কাজের চাপে অনেকদিন ধরেই ছুটি পাচ্ছিলাম না। যাও বা একদিন-দুইদিনের জন্য পেয়েছি তার মধ্যেও অনেক কাজ ঢুকে পড়েছে। ভাগ্নেদের জন্য কোনমতে কয়েক ঘন্টা বের করেছি, কখনও তাও পারিনি। ঈদের পর আরও অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে যাবো। তাই এবার একটা মোটামুটি লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম।
তার মধ্যে একটা বড় সময় রাখলাম আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীদের জন্য। টানা চারদিন ওদের সাথে সময় কাটিয়েছি।
বড় ভাগ্নে, আমার জানের জান ভাগ্নে, আমাকে পেয়ে সবচেয়ে খুশী। ওর জন্মদিনে পাওয়া সব খেলনা আমাকে বের করে দেখাল। একটা আইসক্রীমের ছাঁচও পেয়েছে।
ওটা দিয়ে সে আমাকে মালটা ফ্লেভার আইসক্রীম বানিয়ে খাওয়াল (যদিও আমি ওর কাছে পেপসি ফ্লেভার আইসক্রীম বানানোর ফরমায়েশ করেছিলাম)। আর আমি অনেকদিন পর আব্বার কাছে পিচ্চিদের মত আবদার করে চকবার আইসক্রীম আর চটপটি খেলাম। একই দিনে দুইবার আইসক্রীম খাওয়ার শাস্তি হিসেবে ঠান্ডা লেগে গেল। আর চটপটির ঝালে চোখ-নাক দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে চলল।
ভাগ্নে প্রতিদিন বাড়ির কাজ করতে বসে ভারী গাল ফুলায়।
তাকে যোগ-বিয়োগের মত এত কঠিন কঠিন অংক কেন করতে দেয়া হয়। গুণ-ভাগের মত সহজ অংক কেন সবগুলো হয় না। আর বাংলা পড়তে গেলে তার মনটা কেন যেন উদাস হয়ে যায়। একটা লাইন পড়ে আকাশের দিকে ভাবুকের মত তাকিয়ে থাকে।
রাতে ভাগ্নের পাশেই আমার ঘুমানোর জায়গা বরাদ্দ হয়েছে।
ভাগ্নে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করে। উঠতে বললে বলে, আমার শরীর এখনও নরম হয়ে আছে, শক্ত হলে উঠব। প্রথম দিন আমার কাছে জানতে চায়, রাতে কি তোমাকে লাথি দিয়েছি? না বলার পর খুব অবাক হয়, মাম তো বলে আমি খালি ঘুমের মধ্যে লাথি দিই। দ্বিতীয় রাতেই টের পেলাম ওর মাম মিথ্যে বলে না। ঘুমের মধ্যে যতবারই ভাগ্নের পা সরিয়ে দিই, সে একটু পর আবার পা আমার কাছে এনে জগিং করা শুরু করে।
ঘুমের মধ্যেও ব্যায়াম চর্চা।
তৃতীয় রাতে একটা ব্যাপারে মাম ভাগ্নেকে একটু বকা-ঝকা করল। এমন কোন বড় ব্যাপার ছিল না, কিন্তু আমার সামনে বকা খেয়ে মনে হয় তার খুব আঁতে লাগল। রাগে-অভিমানে সে ঘোষণা দিল সে আজকে মশারির ভিতর ঢুকবে না। মাম আর আমি দুজনেই কয়েক দফা চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।
সে অন্ধকারে একটা টুলে বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল আর মশার কামড় খেতে থাকল। প্রায় দুই ঘন্টা পর হঠাৎ আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা বস্তা ধড়াম করে পড়ল, দেখি ভাগ্নে আর থাকতে না পেরে নিজেই চলে এসেছে। আমরা কিছুই দেখিনি এমন ভাব করে দুজন দুই দিকে ফিরে শুয়ে রইলাম।
এই পুরো ঘটনায় একজন খুব কষ্ট পেয়েছে, সে হল আমার ছোট ভাগ্নে। সে বড় ভাইয়ের কষ্ট একেবারে সহ্য করতে পারে না।
নতুন নতুন কথা বলতে শিখেছে সে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি আর পুটুর পুটুর কথা দিয়ে বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখে। একবার আমার কোলে বসে খেলছিল, খেলতে বসে একটু পর পর চিৎকার করে উঠছিল। আমি একটু কনফিউজড হয়ে বড় ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর এই চিৎকার কি খুশির না রাগের। ছোট ভাগ্নে নিজেই বলে উঠল, কুসি কুসি।
আমাকে একটা গাড়ির বর্ণনা দিচ্ছিল এভাবে, গালিতা ওঁয়া ওঁয়া কলে তলে, উপলে লাল নীল তাইত (লাইট) দলে। তখন বুঝতে পারিনি কিসের কথা বলছে। পরে সে তার মায়ের কাছ থেকে গাড়িটার নাম জেনে বলে, ঐতা এঙ্গুলেন্স (অ্যাম্বুলেন্স), ওঁয়া ওঁয়া কলে তলে, উপলে লাল নীল তাইত দলে।
