আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি ওয়ালী কিরণ সার্থক গল্পকারও বটে



কবি ওয়ালী কিরণ সার্থক গল্পকারও বটে মোজাফ্ফর হোসেন কবিদের গদ্যের বেশ স্ত্ততি আছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামছুল হক--সকলেই কম বেশি গল্প লিখেছেন এবং বেশ খ্যাতিও পেয়েছেন। আধুনিক ছোটগল্পের রুপকার এ্যাডগার এ্যলোন পোও একজন সার্থক কবি ছিলেন। কবিরা সাধারণ মানুষদের থেকে ঢের বেশি কল্পনা আশ্রিত হন। কখনো কখনো কল্পনার ডানায় ভর করে তাঁরা আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার (utopia) নকশা তৈরী করেন স্ব স্ব জাতি বা সভ্যতার জন্য।

কবিরা তাঁদের গদ্যতেও স্বভাবজাত চিত্রকল্পের প্রকাশে আবহ করে তোলেন কাব্যিক (poetic) এবং কুয়াশাচ্ছন্ন (mystical)। মানব প্রকৃতি ছাপিয়ে প্রকৃতির চারিত্রিক বহিঃপ্রকাশ বা personification আমাদের চেতনা প্রবাহকে কম্পিত করে। জীবন হয়ে ওঠে অতি মাত্রায় কাব্যিক। এজন্য গ্যেটের ‘সাফারিং অব ইয়ং ইয়র্দার’ কিম্বা রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের চরিত্রগুলোকে বুঝতে হলে প্রকৃতির কাছে যেতে হয় বার বার। প্রায়শঃ কবিদের গদ্য বা গল্পকে গীতিধর্মী (lyrical) বলে থাকেন সমালোকরা।

রবীন্দ্রনাথকে জবাবে বলতে হয়েছে, ‘আমি একটা কথা বুঝতে পারি নে, আমার গল্পগুলোকে কেন গীতিধর্মী বলা হয়। এগুলো নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তা তো করি নে আমি। ’ কথাসাহিত্যের প্রকৃতিই হচ্ছে সমসাময়িক বাস্তবতা ও ইতিহাসের আলোকে মানব চরিত্রের পর্যালোচনা করা ও সর্বপরি খুব সাধারণ মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি রপ্ত করা।

খুব পরিচিত জীবন ঘনিষ্ট চিত্রকল্পের সমাবেশ ঘটিয়ে মানব হৃদয়ের আক্ষরিক রূপটির প্রকাশ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যে এসে অনেক কবিই ব্যর্থ হয়েছেন। এ জন্যই আমরা যখন প্রিয় কথাসাহিত্যিক বা গল্পকারের কথা বলি, তখন চলে আসে--মানিক, বিভূতিভূষণ, শরৎ, তারাশঙ্কর, বনফুল, আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক; কিম্বা তলস্তয়, চেখব, গোর্কি, মপাসাঁ, হেমিংওয়েদের নাম। ওয়ালী কিরণ আশির দশকের কবি হিসাবেই সমধিক পরিচিত। বটেই।

তবে ওয়ালী কিরণের গল্প পড়তে গিয়ে খুব কমই মনে হয়েছে এটা শুধুই একজন কবির গদ্য। এর কারণ নানাবিধ। প্রথমত, এই গল্পগুলো কবি ওয়ালী কিরণের কবি হয়ে ওঠার প্রস্ত্ততি পর্বে লেখা। তখনো কবির নিভৃত জীবন শুরু হয়নি। দ্বিতীয়ত, কিম্বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটা হচ্ছে--ওয়ালী কিরণ একজন কথাপ্রিয় মানুষ, গল্পে ডুবে গেলে খৈ হারিয়ে ফেলেন তিনি।

বেশির ভাগ কবিরাই জীবনানন্দের মত ঘর প্রিয়--স্বল্পভাসী হয়ে থাকেন। ওয়ালী কিরণ বরাবরই মানুষের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন। তাঁর গল্পে উঠে আসে একটি নিষ্ঠুর-নিরেট বাস্তবতার। শহুরে সভ্যতার মানুষ হলেও গ্রাম্য পরিমন্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ তিনি।

