মানুষ বাচেঁ তার কর্মে!
যে কথা আর কেউ বলেনি। শুধু একজনই বলতে পেরেছেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। BCS/PSC/BANK JOB ইন্টারভিউ গুলোতে যা হয়...
“ছয়-সাতজন গম্ভীর এবং বিরক্ত মুখের মানুষের সামনে হাসি হাসি মুখ করে বসতে হবে। বিরক্ত মানুষরা সবাই ভাব করবে -তারা সাধারণ কেউ না, তারা অতীশ দীপঙ্কর টাইপ মহাজ্ঞানী।
এদের মধ্যে একজন থাকবে চার্লি চ্যাপলিন ধাঁচের। রসিকতা করার চেষ্টা করবে ,ফাজলামি করার চেষ্টা করবে। কথা বলবে গ্রাম্য ভাষায় । তার ফাঁকে ফাঁকে হটাৎ খাঁটি ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরাজিতে কথা বলবে। বুঝানোর জন্য যে আমি একটু আগে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছি এটা আমার পরিচয় না।
গ্রাম-প্রীতির কারণে কাজটা করেছি।
একজন থাকবে যে-কোনো প্রশ্ন করবে না - তার কাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা । ভাব এরকম যে, আমার প্রশ্ন করার দরকার নেই । মুখের দিকে তাকিয়েই আমি সবকিছু বুঝে ফেলতে পারি।
একজন থাকবে বিজ্ঞান-মনষ্ক টাইপ।
বিজ্ঞানের জটিল সব প্রশ্ন করবে, যার উত্তর দেয়া সম্ভব না । উত্তর না পেয়ে সেই গাধা মাথা নাড়তে নাড়তে মধুর ভঙ্গিতে হাসবে । হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে- এখনকার ছেলেমেয়ে বিজ্ঞানের কিছুই জানে না ।
এতে সে অত্যন্ত ব্যাথিত। ”
(উড়ালপঙ্খি)___হুমায়ূন আহমেদ।
ভাইভা যারা ফেস করেছেন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন লেখক এখানে ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত মহাজ্ঞানী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কথা বলেছেন!
(বিঃদ্রঃ সবাই যে খারাপ একথা বলার কোনো অবকাশ নাই, যারা ভালো তারা সব জায়গাতেই ভালো, শুধু ভাইভা বোর্ডে কেন। কিন্তু, আমি এখানে কিছু লেবাস ধারীদের আচার-আচরণ তুলে ধরব...আমার পরিচিতদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। )
ভাইভা বোর্ডে এরা যে কি পরিমান ভাবের উপরে থাকে তা শুধু ভাইভা বোর্ডে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়, কারণ বাইরের সমাজে তারা এ রুপ দেখায় না। একটা ভালমানুষী লেবাস পরে থাকে।
শুধু তাই নয় সামান্য একটা ভর্তি পরীক্ষার ভাইভাতে তাঁরা যে পরিমাণ নাটক করে তা অচিন্তনীয়।
যে সাব্জেক্ট টাতে পড়তে গেলে কাড়ি কাড়ি টাকা স্টুডেন্টদের কাছ থেকে চলে যায়(অবশ্যই MBA, M-Phil, PHD এই লেভেলের) সেইরকম একটা বিষয়ের বেলায়ও সিলেকশন সিস্টেমের অংশ হিসেবে ভাইভা টাকে রেখে দেয়া হয় যাতে স্টুডেন্টদের সাথে কিছুটা Mind Game খেলা যায়।
যখন একটা স্টুডেন্ট অনেক দিনের পরিশ্রম ও নির্ঘুম রাতের বদৌলতে লিখিত পরীক্ষা নামক বিভীষিকা উৎরায় তখন সেখানে ভাইভা নামক সিস্টেমের গ্যাঁড়াকলে পড়ে স্টুডেন্টদের হতোদ্যম অবস্থা। মাইণ্ড গেমটা তাঁরা শুরু করেন খুবই সন্তোপর্ণে যাতে ভাইভা প্রার্থী বুঝতে না পারে। প্রার্থীরা বুঝতে পারে ভাইভা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর!
ভাইভাতে কি করা হয়?
