يا ايهاالذين آمنوا انما الخمر والميسر والانصاب والازلام رجس من عمل الشيطان فاجتنبوه لعلكم تفلحون-
তরজমাঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা, লটারী খেলা নিতান্ত গর্হিত কাজ, অতএব তোমরা তা পরিহার কর, তাহলে কামিয়াব হতে পারবে। (মায়েদা-৯০)
পূর্বাপর সম্পর্ক
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য ৪টি বস্তু হারাম ঘোষণা করেছেন, বস্তুত প্রথম দুটি বস্তু (মদ ও জুয়া) হারাম করাই আল্লাহ তায়ালার মূল উদ্দেশ্য। কেননা এখানে মুমিনকে সম্বোধন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর কোন মুমিনের পক্ষে মুর্তি পূজা সম্ভবপর নয়। তবে যেহেতু এ চারটি কর্মই মন্দ এবং নিকৃষ্টতার দিক থেকে অতি কাছাকাছি তাই এগুলোকে একত্রে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাছাড়া মদ-জুয়ার সাথে পরের দু’টি (মূর্তি পূজা ও লটারী খেলাকে) উল্লেখ করে এগুলোর মন্দতা ও নিকৃষ্টতা সুনিশ্চিত বলে বুঝানো হয়েছে। নতুবা এ ৪টি বস্তু এক পর্যায়ের নয়। এ কারণেই পরের আয়াতে শুধু মদ-জুয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং অপর দুটির আলোচনা পরিহার করা হয়েছে। (তাফসীরে কাবীর ২য় খন্ড, পৃঃ ৪২৮)
পূর্ববর্তী আয়াতে হালালকে হারাম মনে না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং পরের আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে এগুলোর দুনিয়া ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে। আর এ আয়াতে হারামকে হালাল মনে না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হালালকে হারাম মনে করা যেমনি চরম গুনাহ অনুরূপ হারামকে হালাল জানাও মারাত্মক গুনাহ ও অপরাধ।
আলোচ্য আয়াতে নিষিদ্ধ ৪টি বস'র ২টি বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে।
১. رجس এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছেঃ নোংরা বা মন্দ কাজ ইত্যাদি। সুতরাং রিজ্স বলতে সেই কাজকে বুঝায় যা মন্দের এবং নোংরার চরম সীমায় উপনীত। যা সর্বজনীন স্বীকৃত মন্দ ও নিন্দনীয়।
২. এগুলোকে (من عمل الشيطان) শয়তানের কাজ বলে অবহিত করা হয়েছে। এ বৈশিষ্ট মূলত রিজস এর পরিপূরক। কেননা শয়তান নাপাক এবং মন্দ। যেহেতু সে কাফের। আর সকল কাফের হচ্ছে নাপাক।
(انما المشركون نجس- توبة ۲۸) আর মন্দরা লোকদের মন্দের দিকেই নিয়ে যায়। তাই শয়তানের কাজ মন্দ। (তাফসীরে কাবীর ২য় খন্ড ৪২৩ পৃষ্ঠা)
পরবর্তী আয়াত انما يريد الشيطان ان يوقع بينكم العداوة الخ এর মধ্যে মদ-জুয়ার দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মদ-জুয়ায় দু’ধরনের ক্ষতি রয়েছে। (১) পার্থিব ক্ষতি (২) দ্বীনি বা ধর্মীয় ক্ষতি।
এ আয়াতের প্রথমাংশে পার্থিব এবং শেষাংশে ধর্মীয় ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মদ-জুয়ার পার্থিব ক্ষতি হল- পরস্পর শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি হওয়া।
যেভাবে শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি হয়
সাধারণতঃ একাধীক লোক একত্রিত হয়ে মদ পানের আয়োজন করে, আর এ মদ পানের দ্বারা উদ্দেশ্য হল- বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তি, গল্প-গোজব, গান-বাজনা ও অশ্লীল কর্মকান্ডে সময় ব্যয় করা। কিন্তু যখন মদ পানে জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায় তখন বিবেকের কর্ম ক্ষমতা চলে যায়। ফলে হাসি-খুশি রূপ নেয় ভয়ংকর আকারে।
সাথীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্ক অতঃপর শুরু হয় মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। পরবর্তীতে নেশাগ্রস- অবস্থায় মারামারি, দ্বন্দ্ব-কলহ স্থায়ী শত্রুতায় রূপ নেয়। এতে সামাজিক নিয়ম-শৃংখলা ব্যাহত হয় চরমভাবে।
অনুরূপ জুয়া খেলার উদ্দেশ্য মাল হাসিল করা। এখানেও একাধিক লোকের সমাগম ঘটে।
ফলে কারো না কারো মাল হারিয়ে যায়। লাভের স্থলে পুঁজি নিয়ে টানাটানি ঘটে। এক সময় সে সম্পদহারা হয়ে ঘুরে। ঠিক তখনই জুয়া খেলায় বিজয়ী বন্ধুদের প্রতি শত্রুতার সৃষ্টি হয়। অতঃপর মারামারি, হানা-হানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়।
মদ-জুয়ার ধর্মীয় ক্ষতি
আয়াতের শেষাংশে মদ-জুয়ার যে ক্ষতিগুলো আলোচনা করা হয়েছে তা হল- এগুলো মানুষকে আল্লাহর জিকির এবং নামায থেকে বিমুখ করে দেয়। কেননা মদ পানের দ্বারা মানব শরীরে আনন্দ উল্লাসের সৃষ্টি হয়। আর শরীর যখন আনন্দ-উল্লাসে নিমজ্জিত হয় কিংবা জ্ঞান হারিয়ে যায় তখন মানুষ আল্লাহর জিকির হতে বেখরব হয়ে পড়ে। অনুরূপ জুয়া দ্বারাও জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিমুখ হয়ে যায়। আর আল্লাহর জিকির এবং নামায তথা তার ইবাদত থেকে বিমুখ হওয়া বান্দার ধর্মীয় চরম অবনতি।
(তাফসিরে কাবীর ২য় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১৪৪-১৪৫)
প্রেক্ষাপট
তদানিন্তন আরব সমাজ মদ-জুয়াকে হালাল ও উত্তম মনে করতো। আরবরা এ বস্তুগুলোর সাথে ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ঘরে ঘরে ছিল মদ আর জুয়ার আড্ডা। নর-নারী, মূর্খ-পণ্ডিত, ধনী-গরিব, আবাল বৃদ্ধ বনিতার ভেদাভেদ ভুলে সকলে জমায়েত হত মদ-জুয়ার জমজমাট আসরে। কোথাও কোন ভোজনের নিমন্ত্রন বা লোক সমাগম মানেই ছিল মদ-জুয়ার আয়োজন।
উক্ত আয়াতে এসকল বস্তু চরম ঘৃণ্য, মন্দ এবং নিন্দনীয় হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এগুলোকে চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
যে সব কারণে মদ-জুয়া হারাম হলঃ
আলোচ্য আয়াতে মদ-জুয়া হারাম হওয়ার কয়েকটি কারণ লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে চারটি কারণ তুলে ধরা হল। ১ (رجس) এ গুলো রিজস বা সার্বজনীন স্বীকৃত মন্দকর্ম। ২. শয়তানের কাজ।
৩. فاجتنبوه শব্দটি আদেশ সূচক ক্রিয়া। (তোমরা এগুলো হতে দুরে থাক) যা পালন করা অপরিহার্য। ৪. لعلكم تفلحون (তাহলে তোমরা সফলকাম হবে) এ কাজগুলো ত্যাগ করা সফলতা বা জান্নাত লাভের উপায়।
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
রিজস (رجس) ঐ সকল কাজকে বলা হয় যা সকলের নিকট ঘৃণ্যও নিন্দনীয়। যা কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি করতে পারে না।
সুতরাং একাজগুলো সর্বজন স্বীকৃত মন্দ ও গর্হিত হওয়ার কারণে, তা কোন মুমিন করতে পারে না। তাই এগুলো হারাম।
২. এগুলো শয়তানের কাজ
