকিয়ে সম্প্রীতি দেবীর মেয়ে কানাডা-প্রবাসী রীনা চক্রবর্তী।
বর্তমানে যেটা রাজশাহী হোমিও কলেজ, সেটাই ছিল ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি। এই বাড়িতেই রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি উত্সবের আয়োজন করে। আর এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল রীনা চক্রবর্তীর। দেশ বিভাগের পর এই প্রথম তিনি বাংলাদেশে এলেন। তাঁর সঙ্গেই এ উত্সবে যোগ দিতে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবীর মেয়ে আরমা দত্ত।
সঙ্গে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করছেন এমন দুজন ফরাসি গবেষক আনাইস ম্যাসন ও সান্দ্রা আল ভ্যারেজ।
হোটেলে বসে প্রিয় ছোট মামা ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রীনা ও আরমা বলেন, ‘আমরা এই দুই বোন ছোট মামার খুবই প্রিয় ছিলাম। ’ রীনা বলেন, ‘ছোট মামা পদ্মার ধারে বসে বাঁশি বাজাতেন। মন খারাপ হলেই ছুটে যেতেন পদ্মার ধারে। ঘুরে বেড়াতেন পদ্মার চরে।
’ এবার রাজশাহী এসেই দুই বোন ছুটে গিয়েছিলেন পদ্মায়। আরমা দত্ত বলেন, ‘মনে হচ্ছিল, মামার প্রাণ সেখানে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। আর আমাদের দুই বোনকে হাত বাড়িয়ে আয় আয় বলে ডাকছেন। ’
রীনা বলেন, ‘বাড়িতে না জানিয়ে মামা নাটক করতে যেতেন। মনে আছে, রাজশাহী কলেজের মাঠে মায়ের সঙ্গে ছোট মামার একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলেন।
এখানে আসার পরই বাইরে থেকে বাড়িটা একবার দেখে এসেছি। বাড়ির সামনের সেই প্রাচীরের খানিকটা এখনো রয়েছে। তবে মনে হচ্ছে, প্রাচীরটা অনেক ছোট হয়ে গেছে। আমরা তখন প্রাচীরটা হাতে পেতাম না। যাদের সঙ্গে ঝগড়া করতাম, ভাব করতাম, আড়ি দিতাম—সব ওই প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়েই।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ঘোষণার সময় আমি এই বাড়িতে ছিলাম। এই প্রাচীরের পাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে। পাশেই ব্যানার্জি বাড়িতে একটি রেডিও ছিল। যেদিন রেডিওতে দেশ বিভাগের ঘোষণা দেওয়া হলো, সেদিন আনন্দে লাফিয়ে উঠল হাজার হাজার। খুশির খবরটি জানানোর জন্য বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখি, সবার মুখ গোমড়া।
বুঝলাম, এই ভাগাভাগিটা বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেনি। এর তিন দিন পরই আমরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যাই। ’
রীনা আরও বলেন, ‘রাজশাহীতে এসে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগত, যদি কেউ শিবুদা আর শঙ্করদার খবরটা দিতে পারতেন। তাঁরা বেঁচে আছেন কি না।
কোথায় তাঁদের বাড়িটা ছিল, আমি আর আন্দাজ করতে পারছি না। শিবু-শঙ্কর দুই ভাই ছিলেন। শিবুদার গায়ের রং ছিল খুব ফর্সা। কোঁকড়া চুল ও গোঁফ ছিল। শঙ্করদার গোঁফ ছিল না।
ময়লামতো। কোঁকড়ানো চুল ছিল। শিবুদা সুন্দর ছবি আঁকতেন। আমার মায়ের কাছেই তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন। মা খুব ভালো আঁকতেন।
আমার জন্মের আগে ১৯৩৩ সালে কলকাতায় ফাইন আর্ট গ্যালারিতে মায়ের চিত্র প্রদর্শনী হয়। জয়নুল আবেদিনও আমার মায়ের কাছে শিখেছেন। ’
