আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইভ টিজিং প্রতিরোধে কালের কন্ঠসভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না :: মুনতাসীর মামুন



ইভ টিজিং প্রতিরোধে কালের কন্ঠসভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না মুনতাসীর মামুন 'ইভ টিজিং' শব্দটি এখন আর হালকা কৌতুককর কোনো বিষয় নয়, যেমনটি ছিল তা বাংলা/হিন্দি ছবি বা টিভি নাটকে। যা ঘটছে প্রতিদিন, তা এখন আর ইংরেজি 'ইভ টিজিং' শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। বরং মনে হয়, এখন নারী লাঞ্ছনা শব্দটিই বেশি প্রযোজ্য। নারী লাঞ্ছনা আগে যে হতো না তা নয়, তবে এর প্রকৃতি বা অভিঘান এত মারাত্মক ছিল না। মিডিয়ায় নারী লাঞ্ছনা তখন এমন জায়গা করে নিতে পারেনি।

জনবিস্ফোরণ, মিডিয়ার আধিক্য, প্রযুক্তিগত উন্নতি, সেনসেনালিজম_সব মিলে নারী লাঞ্ছনা এখন শিরোনাম। এর একটি কারণও আছে। নারী লাঞ্ছনার কারণে বালিকা, মহিলা ও পুরুষের মৃত্যু হচ্ছে; যা আগে ঘটেনি। বিএনপি-জামায়াত আমল থেকে খবরে নারী লাঞ্ছনা স্থান করে নিতে থাকে। তখন এর কারণ ছিল।

জোটের ক্যাডাররা দলগতভাবে এই কাজটি করত, যার পেছনে এক ধরনের পরোক্ষ রাজনৈতিক সাপোর্ট ছিল। এখন যেখানে-সেখানে নারী লাঞ্ছনা ঘটছে এবং এর পেছনে রজনৈতিক কোনো সাপোর্ট নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এমন হচ্ছে? বা সংখ্যা এত বেশি কেন? আগেই উল্লেখ করেছি, নারী লাঞ্ছনা এখন এজেন্ডায়_কারণ সংবাদপত্র তাতে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর কারণও আছে। অভাবিতভাবে ম্যালথাসীয় সূত্র অনুসারে তা বাড়ছে।

পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে এ ঘটনার সংখ্যা ৯৫, মামলার সংখ্যা ২০। স্থানীয়ভাবে মিটমাট করা হয়েছে ৩৯টির। অক্টোবরে নারী লাঞ্ছনার ডায়েরি হয়েছে ৩৬টি। মামলা হয়েছে ১০৯ যুবকের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৯৪ জনকে।

সেপ্টেম্বরে পুলিশ অভিযোগ পায় ৮৭টি। মামলা হয়েছে ২৪টির ক্ষেত্রে। সাধারণ ডায়েরি ৯১টি। [যুগান্তর ২.১১.১০] যেটি মর্মান্তিক ও উদ্বেগজনক তা হচ্ছে, নারী লাঞ্ছনাকারীদের বাধা দিতে গিয়ে একজন শিক্ষক, একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে ও কয়েকজন বালিকা আত্মহত্যা করেছে। নারী লাঞ্ছনা কেন ঘটছে, তার অনেক সমাজতাত্তি্বক বিশ্লেষণ দেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে আমি যাব না।

তবে সমাজে যে একটা তোলপাড় চলছে, তা বোঝা যাচ্ছে। শহরাঞ্চল থেকে এ ঘটনা বেশি ঘটছে পুরনো মফস্বলগুলোতে। প্রায় প্রতিদিন নরী লাঞ্ছনা শিরোনাম হওয়ায় সকারও বিব্রত। নারী লাঞ্ছনার অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে, তা হলো অসম সংস্কৃতির বিকাশ। আগে মফস্বল শহরগুলোতে সংস্কৃতির চর্চা ছিল, আকাশ সংস্কৃতি একমাত্র বিনোদন ছিল না, কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ মানসিক বিকাশের একটা মাধ্যম ছিল।