একদিন ভাগ্নেদের নিয়ে বাইরে যাব ঠিক করলাম। ছোট ভাগ্নে তার পছন্দের কথা জানিয়ে দিল যে সে কোন কোন ধরণের গাড়িতে চড়ে বেড়াতে যেতে চায়।
এগুলো হল, নীল বাস, হনুদ পাপ পাপ (হলুদ ট্যাক্সি), সিন্জি (সি এন জি অটো), এঙ্গুলেন্স। আমি বললাম, আমরা তো গাড়িতে যাব না, রিকশা টিং টিং যাব। তার মোটেই পছন্দ হল না। রিকশায় চড়ার পর আশে পাশে গাড়ি যেতে দেখে তার মেজাজ আরও খারাপ হল। বার বার গাড়ি দেখিয়ে মাকে বলতে থাকল, পাপ পাপ দাও।
ওর মা বলল, আব্বুরে, এইভাবে গাড়ি চাইলেই কি আর দেয়া যায়? তুমি বড় হয়ে একটা গাড়ি কিনে আমাদের দিও।
এখন সে সব কথা বলতে চেষ্টা করে, কারও কাছে নতুন কিছু শুনলে বারবার বলতে থাকে। ওর বড় খালার একটা জিনিস নিয়ে দুষ্টুমি করছিল। আমি বললাম, তুমি যে এমন করছ তোমাকে তো পিটুনি দিবে। সাথে সাথে সে সুর করে বলতে থাকল, তুনি তুনি তুনি।
আমি বললাম, তুনি না রে, পিটুনি, খেলে বুঝবা কেমন লাগে। সে আরও খুশি হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে শব্দটা মুখস্থ করতে থাকল, পিতুনি পিতুনি পিতুনি।
বড় ভাইয়া নুডুলস খেতে বসলে সে দৌড়ে আসে, উদুস উদুস বলতে বলতে। বড় ভাইয়ের প্লেট থেকে উদুস খেতে ওর ভারী মজা লাগে। আর যদি কেউ দই খেতে বসে, তাহলে তো তাকে না দিয়ে খাওয়াই চলবে না।
দুই দুই করে মাথা খারাপ করে দিবে। আমি একবার দই খেতে বসে পুরোটাই তাকে খাইয়ে দিতে হয়েছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যখন এক চামচ বাকী তখন সে হঠাৎ বলে উঠল, আন্তিমুনি কাবে (আন্টিমনি খাবে)। আমি বললাম, থাক এক চামচ দিয়ে আর উদ্ধার করতে হবে না, এটাও তুমিই খাও। সে আর কথা না বাড়িয়ে ঝটপট সাবাড় করে দিল।
উদুস আর দুই পছন্দ করলেও ভাত তার একদম পছন্দ না। বহু সাধ্য সাধনা করে যে সামান্য ভাত খাওয়ানো হয় তাও টিভির বিজ্ঞাপন দেখিয়ে দেখিয়ে। আর চ্যানেলগুলোও এমন যখনই ভাত খাওয়ানোর সময় হয় তখনই সব বিজ্ঞাপন বন্ধ করে অনুষ্ঠান দেখাতে থাকে। অথচ অন্য সময় কোন অনুষ্ঠান দেখতে গেলে বিজ্ঞাপনের তোড়ে ভুলেই যাওয়া লাগে যে কী অনুষ্ঠান দেখতে বসা হয়েছিল।
বড় ভাইকে সে যেমন ভালোবাসে, তেমনি ছোট বোনকেও এত্ত বেশি আদর করে।
আমার এই ভাগ্নীটা খুব বেশি ছোট। মাত্র আড়াই মাস। সবেমাত্র মানুষের চেহারা চেনা শুরু করেছে। আমি বেশি সময় দিতে পারি না বলে আমার চেহারাটা তার চেনা হচ্ছিল না। এবার গিয়ে ভারী মন খারাপ হয়েছিল আমার, এত নাম ধরে ডাকি কথা বলি, সে আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না।
একদিন নাম না ডেকে টুনটুনি বলে ডাক দিলাম, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিল। এই ডাকটার জন্যই বুঝি অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অন্য খালারা যে ওর নাম ধরে ডাকে, তখন তো ঠিকই তাকায়।
ভারী অবাক কান্ড। আমি যতবারই নাম ধরে ডাকি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, এমন ভাব যে শুনতেই পাচ্ছে না।
আর টুনটুনি বললেই ঝট করে ঘুরে তাকাবে আর হাসি দিবে। তবে ওর সবচেয়ে বেশি খাতির জানালার পর্দা আর ওর কাপড় রাখার ব্যাগের সাথে। এই দুইটা জিনিস দেখলে সে ভারী উৎসাহ নিয়ে আআআআআ উউউউউউ করে তাদের সাথে কথা বলতে থাকে। এদেরকেই ওর সবচেয়ে আপন মনে হয়।
আব্বা বলে ও নাকি দেখতে একদম আমার মত হয়েছে।
একটাই পার্থক্য, ভাগ্নীটা শুটকু পুটকু, আর আমি ছিলাম হোঁদল কুৎ কুৎ। ওর বড় খালা ওর নাম দিয়েছে, আমাদের বাড়ির গম্ভীর বাবু। এইটুকু পিচ্চি যে কিভাবে এত মুড দেখায়। মা ছাড়া অন্য কেউ কোলে নিলে দুই হাতে ঠেলে নিজেকে যতটা পারে সরিয়ে রাখে। যেন বাকী সবাই অচ্ছ্যুৎ।
কিছুদিন পর আমার ব্যস্ততা আবার বেড়ে যাবে, আবারও আমাকে ভুলে যাবে। তবু আমার প্রিয় থাকবে ওরা সবাই, সব সময়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।