আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

:::: ঝুম বৃষ্টিতে নিঝুম দ্বীপে... :::::

::::: দেখবো এবার জগতটাকে :::::
ঈদের পরদিন যাত্রা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল খাঁ খাঁ করবে ভেবেছিলাম। গিয়ে দেখি এ কি? তিল ঠাই আর নাহি রে। লোকের ভীড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। ধাক্কাধাক্কি করে ঘাড়ে বিশাল ব্যাকপ্যাক, তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ আর দু'হাতে দুটো লাইফ জ্যাকেট নিয়ে কিভাবে জানি লঞ্চে উঠে গেলাম।

টোটাল ৩২ জন। ভ্রমন বাংলাদেশের নিয়মিত এবং আমার মতো অনিয়মিত সদস্য। লঞ্চে তো উঠলাম, কিন্তু লঞ্চ ছাড়ে না। লোক উঠতে উঠতে যখন প্রায় ডুবু ডুবু তখন ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। এবারে দেখি বেরুতে পারে না।

আমাদের লঞ্চের পিছে আরেকটা লঞ্চ, তার পিছে একটা জেটি থেকে বেরুবে ওটার পিছে আরেকটা জেটিতে ঢুকবে, তার দুপাশে আরো দুটো ঢুকবে না বেরুবে মনে হয় ডিসিশান নিতে পারছেনা। আমাদের সারেং বেশী বুদ্ধিমান প্রমান করে ইঞ্জিনের জোর ধাক্কা দিয়ে সবগুলোকে হটিয়ে দিতে চেষ্টা নিল, কিন্তু কিছুই হলো না, আমাদের প্রায় ডুবু ডুবু লঞ্চটা প্রায় ৪৫ডিগ্রি কাত হয়ে উলটো দিকে ডুবে যাবার ভঙ্গি করলো। লঞ্চ ডুবতাছে, বাঁচাও, বাঁচাও হাবিজাবি চিৎকার দিতে দিতে একদল লোক লাফিয়ে পাশের লঞ্চে আর সামনের জেটিতে পালিয়ে গেল, আরেকদল যে দিকটা প্রায় ডুবু ডুবু সেদিকে ওজন বাড়াতে উৎসাহে ঝুঁকে পড়লো, লঞ্চের কয়েকজন লোক ভীষন মোটা মোটা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসলো, ঐ কোন ব্যাটায় চিল্লায়, কেউ জায়গা থিকা নড়লে মাইরা হাঁটুর গেটি খুইল্লালামু। মহা শোরগোলের সাথে লঞ্চটা অবশেষে খোলা বুড়িগঙ্গায় সাঁতার দিতে পারলো, বিস্ময়করভাবে ডুবলো না। নিঝুম দ্বীপ মনপুরা (সিনেমার নাম হলেও শুটিং কিন্তু এই দ্বীপে হয়নি) ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে।

পথে আড্ডাবাজি করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বাসা থেকে ফোনে জানলাম সাগরের অবস্থা খারাপ, কই জানি একটা নিম্ন বা উচ্চচাপ তৈরি হইছে, সেটা যখন তখন ঘূর্ণীঝড়ে পরিবর্তিত হতে পারে। ৩নাম্বার সঙ্কেত দিছে। বরিশালের পর থেকেই টুপটাপ বৃষ্টি, মাঝে মাঝে দূর আকাশে কালোমেঘের ফাঁকে আকাশে বজ্রপাতের আভা। মনপুরায় গিয়ে দেখি তুমুল বৃষ্টি। অনেকক্ষন এখানে লঞ্চ আটকে থাকে।