অনুষ্ঠান শুরুর আগেই তাঁরা ওই বাড়িতে এসে খুঁজতে থাকেন, কোথায় তাঁদের দাদা (ঋত্বিক ঘটকের বাবা) থাকতেন, কোন বারান্দায় বসে চা বানিয়ে খেতেন। কোন ঘরের খাটের নিচ থেকে মামা ঋত্বিক ঘটক আম চুরি করে খেতেন। যেখানে এখন কলেজের অধ্যক্ষ বসেন, সেখানে গিয়ে রীনা চক্রবর্তী বলেন, এই পাশ দিয়ে একটি বের হওয়ার রাস্তা ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ ইয়াসিন আলী রাস্তাটি দেখিয়ে দেন। যেখানে একটি নতুন ঘর করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, এখানেই একটি টিনের ঘরে বিড়ালের পাঁচটি বাচ্চা ছিল। বাড়ির ভেতর ঢুকেই তিনি কুয়াটা খুঁজছিলেন, যে কুয়ার পানি খেতেন। কুয়ার কাছে গিয়ে তিনি জানান, ছোট ছিলেন, তাই পড়ে যাওয়ার ভয়ে কুয়ার কাছে তাঁদের যেতে দেওয়া হতো না। তবে প্রফুল্ল নামের এক ব্যক্তি কুয়া থেকে তাঁদের পানি তুলে খাওয়াতেন, তা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।
বাড়ির প্রাচীরটার কাছে গিয়ে বলেন, ‘এই প্রাচীরটা এখন অনেকটা ছোট মনে হচ্ছে। আমি তখন এই প্রাচীরের মাথা ছুঁতে পারতাম না। ’ তিনি স্মৃতি হিসেবে প্রাচীর থেকে একটি ইটের টুকরো তাঁর ব্যাগে ভরে নেন।
অনুষ্ঠানে দুই বোনের আবেগী স্মৃতিচারণায় চোখ ভিজে ওঠে সবার। শুনে উদ্বোধক উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক বলেন, মানুষের আবেগ যখন পবিত্র হয়ে যায়, প্রাধান্য পায়, আরও মানবিক হয়ে ওঠে, তখন তা সব যুক্তি-বুদ্ধিকে অতিক্রম করে যায়।
তিনি বলেন, ‘শিল্প, সাহিত্য এবং মানুষের হূদয়কে কখনো ভাগ করা যায় না। তাই দেশ ভাগ করলেও মানুষের ভালোবাসার কারণে ঋত্বিক ঘটককে ভাগ করা যাবে না। ঋত্বিক ওপারে চলে গেলেও একইভাবে তিনি আমাদের। ’ তিনি আরও জানান, ঘটক পরিবারের মতো তাঁকেও দেশ বিভাগের কারণে বর্ধমান থেকে চলে আসতে হয়েছিল। তখন তাঁর মা কিছুতেই আসতে চাননি।
এই বেদনার কথা তিনি তাঁর আগুন পাখি উপন্যাসে বলেছেন।
উত্সবের ভেন্যু রাজশাহী হোমিও কলেজের বাড়িতেই ঋত্বিক ঘটকের বাবা বড় হয়েছেন। রাজশাহী শহরের সাগরপাড়ার মহেশ্বর ভট্টাচার্যের মেয়ে ঋত্বিকের মা ইন্দুবালা দেবী এই বাড়িতেই বউ হয়ে এসেছিলেন। একে একে তাঁর নয় ভাই-বোন মনীশ ঘটক, সুধীস ঘটক, তপতী দেবী, সম্প্রীতি দেবী, আশীষ ঘটক, ব্রততী দেবী, লোকেশ ঘটক, ঋত্বিক ঘটক ও প্রতীতি দেবী এই বাড়িতেই লালিত-পালিত হয়েছেন। অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক রাজশাহী হোমিও কলেজের নাম পরিবর্তন করে ঋত্বিক ঘটক হোমিও কলেজ রাখার প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্থানীয় সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, কলেজের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কোনো আপত্তি না থাকলে কিংবদন্তির এই চলচ্চিত্র নির্মাতার নামে কলেজের নামকরণ করতে আইনগত আর কোনো বাধা নেই।
অনুষ্ঠানে ঋত্বিক ঘটকের ছবি মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, নাগরিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, অযান্ত্রিক, যুক্তিতক্কো আর গপ্পো, তিতাস একটি নদীর নাম ও সুবর্ণ রেখা প্রদর্শন করা হয়।
স্মৃতি-বেদনার ঋত্বিক মেলা
লেখক – আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
তারিখ – ২৪ ডিসেম্বর ২০০৯
“দৈনিক প্রথম আলো”-তে প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।