তাঁর গল্পে উঠে এসেছে এই অঞ্চলের মানুষের মনস্তাত্বিক পরিমন্ডল, এবং ভাষা ও সংস্কৃতি। তাই রবীন্দ্রনাথের মত তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোও আমাদের কাছের কেউ, একান্ত আপন বলেই মনে হয়। পাঠকরা পড়তে পড়তে কতকটা কল্পনা করে নিতে পারেন আপন মেজাজে। এখানেই গল্পকার হিসাবে কবি ওয়ালী কিরণের সার্থকতা। ওয়ালী কিরণের ২০০৮-এ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম এবং একমাত্র গল্পের বই অন্ধ অজগর।

এই বইয়ে মোট ১৩ টি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো আশি ও নববুয়ের দশকে লেখা এবং ঐ সময়ের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত। বইটির প্রথম গল্প ‘জলনিশির ডাক’। গল্পের কেদ্রিয় চরিত্র একজন বুদ্ধা। যাকে সবাই কুঁজিবুড়ি বলে ডাকে।

পুঁজিবাদী-পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ বৃদ্ধার আসল নাম উদঘাটনে কোন আগ্রহ প্রকাশ করে না, তারা এখন ব্যস্ত মাটি খননে--সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনের কাছে কুঁজিবুড়ির মূল্য এখন বৃদ্ধার কাছে তার কুঁজটির যেমন মূল্য তদরুপ। রাজশাহীর মোহনপুরের বাতুড়িয়া গ্রাম গল্পের পটভূমি। গ্রামে পানির প্রচন্ড আকাল পড়ে। চাইলে ভাত-রুটি সব পাওয়া যায় কিন্তু পানি পাওয়া যায় না কোন মতেই। ‘মাইল খানেক দূরে চিকন-বাকন বারানই নদী এ এলাকার ধমনী, রক্তহীন পড়ে আছে।

কোথাও কোথাও শুধু মরা রক্তের মতো থকথকে কাদা। ফসলের মাঠ খাঁ খাঁ রোদ্দুরে বুড়োর ফাটা পায়ের মতো চৌচির। স্যালোমেশিনে পানি ওঠে না। ইরি ধানের চারা পুড়ে পোড়া আলুর রঙ ধরেছে। ’ এমনই গাঁয়ের দশা।

গ্রামে মোট চারটা টিবওয়েল তার একটিতেই কেবল পানি উঠছে,--সেটি হচ্ছে আবিদ হাজির টিবওয়েল। আরব দেশ ঘুরে এসেছেন বলেই হয়ত আল্লাহর এই পক্ষপাতদুষ্ট নজর। এই টিওবয়েলটি এখন এই গ্রামের একমাত্র ভরসা। তাই সুযোগ পেয়ে হাজী পত্নী মাতববারী করতে ছাড়ে না। কুঁজিবুড়ি জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে যায় কলের ধারে, জোয়ান মহিলাদের কাছে ভিড়তে পারে না সে।

কেউ যে একটু দয়া দেখাবে তারও উপায় নেই। পানির সংকটের কারণ হিসাবে কুঁজি বুড়ি বলেন, ‘..নদী হইছে দ্যাছের লাড়ী। নদী মইরলে পাতালও মরে। ..’ মধ্যরাতে বুড়ির পানি পিপাসা চরমে ওঠে। ‘বেড়ার ফাঁক ফোঁকরে,’ তখন ‘ঝাঁক ঝাঁক সরষে ফুলের মতো হলুদ জ্যোৎস্নার ফুল ফুটে আছে।

...চাঁাদের আলোটা পর্যন্ত তপ্ত মনে হয় তার। ’ ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ হয়ে যায় তেষ্টার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। কোথাও পানি না পেয়ে বৃদ্ধা নিজ মনে আওড়াতে থাকে, ‘হাইরে পানি! তুই হাঁর পুরুছটাকে লিলি। ছাওয়ালটাখে লিলি। ছোংরাটাকে খালি।

অ্যাখন আবার তোর পাত্তাই নাই। ’ যে জল একদিন বৃদ্ধার স্বামী-সন্তানকে ভাসিয়ে নিয়েছিল দাপটের সাথে আজ তারই লাপাত্তা। বৃদ্ধার অবস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দি রাইডার্স টু দি সি নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র বয়স্কা মওরার কথা। সমুদ্র বৃদ্ধার জীবন থেকে জিনিয়ে নেই শশুর, স্বামী ও পাঁচ সন্তানকে। বৃদ্ধা তখন প্রলাপ বকে, তারা সব বিদায় নিয়েছে, এখন সমুদ্র আর আমার কিছুই করতে পারবে না।

