আমি সুমাইয়া বরকতউল্লাহ। ছাত্রী। লেখালেখি করা আমার ভীষণ পছন্দ। আমি ছড়া, গল্প লিখি। পত্রিকায় নিয়মিত লিখি।
লেখালেখি করে বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছি। শিশু অধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ (প্রিণ্ট মিডিয়া) পর পর ৩ বার জাতিসংঘ-ইউন ঢং ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে। স্কুল ছুটি হয়। সবাই কাস থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে চলে যায় গেটে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ওদের মায়েরা।
ওরা ছুটে গিয়ে মায়ের কোমর পেঁচিয়ে ধরে। মায়েরাও ওদের আদর করে, চুমু খায়। নিজের হাতে ওদের মজা খাইয়ে দেয়। তারপর ওদেরকে নিয়ে চলে যায় বাসায়।
বিন্তি পড়ে থাকে সবার পেছনে।
অন্যদের মতো সে দৌড়ায় না, খুব আস্তে করে হাঁটে। পা চলে না তার।
বিন্তির মা নেই। সে জানে তার জন্য গেটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। তাই সবাই চলে যাওয়ার পর সে একা একা স্কুল গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তার মন থাকে মরা মরা।
বিন্তির মা থাকতে প্রতিদিন তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল ছুটি হলে তাকে আবার নিয়ে আসতেন বাসায়। ছুটি হওয়ার আগেই মা তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটে। সেও এক দৌড়ে মায়ের কোলে গিয়ে পড়ত।
মা তাকে দেখে প্রায়ই বলতেন, খুব খিধে পেয়েছে বুঝি, মুখটা এতো শুকনা লাগছে কেন মা? এ কথা বলেই মা কোন না কোন খাবার দিতেন তার মুখে। সে মজা করে খেত। তারপর রিক্সা করে মায়ের সাথে চলে যেত বাসায়। রিক্সা থেকে যাতে না পড়ে যায় সে জন্য তার মা তার সামনে হাত দিয়ে ধরে রাখতেন। রিক্সাটা ধাক্কা খেলে মা তাকে খাবলে ধরতেন আর চোখ বড় করে বলতেন, এখনই তো পড়ে মরতি।
শক্ত করে বসে থাকতে পারিস না, পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ্গে তো লুলা হবি। মা তাকে খুব সাবধানে নিয়ে আসতেন বাসায়।
স্কুলে যাওয়া ও আসার সময় সে মায়ের সাথে অনেক গল্প করত। হাসি তামাশা করত। মা তার গল্প শুনতেন আর বলতেন মুখের খাবারটা আগে খেয়ে নে তো, এত কটকট করিস না।
সে তবুও কথা বলত মায়ের সাথে। সে মায়ের সাথে অনেক দুষ্টুমিও করত। সে মায়ের ্ওপর একটা পা আর একটা হাত রেখে ঘুমাতো। মা কখনো রাগ করতেন না। মা তার মাথার চুল গুছিয়ে দিতেন।
আদর করে গাল টিপে দিতেন। তার কপালে চুমু খেতেন। মা ছিলেন তার বন্ধুর মতন।
এখন প্রতিদিন ড্রাইভার এসে তাকে গড়িতে করে নিয়ে যায় স্কুলে। গাড়িতে বসে সবাই হৈ চৈ করে।
বিন্তি কোন কথা বলে না। একদম চুপচাপ বসে থাকে। মন খারাপ থাকে তার।
বাসায় মা নেই। তাই স্কুল থেকে ঐ বাসাটায় ফিরতে তার একদম ভালো লাগে না।