একজন ছাত্রের Confidence কে যতক্ষণ না তাঁরা তাঁদের দাম্ভিক পায়ের নিচে পিস্ট করতে না পারে ততক্ষণ তাঁরা মাইন্ড গেমটা চালিয়ে যায়। যদি লজিক্যাল Question দিয়ে ঘায়েল করতে না পারে তবে আউল-ফাউল Question করে কিংবা লজিক্যাল Question এর উত্তরে আউল-ফাউল ভুল ধরে তাঁরা অবশেষে জয়লাভ করবেই, প্রার্থী সেখানে অপারগ।
যদিও উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন শুনে তার(প্রার্থীর) একসময় মনে হবে দেই দু-এক কথা শুনিয়ে কিন্তু কোনো উপায় নেই, নাম্বার নামক "পরাণ পাখিটা" যে ওনাদের হাতে বন্দি! তাই সে নিরবে সহ্য করে যায় ভুল উত্তর দেয়ার গঞ্জনা(ভুল উত্তর না দিয়েও!)।
তবু যদি নাম্বার নামক "পরাণ পাখিটা" তার হয়, প্রাইভেট ভার্সিটি তে অনেক টাকা খরচ করা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটার সরকারি ভার্সিটি তে পড়ার চান্স হয় কিংবা এক গ্রাম্য কৃষকের বড় ছেলের চাকরি নামক সোনার হরিণটা ধরা হয়!
B.C.S
ছেঁড়া শার্ট পরা কৃষক বাবার ছেলেটি বিসিএস ভাইভার দিন কাছের বন্ধুর কাছ থেকে একটি ফর্মাল শার্ট, ব্যবহৃত প্যান্ট ও মাঝখানে ভাজ পড়ে যাওয়া জুতো ধার করে তা কালি করে ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হয়। তার তখন একটাই চাওয়া যে করেই হোক এবার চাকরিটা জোগাড় করতেই হবে। আর যে পারা যাচ্ছে না!
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রশ্নের জেরে এসি রুমেও ছেলেটি ঘামতে থাকে। ভাইভা দিয়ে ছেলেটি বেরিয়ে রাস্তায় নামে মেছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির স্মৃতিপটে ভাসে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার সময়ও সে দেখে এসেছে প্রখর রোদ্রে তার বাবা খেতে কাজ করে যাচ্ছে। বাবাকে গিয়ে কি বলবে? একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে, কোনোটায় রিটেনে কোনোটায় ভাইভায় সে বাদ হয়ে গেছে। ভাইভাতে তার কোনো তদবির নেই, কারণ তার কোনো পাওয়ারফুল চাচা-মামা নেই। পাওয়ারফুল চাচা-মামা থাকবে কি, আসলে এই শহরেই তার কেউ নেই, কেউ নেই! এবারও কি তাহলে চাকরিটা হবে না? ভাবতে ভাবতে ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠে।
MBA
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটির মনে ভাসে তার পরিবারের কথা।
তার মায়ের খুব ইচ্ছা- ছেলে সরকারি ভার্সিটি তে পড়বে। অনার্স ভর্তি পরীক্ষার সময় নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় সে হেরে গিয়েছিল। তাই ঠাঁই হয়েছিলো একটি প্রাইভেট ভার্সিটি তে। কিন্তু এবার আর সে হারতে রাজি নয়। যে করেই হোক তাকে MBA তে ভালো একটা সাব্জেক্টে চান্স পেতেই হবে।
আর ভালো সাব্জেক্ট পেতে হলে অবশ্যই ভাইভা ভালো হতে হবে। কিন্তু, একি প্রশ্নকর্তারা তো তাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে! তাই সেও ঘামতে থাকে।
ভাইভা শেষে ছেলেটি দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। তার এখন কোনো কিছু ভাবার অবকাশ নাই। কারণ, তাকে আবার যাত্রাবাড়ীর বাস ধরতে হবে গুলিস্তান গিয়ে।
ভাইভা শেষ হতেই সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। এই টাইমে খুব ভিড় হয় গুলিস্তানে। অফিস ছুটির টাইম। একটা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে হাজার খানেক লোক। তাই সে ভিসি চত্বর থেকে টিএসসি দিয়ে দ্রুত হাঁটা দেয় গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে।