..যখন দক্ষিন দিক থেকে ঝড়ো হাওয়া তেড়ে আসবে তখন আর আমাকে কারও জন্য প্রার্থনা করতে হবে না। ..’ রাস্তার পাশের পুকুরটাই আধ হাঁটু জল চাঁদের আলোয় চকচক করে। বৃদ্ধাকে চুম্বকের মত টেনে নিয়ে যায় সেখানে। পরদিন পুকুরের তলায় পাওয়া যায় কুঁজি বুড়িকে। ‘সবাই দেখে--পানি ভরা তার পেটটা পোয়াতি মেয়ের মতো ফুলে আছে।

’ দেশে পানির আকাল তারপরও স্বামী-সন্তানের মত পানির আধিক্যেই জীবনটা গত হয় তার। ‘আত্মহত্যার ল্যাবরেটরিতে’ এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। গল্পটি আমাদের হাস্যরসের খোরাক জোগায় বটে তবে গল্পকার এখানে ঠাট্টার ছলে মানব প্রকৃতির আসল রুপটির অনেকখানি উন্মোচন করেছেন। দেহের রঙ কালো হওয়াই বুধার মেয়ের অঘোসীত ভাবেই নাম হয়ে যায় কালী। বস্তুবাদী এই সমাজ বাইরের খোলস দেখে নির্ধারণ করে মানুষের মূল্য--নারী হলে তো কথায় নেই! রুপ-লাবন্য না থাকলে সে আবার রমনী কিসের! কালো বলেই হয়ত মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয় মোস্তফার সাথে, যার চোর হিসাবে গাঁয়ে বেশ সুখ্যাতি আছে।

মোস্তফার বয়স ত্রিশের কোঠা পার হতে চলল। দেহের ক্ষুধার কাছে এখন কুপোকাত সে। একটা রক্ত মাংসের দেহ হলেই চলবে তার। ইতোমধ্যে এই দেহ যন্ত্রনা থেকে উদ্ধার পেতে দু’ দুইবার বিষ খেয়েছিল সে। এমনই দূর্ভাগ্য তার মৃত্যুও তাকে উপহাস করে।

এ বার অনেক কষ্ট করে বাবাকে রাজি করিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিয়েটাও ভেঙ্গে গেল। অলিমা হিসাবে দেওয়া মুড়কি ওজনে এক কেজি কম হওয়াতে কনের বাপই এই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। আজকাল দেনমোহরের টাকা নিয়ে এমন কান্ড ঘটে থাকে। আরব দেশে নাকি মেয়েদের যথেষ্ট পরিমানে অর্থ-কড়ি না দিতে পারলে বিয়ে হয় না ছেলেদের।

আমাদের দেশে ছেলেদের বিয়ে নিয়ে কোন সমস্যা হয় না, বরং কে কয়টা বিয়ে করতে পারলো তার একটা প্রতিযোগিতাও চলে চলে ভেতরে ভেতরে। মন্দ কপাল মোস্তফার--সামান্য মুড়কি এসে তার বিয়ে ঠেকিয়ে দিল? এই ব্যথাভরা জীবন নিয়ে বাঁশবাগানের ভেতরে বসে থাকে মোস্তফা। বাঁশাঝাড়ের ভেতর আলোর মত তার মগজে মৃত্যু উকি মারতে থাকে। বেঁচে থাকা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। চারিদিকে যেমন সতেজ গাছপালা, লতা-পাতা, আগাছা, পরগাছা, পাখ-পাখালি আছে, তেমনি আছে, ‘মরা ঘাস, ঝরাপাতা, মৃত ঝোপঝাড়, মরে যাওয়া বাঁশ’,--জীবন-মৃত্যুর এই খেলার সহাবস্থান তার সিন্ধান্তকে আরো উসকে দেয়।

‘মানুষের মৃত্যু অবধারীত-আজ অথবা কাল! সুতরাং আত্মহত্যা করলেই বা ক্ষতি কি?’ মোস্তফার ভাবনা আমাদেরকেও ভাবিয়ে তোলে। নৈরাশ্যবাদ (nothingness) যদি হয় আমাদের জীবনের আলটিমেট সমাপ্ত তাহলে বস্ত্ত জগত নিয়ে এত মাতামাতি কেন? মোস্তফা আবারো বিষের বোতলে খুঁজে ফেরে শেষ আশ্রয়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে বিষ। খাটিয়ার ওপরে করে মোস্তফাকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। পথিমধ্যে খাটিয়ার ওপর উঠে বসে মোস্তফা। শেষ পর্যন্ত বিয়ের জন্য টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় মোস্তফাকে।