খারাপ আবহাওয়ায় নাকি মাছ বেশী ধরা পড়ে, তাই জেলেদের বিকার নেই, লাল-নীল, সবুজ-হলুদ, বহুবর্ণা নৌকার পাল মেঘনার বুকে। লঞ্চের শেষ স্টপেজের নাম তমিরুদ্দিন (আরেকটা বড় ঘাট আছে তমিজুদ্দিন, এটা সেটা না)। এখানে নেমে আমরা ঝুম বৃষ্টিতেই নেমে গেলাম ব্রেকফাস্টে। ঘাট থেকে বাজার বেশ খানিকটা দূরে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গ্রামের বাজারে একটু বেড়িয়েও নেয়া হলো।

নাস্তা শেষ হতেই আগে থেকে ঠিক করা ট্রলারটা এসে হাজির। পাটাতনে ইলিশ রাখার স্টোরেজে ব্যাকপ্যাকগুলো তুলে দেয়া হলো। আর সবাই উপরে বসে পড়লাম। কয়েকটা লম্বা পলিথিনের ভেতরে সবাই গুটিশুটি মেরে রইলো বৃষ্টির জন্যে। বিশাল মেঘনা দু'পাড়ে কুলহারা জল।

আর বৃষ্টির তো থামাথামি নেই। ভাটার পক্ষে ভেসে ভেসে আমরা নিঝুম দ্বীপে নামলাম দুপুরের দিকে। ভাটার জন্যে নৌকা ঘাটে যাচ্ছিলোনা। আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলে খালি নৌকা মাল নিয়ে ঘাটে ভিড়তে পারলো। নামতে না নামতেই আছাড় খেয়ে উলটে পড়লাম, আর তা দেখে মনা ভাই হাসতে শুরু করলো গলা ফাটিয়ে, হাসি অবশ্য শেষ হলো না তার আগে সে নিজেও চিৎপটাং।

এরপরেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর যাত্রা। ক্যাম্পিংএর প্রস্তুতি। অতিথী। পুরো রাস্তাতেই হাঁটু কাদা। সেই কাদা ভেঙ্গে ঘাড়ে বিশাল সব বস্তা নিয়ে হাটছিতো হাটছি।

দূরত্ব মোটে মাইল তিনেক, কিন্তু থিকথিকে কাদায় আছাড় খেয়ে ভূত বনে যাওয়ায় সময় লাগলো কয়েকগুন। ধু ধু প্রান্তরভরা চষাক্ষেতের মাঝে একটা সাইক্লোন সেন্টার আমাদের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। টেন্ট পিচ না করেই সব জিনিসপত্র রেখে লাফ দিলাম পুকুরের মাঝে, ঝুপ ঝাপ সাঁতার কেটে তবেই স্বস্তি। আমরা পানি থেকে উঠতে উঠতে দেখি অনেকেই তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। চিপা চুপা বাইর করে কোনমতে তাঁবু খাটিয়ে নিলাম, গোছগাছ করতে করতেই দুপুরের খাবার ডাক এলো।

ভাজা ইলিশ আর ভুনা খিচুরী। খেয়ে দেয়ে সবাই যার যার মতো ব্যাস্ত। আমি নেমে গেলাম সামনের চষা ক্ষেত ধরে। দূরে দিগন্তের কাছে নিঃসঙ্গ একটা কুড়ে ঘর, চারপাশে কচি ধানের কার্পেট অসীমে মিশে গেছে, তারো অনেক দূরে আবছা ভাবে মেঘনা চ্যানেল... আর কিছু দেখা যায়না। কিন্তু কাদার কারনে খুব বেশী দূর যেতে পারলাম না।

তার আগেই আলো মলিন হতে থাকলো, অন্ধকারে এই কাদা পথে ফিরতে সমস্যা। রাতে প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। মনে হচ্ছে তাঁবু উড়িয়েই নেবে। ফাঁপা তাবু ঝোড়ো হাওয়ায় নাটাই-ছেড়া ঘুড়ির মতো উড়াল দিতে চায়। ভেতরে আমরা আছি এত ওজনের জিনিসপত্র আছে সে ব্যাপারে যেন কুছ পরোয়া নাই।