বাসায় ফেরার সময় মনে মনে বলে, গাড়িটা যদি নষ্ট হয়ে যেতো। না, গাড়িটা নষ্ট হয় না। চলে। আবার বলে, গাড়িটা যদি কোথাও হারিয়ে যেতো। না, হারায় না।
ঠিক চলে আসে বাসার গেটে। সে তখন সিড়ি বেয়ে চার তলায় উঠে। কলিং বেলটা টিপ দেয়ার আগে মনে মনে বলে, বেলটা টিপলেই যদি মা এসে দরজাটা খুলতেন। কিন্তু দরজাটা খোলেন তাদের বুয়া ঝরনা।
একদিন ঝরনা দরজা খুলে কেমন জানি একটু মুচকি হাসি দিয়েছিল।
তখন তার মনটা ধক করে উঠলো। তার মনে হলো কোন রহস্য আছে। তাকে সারপ্রাইজ দিতে চায় বোধ হয়। সে এক দৌড়ে গিয়ে বাথরুম, কিচেনরুম ও বারান্দায় চুপি দিয়ে দেখল মা এসে কোথাও লুকিয়ে আছেন কি না। না, নেই।
তারপর সে দরজার চিপায়, খাটের নিচে, আলনার পেছনে মাকে খোঁজে। না কোথাও মা নেই। তারপর কাঁধের ব্যাগটা রেখে চুপ করে বসে থাকে। কষ্টে তার বুকটা ভেঙ্গে যেতে চায়।
পাঁচ বছর হলো সে তার মাকে হারিয়েছে।
এরপর সে আর মাকে মা বলে ডাকতে পারেনি। তার খুব ইচেছ করে মা, মা বলে ডাকতে। তাই সে যখন একা থাকে তখন মাকে ডাকে। বাথরুমে গেলেও সে মা, মাগো বলে ডেকে ডেকে অনেক কথা বলে।
সে ক¤িপউটারে প্রায়ই একটা গান শোনে।
গানটি শোনে আর কাঁদে। সে মায়ের ছবি আঁকে। মাকে চিঠি লিখে। ‘মা, তোমাকে খুব মনে পড়ে মা। তোমার জন্য খুব কষ্ট হয় আমার, খুব কষ্ট।
’ মা আসে না তার।
সে পরের দিন মনে করে মা বোধহয় তার চিঠির জবাব দিয়েছেন। ক¤িপউটারটা অন করে খোঁজে মায়ের চিঠি। কিন্তু না কোনো জবাব আসেনি। তখন সে নিজেই মা হয়ে তার চিঠির জবাব লিখে।
আর পড়ে। এভাবে সে প্রতিদিন মায়ের কাছে চিঠি লিখে, চিঠির জবাব লিখে আর বারবার পড়ে।
মা থাকতে তার ভাইয়া তাকে খুব জ্বালাতন করতো। খাইতে, পরতে হিংসা করতো, এটা সেটা নিয়ে রোজ ঝগড়া করতো। মারতো।
সেও খামছি দিত ও থুতু দিত ভাইয়াকে। এখন ভাইয়া তাকে আর মারে না। আদর করে। স্কুল থেকে এসেই তার হাতে একটা চকোলেট দেয় আর বলে মায়ের জন্য চিন্তা করিস না। দেখস না, আমি তোকে আর মারি না, আদর করি।
একদিন তার ভাইয়া তার জন্য একটা বিড়াল ছানা এনে দিয়ে বলে, এই নেও তোমার সঙ্গী। বিন্তি বিড়ালছানা পছন্দ করে খুব। সে বিড়ালছানা পেয়ে তো মহা খুশি। খুব আদর করে। ছানাটির নাম রেখেছে পুশি।
পুশি তার ভালো সঙ্গী এবং মিষ্টি বন্ধু।
কিছুদিন পর তার ভাইয়াটিও পড়ালেখা করতে চলে গেল অনেক দূরে। একা হয়ে গেল বিন্তি। ছোট্ট একটা মেয়ে বিন্তি। অনেকগুলো কষ্ট তার।
বিন্তি দাদু বাড়ি যাওয়ার সময় পুশিকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় কেউ বলেছে ইশ্, শহর থেকে কোলে করে বিড়াল নিয়ে এসেছ, আরে বেটি খামচি দিবে তো। কেউ বলেছে বিড়ালকে এতো আদর করতে নেই, এতে ডিপথেরিয়া রোগ হয়।
সে কারো কথাই শুনেনি, ভয়ও পায়নি। সে পুশিকে অনেক আদর করে আর ভালোবাসে।
কারণ পুশির সাথে তার একটা মিল আছে। তার মতো পুশিরও মা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।