‘দুই হোন্ডার গল্প’ গল্পে গ্রাম রাজনীতির সাথে হাত মেলায় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক চক্র। ইংরেজদের দু’শ বছরের উপনেশবাদ (colonialism) এদেশের মানুষের মনে দগদগে ঘা তৈরী করে রেখে গেছে। সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে তাদের ভেতরটা বিষিয়ে ওঠে, রক্তচোষা জোকের ভয়ে কুকড়ে যায় সর্বাঙ্গ। তাই তো তারা সাহায্য করতে আসলে গ্রামবাসী ব্যবসায়ের গন্ধ পায়,--সাহয্যের নামে ফয়দা আদায়ের কুচক্রি মনোভাব প্রকাশ পেয়ে যায় ভুক্তভোগী চাষাদের কাছে। গ্রামের চেয়ারম্যান হাত মেলায় ওদের সাথে।

ফলত, সর্বশক্তিমানের কাছে পরাজিত হয় সর্বসাধারণের। সভ্যতার যত বিকাশ ঘটছে, আইন তত শক্তিশালী হচ্ছে আর এই আইনের ভয় দেখিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে শ্রেণীবৈশম্য। আধুনিক সভ্যতা হচ্ছে একটি শ্রেণীকেদ্রিক সভ্যতা, যা অপর একটি শ্রেণীর বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করছে। ‘অন্ধ অজগর’ গল্পের নামকরনটি রূপক অর্থে করা হয়েছে। গল্পের পটভূমি ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়।

মানুষের পাশবিক চেতনাকে অন্ধ অজগরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যথার্থ তুলনা বটে। অজগর যেমন তার থেকে কম শক্তিধর প্রাণীকুলকে গলাধকরণ করে শুধুমাত্র জীবন ধারণই করে না, আনন্দও পায় বটে। পাকহানাদার বাহিনী তেমনি বাংলার অগনিত মানুষের উপর অত্যাচার করে তাদের পাকহানাদারিত্বই শুধু বজায় রাখে না, সাথে সাথে তাদের বিনোদনের খোরাকও পূর্ণ করে। চোখ না ফোটা বাচ্চা অজগর যেমন করে হাঁস-মুরগীর বাচ্চা সাবাড় করে, তেমনি পঁচিশ বছরের পাকসেনার নির্দেশে বিশ-পঁচিশ জন বাঙ্গালিকে এক মুহূর্তেই মাটি চাপা দেওয়া হয়।

‘বৃত্তের ভাঙন’ গল্পে সমাজের বহু বিবাহ প্রথার প্রকৃত স্বরূপ ও গ্রাম্য সালিশের নগ্ন রূপটির প্রকাশ ঘটেছে। ‘মা মরার পর মাস তিনেক যেতে না যেতেই বাপ সুরুজ মিয়া চল্লিশ পেরোনো বুড়ো, হাড্ডিতে শান দিতে লাগলো। সাত ছেলের বাপ সুরুজ মিয়া আবার বিয়ে করতে চায়। ’ সংসারের এত অভাব সহ্য হলেও বৌয়ের অভাব সহ্য করতে পারে না আমাদের পুরুষ সমাজ। বিয়েতে বাধা দেওয়াতে বড় ছেলে ভোলাকে ঘর ছাড়তে হয়।

এমনকি ভোলার জন্ম নিয়ে সংসয় প্রকাশ করে সে-‘বেজন্মা। তুই আমার হুলের পয়দা না। ’ গল্পটিতে কাঠাল চুরির শাস্তি হিসাবে দশ বছরের খিলিকে পনের ঘা দোররা মারা হয়। সরকারের তৈরী আইনকে কাচকলা দেখিয়ে এভাবেই ফয়দা আদায় করে আসছে গ্রাম সরকাররা। পিতা ও পুত্রের স্বভাবজাত ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার এক সুন্দর রসায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘হরতাল ও দুটি বালক’ গল্পে।