বাধ্য হয়ে তাঁবুর সদর দরজা আর ছাঁদ হা করে খুলে দিলাম। সামনে দিয়ে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে ছাঁদ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম অনেকে তাঁবু গুটিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের ভেতরে চলে যাচ্ছে। কয়েকজন নাছোড়বান্দার মতো পড়ে রইলাম। প্রচন্ড আকাশের গর্জন আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে পাশের তাঁবুতে কার যেন নাক ডাকার সিংহ নিনাদ।

সে এক ভীষন কালরাত্রি। সকাল বেলা দেখলাম রাতের বেলার হালকা ঝড়ের ভয়ঙ্কর ঝাপটা। কিন্তু বৃষ্টিতো আর ধরেনা। ভয়ঙ্কর বৃষ্টির কারনে সেদিনের সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। দুপুর নাগাদ বৃষ্টি ধরে এল, রোদ উঠে গেল, কিন্তু আমাদের দিনটা নষ্ট হলো।

আমাদের ছোট নদী... (এটা একটা খাল, এর পাশেই আমাদের ক্যাম্প) (ছোটবেলায় একটা পাউডার মিল্কের এ্যাডে এমন ছবি দেখছিলাম, সম্ভবত নিউজিল্যান্ডের। ) দুপুরের খাওয়া দাওয়াটা হলো অনেক কঠিন। সকাল বেলা আলো ফোটার পরে বৃষ্টি আর থামে না। একটানা চললো দুপুর পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল।

প্ল্যান ছিল নৌকা নিয়ে দ্বীপের আশেপাশে ঘুরবো। টিপটিপ বৃষ্টিতেই পুকুর ঘাটে নেমে গেলাম। নামতেই শুরু হলো আবার ঝুম বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টির ঝুপঝাপ শব্দের মাঝে পানিতে কান ডুবিয়ে সাঁতার দেবার অন্যধরনের মজা আছে। একটু পরে দেখি দলের সবাই পানিতে।

সাঁতার প্রতিযোগীতা হলো, যারা সাঁতার জানেনা তাদের কয়েকজনকে সাঁতার শেখাতে ব্যাস্ত হলেন মনা ভাই (নিজেই সাঁতার জানেননা, লাইফ জ্যাকেট পড়ে নেমেছেন)। দুপুরে খিচুড়ী আর চিংড়ি ভাজা দিয়ে গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়ে হেলে দুলে বিকেলে সবাই বেরুলাম জঙ্গলের দিকে। বর্ষায় রাস্তাঘাটের কোন বালাই নেই। দ্বীপের অবকাঠামোর অবস্থাও তথৈবচ। আগেই বলেছি কোন পাকা রাস্তা নেই।

ব্রীজগুলোও শুধু নিচে একটা বাঁশ আর উপরে একটা বাঁশ। গরমের দিনে কি অবস্থা হয় জানি না, মেঘলা আকাশে সূর্যের আলোর লুকোচুরি আর ওপাশের বেলাভূমি থেকে আসা উত্তাল হাওয়া। অসাধারণ। বিকেল বেলায় আমরা বেরুলাম। কর্দমাক্ত রাস্তা।

ব্রীজ-ট্রিজের কোন বালাই নেই। গ্রামের মধ্য দিয়ে রাস্তা, একটু পর পরই খাল পড়ছে, আর তার উপরে পায়ের জন্যে একটা বাঁশ আর হাতে ধরার জন্যে একটা বাঁশ এমন সব ব্রীজ। আশেপাশে দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠ। দূরে বেলাভূমি থেকে উত্তাল হাওয়া বারবার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। পথের শেষ মাথা থেকে জঙ্গল শুরু হয়েছে।

ছবি তুলতে তুলতে পিছিয়ে পড়েছিলাম। প্রথমদলকে বাইপাস করে আমরা আরেকদিক দিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। খুব কায়দা করে পা ফেলতে হয়। তার উপরে ম্যানগ্রোভের বিরক্তিকর শ্বাসমূল।