এ কাজগুলোকে শয়তানের বলে অবহিত করা হয়েছে। শয়তানের কাজ হওয়ার অর্থ হল শয়তান একাজগুলো দ্বারা মানুষকে আল্লাহর যিকির তথা তার ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যা শয়তানের মূল উদ্দেশ্য। তা ছাড়া এ বস্তুগুলো দ্বারা মানুষ বিভিন্ন অপরাধ এবং ফিতনা-ফাসাদে জড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে নানা কলহ ও দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি করে।
সুতরাং যে সকল কাজ মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ করে দেয় এবং ফিৎনা ফাসাদের সৃষ্টি করে তা কখনো মানুষের জন্য হালাল হতে পারে না।
৩. উক্ত কর্মগুলো থেকে মুক্ত এবং দূরে থাকার ক্ষেত্রে আল্লাহপাক (فاجتنيوه) আদেশ সুচক ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। আদেশ সূচক ক্রিয়ার দ্বারা কর্ম পালন অপরিহার্য হয়ে পড়ে, সুতরাং এ বস্তু থেকে দূরে থাকা এবং এগুলো পরিহার করা অপরিহার্য বিষয় আর এগুলোতে জড়িয়ে পড়া হারাম।
৪. আল্লাহ তায়ালা আয়াতের শেষ পর্যায়ে উক্ত কর্মগুলো থেকে বিরত থাকা বা এগুলো পরিহার করাকে সফলতা বলে অবিহিত করেছেন। মুমিনের সফলতার সর্বোচ্চ শিখর হল দোযখ হতে মুক্তি লাভ এবং জান্নাতে প্রবেশ সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি।
বুঝা গেল একাজগুলোতে নিমজ্জিত হলে সফলতা সম্ভব নয়, সুতরাং যে কাজ মুমিনের সফলতা বা আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্তরায় হয় তা হারাম এবং বর্জনীয়। (তাফসীরে কাবীর ২য় খন্ড- পৃষ্ঠাঃ ১৪৫)
মদ কি এবং কিভাবে তা হারাম হল?
মদ এর আরবী শব্দ হল ‘খমর’। খমর এর আভিধানিক অর্থ- ঢাকা, লুকানো বা আবৃত করা। মদ যেহেতু মানুষের জ্ঞানকে ঢেকে ফেলে বা আবৃত করে দেয় (যার ফলে মদ্যপায়ী সাময়িকভাবে জ্ঞানহীন, উম্মাদ পাগলের মত হয়ে যায়। ) তাই তাকে খমর বলা হয়।
তদানিন্তন আরবরা সাধারণত আঙ্গুরের রস দিয়ে মদ তৈরী করতো এবং তার প্রচলনই ব্যাপক ও প্রসিদ্ধ ছিল। এ কারণে খমর বললে আংগুরের নেশাদার রসের প্রতিই মন বেশিটা ধাবিত হয়। তবে ইসলামের পরিভাষায় শুধু নেশাদার আংগুরের রসই নয় বরং নেশাদার সকল বস্তুই খমর বা মদের অন্তর্ভূক্ত। যেমন খেজুর ভেজানো নেশাদার পানি, এলকোহলযুক্ত খাবার যা দ্বারা জ্ঞানে পরিবর্তন ঘটে, নেশাদার খাবার বড়ি, ইঞ্জেকশান, পেনসিডিল, বিয়ার, হুইস্কি ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে নেশাদার বস্তু হালাল দ্রব্য দ্বারা তৈরী করা হোক কিংবা হারাম বস্তু দ্বারা সবই মদ আর ইসলামে সকল মাদক হারাম।
যত ধাপে মদ হারাম করা হল
যে মদ তথা নেশাদার দ্রব্যের সাথে তদানিন্তন আরবদের জীবন প্রবাহ অংগাঙ্গীভাবে জড়িত সে মদকে একেবারেই হারাম করে দেয়া হয়নি বরং ধীরে ধীরে তা হারামের সীমানায় পৌঁছানো হয়েছে। কারণ একবারেই যদি এ সকল প্রিয় বস্তুকে হারাম করে দেয়া হতো তাহলে হয়তো মদ্যপায়ী মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো। দীর্ঘদিন মদের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে তাদের মনে মদের প্রতি যে ভালবাসা জন্ম নিয়েছিলো এক দফায় সে ভালবাসার বস্তুটাকে নিষেধ করা হলে তাদের উপর ভীষণ মানষিক চাপ পড়তো, ক্ষোভের সৃষ্টি হতো। ফলে হীনমন্যতা এবং নৈরাশ্যের সুত্রধরে হয়তো এদের কেউ ধর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়ে পড়তো যার ফলে সে চির ক্ষতিতে নিমজ্জিত হতো। উক্ত কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহ পাক মদকে একবারেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি।