হরতালে নাগরিক জীবনের দুর্ভোগের একটা চিত্র এখানে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে, যদিও এটি গল্পের আলোচ্য বিষয় নই। অনেক সময় গল্পের ভাষা ও শব্দের বুনন আমাদেরকে এক বসাতেই গল্পের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এই গল্পের ক্ষেত্রে সেটিই ঘটে। কাহিনী এখানে যতটা না বলবার তার থেকে বেশি অনুভবের। এই অনুভব আমাদেরকে আনন্দ দেয় আবার কাঁদায়ও।

অনেকটা কিটসের ‘pleasure in pain’- এর মত। নারী ও যৌনতার সাথে পুরুষের একধরণের মনস্তাত্বিক সম্পর্ক আছে। তাই এই সম্পর্কের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে আমাদের মনোজগতের অনেক কিছুই পরিবর্তীত হয়, এমনকি বিশ্বাসও। এবং কোন কামনা মনের ভেতর দমিয়ে রাখলে সেটা এক সময় দ্বিগুন শক্তি সঞ্চয় করে উদগিরনের চেষ্টা চালায়। ফ্রয়েডীয় মতবাদে বিষয়টি আরো পরিস্কার করা হয়েছে।

মনোজগতের এই বিষয়গুলি নিয়েই লেখা গল্প ‘গিরিবাজ’। গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র মাসুম, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে। যৌবনের গুরুত্ব্পূর্ণ একটা সময় নারীসঙ্গ বঞ্চিত থাকার কারণে, তার চিন্তার মূলে চলে এসেছে নারী ও যৌনতা। বাংলাদেশের তথাকথিত মধ্যবিত্ত মানুষিকতার পরিবর্তন চায় সে, এ জন্যই সমাজতন্ত্রী ছাত্র সংগঠনে যোগদান করে। সমাজতন্ত্রের সাথে লিবার্যােল সমাজ ব্যবস্থার একটা যোগসূত্র আছে।

কোন উপায়ন্তর না দেখে যৌন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পতিতালয়ে যাবার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে সে। এক মধ্যবয়স্ক পতিতার সঙ্গ তার কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পতিতাও মাসুমের মত সুন্দর সুঠাম দেহের যুবককে পেয়ে বেশ খুশিই হয়। বাস্তবিক পক্ষে, পঞ্চাশের কাছাকাছি একজন পতিতার এই আচরন কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ‘গ্রাস’ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র রাববানী সাহেব খেতে খুব পছন্দ করেন।

কেই বেঁচে থাকার জন্য খান, আর কেও খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকেন। রাববানী সাহেব দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ। গ্রাস করাতেই তার পরম তৃপ্তি। এ নিয়ে তার নিজস্ব একটি দর্শনও আছে--মানুষের ‘বাইরের সবকিছুকে শরীরের মধ্যে গ্রহণ করে তাকে শরীরের মধ্যে মিশিয়ে দেবার একটা প্রবনতা আছে। তাই মাঝে মাঝে কিছু একটা মুখে দিয়ে আত্মাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হয়।

’ রাববানী সাহেব সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন। ফলত, উপরি খাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পান এবং যথাসাধ্য তার সদ্ব্যবহার করতে সচেষ্ট হোন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন তিনি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যেখানে দু’মুঠো ভাত ঠিকমত পায় না, রাববানী সাহেব সেখানে আয়েশ করে জীবন পার করে দিচ্ছেন, তাই সৃষ্টিকর্তার সাথে তার এই সুখের একটা অংশ ভাগ করে নিতে ভোলেন না তিনি। ‘economy determines everything’এমনটি পিতা-পুত্রের ভালোবাসাও।

রাববানী সাহেব ছোট ছেলেকে বড় ছেলের থেকে বেশি ভালোবাসেন কারণ ছোট ছেলের আয়-রোজকার বেশি। সব ক্ষেত্রে এমনটি না ঘটলেও অনেক ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। গল্পটি রম্য ধাচের। রাববানী সাহেবের চরিত্ররূপায়ন (characterization) ক্ষেত্রবিশেষ হাসির উদ্রেক ঘটাই বটে তবে এই চরিত্রের ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় মানব চরিত্রের নিগূঢ় রহস্য। ‘স্বীকৃতি’ গল্পে একজন অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধার জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। অথচ সেই সব দিনগুলো এখনো তাড়া করে ফেরে মুক্তিযোদ্ধা কফিলকে। যুদ্ধচলাকালে তাঁর বীরত্বগাথা কাহিনী সে সময় যুযোগ পেলেই আওড়াতে থাকে,--এটা যেন তার মানুষিক ব্যধিতে দাঁড়িয়ে গেছে। তাঁর গল্পে আর কারও আগ্রহ থাকে না। কোলরিজের ‘দি রাইম অব দি এ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতার বৃদ্ধ নাবিকটির মত দশা হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধা কফিলের।