খালের পাশে প্রায়ই দেখা যায় উভচর চিড়িং মাছ (ইংরেজীতে এটাকে বলে মাডস্কিপার, অল্প কাদাপানিতে থাকে, কিন্তু বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নেয়, বিবর্তনের ধারায় একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সত্তা )। খালের প্রতিটা সংযোগ বিন্দুতে জাল বসিয়ে জেলেরা ইঁচামাছ (চিংড়ি ধরে)। রাতে থাকার জন্যে তাঁবু আকৃতির ছোট ছোট ছাউনি মাচার উপরে। ভেতরে খাবার পানি, শুকনো খাবার, কুপি বাতি। স্বপ্নের ট্রি হাউজের মতো।

মেঘনা পাড়ের বাড়ী। আমাদের ক্যাম্প থেকে দেখা সবচে' পরিচিত দৃশ্য। জঙ্গলের ভেতরে ঘন্টাখানেক ঘোরা হলো। সূর্যের আলো নিভতে শুরু করায় ফিরতে শুরু করলাম। তাছাড়া বদমাশ কুকুরগুলোও বের হয়ে গেছে।

কেমন করে যেন তাকায়। আমার দূর্ভাগ্য, দলের মোটামুটি সবাই হরিণ দেখলেও আমার ভাগ্যে জুটলো লবডঙ্কা। কয়েকবার দূরে সোনালি ঝিলিক মেরে হরিণের দল লাফিয়ে পালিয়ে যেতে দেখলাম। ফেরার পথে অনেকক্ষন সবাই বেলাভূমিতে ঘোরাঘুরি করলাম। বাংলাদেশের সেরা বীচ নিঃসন্দেহে সেন্টমার্টিন, এরপরে দুবলার চর, কুয়াকাটা, এর পরেই নিঝুম দ্বীপ।

রাতে আড্ডাবাজি করতে করতে দেরী হয়ে গেল। সবাই মিলে সকাল বেলা জঙ্গল ট্রেক হবে। আর গোপনে কজন মিলে ঠিক হলো সূর্যের আলো ফোটার আগেই জঙ্গলে ঢুকবো। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। রাতে আবারো তুমুল ঝড় শুরু হলো।

আজকের ঝড় আরো মারাত্মক। কিছুক্ষন পরে প্রথমে মাসুদ ভাই তার তাঁবু গুটিয়ে উঠে গেল সাইক্লোন সেন্টারে, তার পরে পিছু পিছু কামরুলও গেল। আমার তাঁবু পার্টনার রানা আমাকে ঘুম থেকে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে বলে, সবাই ভাগতেছে, চলেন ভাগি। আমি আলসেমীর চোটে উঠতে চাইলাম না। কি আর হবে।

সুবহে সাদিকের দিকে আর শুয়ে থাকার জো রইলো না, উঠে দেখি সব কিছু লন্ডভন্ড। প্রচন্ড ঝড়, শক্তিশালী ধাক্কা দিয়ে গেছে। ভোরের দিকে যখন টেন্টের ফ্রেম বাতাসের চাপ সহ্য করতে না পেরে মটমট করছে, তখন বাধ্য হয়েই তাঁবু গুটিয়ে ফেললাম, তেমন সুযোগ পেলাম না, ব্যাকপ্যাক আর যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে লন্ডভন্ড তাবুর সাথে নিজেরাও ভিজতে লাগলাম। (আগামী পর্বে সমাপ্য)... 'মেঘনার ঢল' নামে একটা কবিতা স্কুলে পাঠ্য ছিল, প্রথম লাইনটা মনে হয় এমন - শোন মা আমিনা, তরা করে মেঘনার জল নিয়ে আয়। অবশেষে হরিণের দেখা মিললো।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।