এখন গ্রামেও দেখছি, চায়ের দোকানে ২৪ ঘণ্টা ভিডিওতে চলছে হিন্দি সিনেমা, যার প্রতিটিতে 'ইভ টিজিং' ও পরিণামে প্রেমের বিষয়টি থাকবেই। এবং সেসব ছবি কিশোর ও যুবকরা গিলছে রীতিমতো। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে, সমাজে ভায়োলেন্সের চোরা নদী বইছে। কিশোরীরা সামাজিক বা পারিবারিক চাপ গ্রহণ করতে পারছে না। কোনো ঘটনা ঘটলেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

এক অস্থির সময় পার করছি আমরা। পুঁজিবাদ (ভোগবাদ) জেঁকে বসছে, কিন্তু মানসিক জগৎ আধা সামন্তবাদী বা পুরোপুরি সামন্তবাদী, প্রকট ধন-বৈষম্য, চলছে রাজনৈতিক সংঘাত, সবচেয়ে বড় কথা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি এক অস্থির সমাজের সৃষ্টি করছে। সামাজিক স্থিরতা আসতে কত সময় লাগবে জানি না। একটা ধারণা বোধ হয় হয়েছে, ইভ টিজিং মারাত্মক কিছু নয় এবং অপরাধ হলেও পার পাওয়া যাবে_কারণ কেন্দ্রের হাত সেখানে তেমন শক্তিশালী নয়। নারী লাঞ্ছনা প্রশমনে সমন্বিত আইন প্রণয়নের কথা হচ্ছে।

আদালতও প্রশাসনকে সতর্ক করছেন। নারী লাঞ্ছনা মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিকতারও অভাব নেই। কিন্তু আইন প্রণয়ন ও তার আওতায় নারী লাঞ্ছনাকারীদের বিচার এবং শাস্তি কার্যকরের সময় কত লাগবে জানি না। এ দেশে প্রশাসন চলে শম্বুকগতিতে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, নারী লাঞ্ছনার ঘটনা এবং লাঞ্ছনাকারীদের ধরা হচ্ছে।

মিডিয়ায়ও আসছে, তার পরও নিয়ত এ ঘটনা ঘটছে। এর অর্থ, লাঞ্ছনাকারীরা এসবের খবর রাখে না এবং রাখলেও ধার ধারে না। তাহলে অনতিবিলম্বে কী করা যেতে পারে? অন্য আইনে ধরলে, হিউম্যান রাইটস চর্চাকারীরা লাঞ্ছনাকারীদের মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে বিবৃতি দেওয়া শুরু করবে। নারী লাঞ্ছনা রোধের সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধে গুরুত্ব আরোপ করা যেতে পারে, তবে তা সময়ের ব্যাপার।

সংস্কৃতির সমবিকাশ না হলে তা সম্ভব নয়। আপাতত নারী লাঞ্ছনাকারী ও তাদের পরিবারের মধ্যে শাস্তির ভয় জাগাতে না পারলে এটি রোধ সম্ভব নয়। ধারণা জন্মেছে, নারী লাঞ্ছনার শাস্তি সামান্য, গ্রেফতারের পর জামিন হয়ে যায় তখনই। এ ধারণা বদলে দিতে হবে। প্রয়োজন এখন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখে দ্রুত বিচার আইনে [যাতে মাসখানেকের মধ্যেই মামলার নিষ্পত্তি ঘটবে] লাঞ্ছনাকারীদের বিচার করে শাস্তি বিধান করা এবং প্রবলভাবে তা প্রচার করা।

অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে তা বিবেচনায় আনতে হবে। যে থানায় এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, সে থানার ওসি যদি এর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে_এ ধরনের বিধান রাখা বাঞ্ছনীয়। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রে এখন আমরা কেউ কোনো কিছুর দায়িত্ব নিতে চাই না। সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে এই প্রতিবাদও প্রবল হয়ে ওঠা উচিত যে সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে এ ধরনের নারী লাঞ্ছনার বিষয় চলতে পারে না। সমাজ ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগই আপাতত নারী লাঞ্ছনা বা 'ইভ টিজিং' হ্রাস করতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইতিহাসবিদ সূত্র : Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।