‘অপয়া’ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র হাসান। স্বভাবে কবি--বিষণ্ণতার কবি। গল্পের শুরুতে দেখা যায় হাস্যরস (humour) ও বেদনার (pathos) এক অদ্ভূদ সংমিশ্রন। গল্পটি আবদুশ শাকুরের ‘অসুখ’ গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্ষুধায় পেট চন্চন্ করে হাসানের, তবুও সে জীবন নিয়ে কাব্য করতে ছাড়ে না।

পেটের ক্ষুধার সাথে যোগ হয় নারী দেহের কামনা। অনেক কষ্টে সহপাঠী ডেইজীকে পাশে বসাতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। ধরে না রাখতে পারাটাই যেন কবিদের প্রকৃতি। ‘নীল আমার নীল’ গল্পে ব্যক্তি ওয়ালী কিরণের অনেকখানি উন্মোচিত হয়েছে। বইয়ের শেষ গল্প এটি।

গল্পে জানতে পারি--৮ম শ্রেণীতে পড়া কালেই ওয়ালী কিরণের লেখালেখির সূচনা। সে সময় তিনি গল্প-কবিতা দুই-ই লিখতেন। আরো যে জিনিসটি লিখতেন তা হল ডায়েরি, যেটা পরবর্তী জীবনে লেখক হওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ওয়ালী কিরণের ডায়রী একাত্তরের যুদ্ধের দলিল হিসাবেও কাজ করেছে, যার অনেকখানি এই গল্পে প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নীলফামারীতে যে অস্থিরতা বিরাজ করে তার একটা আঁচ আমরা পাই তার অপক্ক হাতের লেখার দিনপঞ্জিতে।

যুদ্ধচলাকালেই কবি ও গল্পকার ওয়ালী কিরণ একটি মেয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন, মেয়েটির কাল্পনিক নাম দেন নীল, নীলকে তিনি তুলনা করে তার কাঙ্খিত স্বাধীনতার সাথে যার দেখা তিনি আজও পাননি। গল্পের শেষটাতে এসে আমরা স্বাধীনতা পাই ঠিকই কিন্তু নীলদের ঠিকানাহীন অনিশ্চয়তা আমাদের মনকে বিষন্ন করে তোলে। গল্পটি লেখা হয় অপরিচিত ঢঙে। একাত্তরের সময় লেখা দিনপঞ্জিকে স্যেঁটে দেওয়া হয় গল্পের খাঁজে--ইতিহাস বর্তমান হয়ে ওঠে সাবলিল ভাবে, নস্টালজিক হয় গল্পকার, নস্টালজিক হয় আমরা। ওয়ালী কিরণের গল্পে নিপূনভাবে উঠে এসেছে শ্রেণীবৈশম্য, গ্রাম-রাজনীতি, পুঁজিকেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থার উল্টো চেহারা, এবং সর্বপরি মানব হৃদয়ের দ্বৈত রূপ ও মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব।

ওয়ালী কিরণ কবি হয়ে উঠার মধ্য দিয়েই আমরা পরিশুদ্ধ সম্ভাবনাময় এক গল্পকারকে হারিয়েছি, হারিয়েছি বলছি এ জন্যই যে তিনি গল্প লেখা ছেড়েছেন বিশ বছর পার হতে চলল। ধরেই নিতে পারি, বর্তমান সময়ে তিনি আরো বেশি পরিপক্ক (matured) এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখার হাত সমধিক তীক্ষ্ণ। গল্প লেখার ধারাটা যদি অদ্যবধি প্রবাহমান থাকতো তাহলে আজ হয়ত গল্পকার হিসাবে আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে যেত, কে জানে হয়ত, তাঁর এই পরিচয়টি কবি পরিচয়কে ছাপিয়ে যেত! তিনি কেন তাঁর এই মেধার প্রতি অবিচার করলেনজানতে বড় ইচ্ছে করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।