অবশেষে গুলিস্তান পৌঁছে দেখে সেখানে সব কিছু কেমন যেন অস্বাভাবিক...বাসও নেই, মানুষও কম। ব্যাপার কি!... ও... তার মনে পড়ল আজও আগামীকাল লাগাতার হরতাল। তাই ভাংচুরের ভয়ে কোন বাস মালিক বাস নামাতে রাজি নয়। যাও দু-একটা বাস আসছে এগুলো লং ট্রিপের। আর কোথা থেকে যেন ভরে আসে! তাই এগুলোতে উঠার কোনো উপায় নেই।
৭টা বেজে গেছে। এখনও ছেলেটি সহ তার মত অনেকেই বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু বাসায় যাওয়ার কোনো উপায় বের করতে পারে নি। ছেলেটি ভাবল, হেঁটেই রওনা দেবে নাকি যাত্রাবাড়ির দিকে? কিন্তু তার পা দুটো সাড়া দিল না। তারা আজ বড় ক্লান্ত। কিছুটা ফুলা ফুলা ও মনে হচ্ছে।
ভাইভা শুরু হয়েছিল ৩টা থেকে কিন্তু ফর্মের রোল অনুযায়ী তার ডাক এসেছিল পোনে ৬টার দিকে। এতক্ষন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। তাই পা দুটো আর কথা শুনতে চাচ্ছে না! কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে তাও কোনো বাস আসবে কিনা তার কোনো ঠিক নেই। তাই সে হাঁটতে শুরু করল যতদূর এগোনো যায়! হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো, তার ছোট ভাইটির কথা যে কিনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওখানেই একটা মেসে থাকে। তার ছোটো ভাইটিও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে MBA করার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিল।
তার ছোটো ভাইয়ের আশা সে MBA করার পর ভালো একটা চাকরি পাবে।
ছেলেটিরও স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে MBA করে একদিন সে একটা ভালো চাকরি করবে। প্রথম মাসের বেতনের টাকাটা বাবার হাতে তুলে দিতে চাইলেও বাবা হয়ত নিতে চাবে না। তাই সে ঠিক করেছে প্রথম বেতনের টাকাটা পুরো পরিবারের জন্য শপিং ও ভালো একটা রেস্টুরেন্টে সবাই একসঙ্গে খেয়ে খরচ করবে। কিন্তু, আজ MBA ভাইভাতেই তাকে যে পরিমান গলদঘর্ম হতে হল, প্রস্নকর্তারা তার Confidence লেভেল কে যেভাবে শূন্যের কোঠায় আনার অপচেষ্টা করলেন তাতে তার MBA করাটা তো অনিশ্চিতই সাথে সাথে ভবিষ্যতে চাকরি পাবার পথটাও যে কন্টকমুক্ত হবে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়! কারণ, চাকরির ভাইভাতেও যে এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরাই উপস্থিত থাকে!
আর তাই, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেটির চোখও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠে...
মানুষ গড়ার কারিগররা তাদের এই সেন্টিমেন্ট বোঝেন না।
তারা ব্যস্ত মানুষের মন ভাঙ্গার কাজে। তারা এখন মন ভাঙ্গার কারিগর! এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে...যাবে। কত শত ণিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত ছাত্রের দীর্ঘশ্বাসের মূলে যে তাঁরা, তাঁরা কি সেটা জানে?!
নাহ, তাঁরা তা জানেন না। তাঁদের তা জানার দরকার নেই। তাঁরা বাস করেন এক অধরা স্বপ্নপুরীতে।
যেখানে এসব তুচ্ছ সেন্টিমেন্টের কোনো মূল্য নেই!
সেখানে তাঁর কাছে মূল্যবান - আজ তাঁর ছেলের বার্থডে। ভাইভাটা শেষ করেই তাঁকে দ্রুত বাসায় যেতে হবে। ছেলে ফোন করেছে-একসাথে বার্থডে কেক কাটবে! ছেলেটি এবার পঁচিশ বছরে পা দিল। তাই যাওয়ার পথে কোনো গিফটের দোকান থেকে পঁচিশটি মোমবাতি কিনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু, এই মাত্র তিনি ভাইভা বোর্ড থেকে যে ছেলেটিকে চূড়ান্ত অপমান করে বিদায় দিয়ে দিলেন তাঁর বয়সও পঁচিশ বছর, যার ঐ ২৫টি মোমবাতি কেনার টাকা দিয়ে দু’বেলার খাবার হয়ে যায়।
নাহ, তিনি কেন এমন কপর্দকহীন ছেলেকে পাত্তা দিবেন?!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।