বরং ধীরে ধীরে হারাম করেছেন।
চুড়ান্তভাবে মদ হারাম করণের জন্য বিধান গত ক্রমধারা অবলম্বন করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে- وَمِنْ تَمَرَاتِ النَّخِيْلِ وَالْاَعْنَابِ تَتَّخِذُوْنَ مِنْهُ سَكْرًا وَرِزْقًا حَسَناً আর তোমরা খেজুর এবং আঙ্গুরের রস থেকে নেশাদার দ্রব্য ও উত্তম রিযিক বানাও। উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়। এতে মূলত মদের প্রকৃতি ও তার প্রচলন সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
মদের বিপরীত পবিত্র রিযিক উল্লেখ করে মদের প্রতি ঘৃণার বীজ বপন করা হয় হিকমতের বিশেষ আঙ্গিকে।
উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত ওমর রা. সহ কতিপয় সাহাবী নবীজীর খিদমতে হাযির হলেন। তারা আবেদন করলেন হে নবী! আপনি মদ এবং জুয়ার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান- দিন কেননা এগুলো মানুষের বিবেককে নষ্ট করে দেয়। সাহাবায়ে কেরামের উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ويسئلونك عن الخمر والميسير অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতে বলা হয় মদ এবং জুয়ার মধ্যে বড় পাপ এবং মানুষের কিছু উপকার রয়েছে, তবে তার পাপটি উপকারের তুলনায় মারাত্মক।
অর্থাৎ মদ এবং জুয়ার মধ্যে দুটি দিক রয়েছে। একটি হল- সাময়ীক লাভ বা উপকারিতা। মদের সাময়িক লাভ হচ্ছে মদ পানের পর কিছুক্ষণ যাবত শক্তি অর্জন এবং সাময়িক আনন্দ উপভোগ। আর জুয়ার সাময়িক উপকার হল- বিনা পরিশ্রমে অর্থ লাভ এবং অস্থায়ী চিত্ত বিনোদন। এগুলোর অপর দিকটি হল ক্ষতির।
মদ দ্বারা ক্ষতিহল- জ্ঞান নষ্ট হওয়া, বুদ্ধি-বিবেক হারিয়ে যাওয়া যার ফলে মানুষ বিভিন্ন মন্দ এবং অশ্লিল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। আর জুয়ার ক্ষতির দিকটি হল- পরবর্তিতে হারানো অর্থের ক্ষোভে ঝগড়া-বিবাদ, হানাহানি এবং আত্মকলহে লিপ্ত হওয়া।
সুতরাং মদ জুয়ার লাভ ক্ষতি উভয়ের প্রতি চিন্তা করলে দেখা যায় যে এগুলোর মধ্যে সাময়িক কিছু উপকার থাকলেও তার ক্ষতির দিকটিই বেশী। সুতরাং যেহেতু এগুলোতে ক্ষতির ভাগ বেশী তাই এগুলোতে না জড়ানোই নিরাপদ। তাই উক্ত আয়াতে এগুলো হারাম ঘোষণা না করলেও কোন কোন সাহাবী উহার ক্ষতির দিক চিন্তা করে মদ্যপান ত্যাগ করে দিয়েছেন।
আর অপরেরা তার উপকারের দিকে খেয়াল করে পান করে চলেছিলেন। এভাবেই কাটছিল তাদের দিনকাল।
একদিনের ঘটনা- সাহাবী হযরত আবদুর রহমান বিন মাসউদ রা. একটি ভোজনের আয়োজন করলেন। এতে নিমন্ত্রণ করলেন অনেক সাহাবাদের। নিয়ম মাফিক মদেরও ব্যবস্থা রাখা হলো।
খাবার পর চলল মদের পর্ব। মদ পানে অভ্যাসি সাহাবাগণ যথারীতি মদ পান করলেন। হয়তো বেশিই পান করে ফেলেছিলেন সেদিন। মাগরিবের নামাজের সময় হল। নামাযে ছুটলেন সবাই।
নেশাবস্থায় নামাজ শুরু হল। ইমাম সাহেব নেশাবস্থায় সূরায়ে কাফিরুন তিলাওয়াত করছিলেন। নেশার কারণে আয়াতে ভীষণ বিকৃতি ঘটে গেল। لااعبد এর স্থলে اعبد পড়া হল। যার কারণে সূরার মূল উদ্দেশ্য ও মতলব উল্টে গেছে।
উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তিতে তৃতীয় আয়াত يا ايها الذين آمنوا لاتقربو الصلوة وانتم سكارى.. الخ অবতীর্ণ হয়। উক্ত আয়াতে নেশাগ্রস্থাবস্থায় নামাজ পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা বুঝা যায় যে কেবল নামাজাবস্থায় মদ নিষিদ্ধ অন্য সময় নয়, অন্য সময় মদ পান করা যাবে। ফলে অধিকাংশ সাহাবী এ যুক্তিতে সর্বক্ষণের জন্য একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের ধারণা, যে বস্তু নামাযের সময় খাওয়া যায় না তা কখনো ভাল হতে পারে না।
তাই তারা মদ পান চিরতরে ছেড়ে দিয়েছেন। আর কিছু সংখ্যক রয়ে গেলেন যারা নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় মদ পান করে চলেছেন।
একদিন সাহাবী হযরত উতবান বিন মালেক রা. একটি ভোজনের আয়োজন করলেন। তার মধ্যে নিমন্ত্রণ করলেন সাহাবাদের অনেককে। উক্ত ভোজনে উট জবাই করা হয়েছিল।
উটের গোশত পরে মদ, এ দুটিই ছিল সেদিনকার মূল আয়োজন। খাবার শেষে মদ পান অতঃপর শুরু হল কবিতা আবৃত্তির পালা। স্বীয় ক্বওমের প্রশংসা ও অপর কওমের নিন্দা সূচক কবিতা আবৃত্তি। প্রত্যেকে তার গোত্রের প্রশংসা এবং গৌরবপূর্ণ কবিতা পাঠ করছিলেন। হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, যাতে ছিল স্বীয় গোত্রের প্রশংসা এবং আনসারীদের নিন্দা।
কবিতাটি শুনে এক আনসারী সাহাবী উটের হাড্ডি নিয়ে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এর মাথায় আঘাত করলেন। এতে আহত হলেন সাহাবী সাদ রা.। অতঃপর আনসারী নবীজীর দরবারে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল মদের ব্যাপারে আমাদের একটি পূর্ণ সমাধান দান করুন। এরই প্রেক্ষিতে ৪র্থ আয়াত يا ايهاالذين آمنوا انما الخمر والميسر.... الخ. নাযিল হয়। মদ-জুয়াসহ চারটি মন্দ কাজকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করা হয়।
মদ-জুয়া হারাম ঘোষণা করার পর সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে এক নব জাগরণের সৃষ্টি হয়। লোকেরা দৌড়ে গিয়ে যার ঘরে যত মদের ভান্ড ছিল তা ভেঙ্গে ফেলতে লাগল। ফলে মদীনার অলি-গলিতে পানির ন্যায় মদের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল এবং তারা চিরতরে তওবা করল।
মদ্যপানের ভয়াবহতা
হযরত আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি নেশাগ্রস- হওয়ার কারণে এক ওয়াক্তের নামায হারালো সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত এমন যে কোন ব্যক্তির নিকট সারা পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ছিলো, আর তা সেই ব্যক্তি থেকে ছিনিয়ে নেয়া হল। আর যদি কোন লোক নেশাগ্রস- হওয়ার কারণে চার ওয়াক্তের নামায হারালো সে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ পাকের হক্ব হল তাকে তিনাতুল খাবাল পান করাবেন।
লোকেরা জিজ্ঞেস করল- তিনাতুল খাবাল কি? প্রতি উত্তরে বলা হল- তা হচ্ছে দোযখীদের দেহ হতে নিঃসৃত ময়লা-আবর্জনা।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি খোদ রাসূলে করিম সা. কে বলতে শুনেছি যে তিনি বলেছেন, আল্লাহর লা’নত মদের উপর, মদ্যপায়ীদের উপর, যে পান করায় তার উপর, যে বিক্রি করে তার উপর, যে ক্রয় করে তার উপর, যে নির্যাস বের করে তার উপর, যে মদ তৈরি করে তার উপর। যে বহন করে তার উপর, যার জন্য বহন করা হয় তার উপর আর যে এর মূল্য ভোগ করে তার উপর। (ইবনে মাজা)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বর্ণনা করেন, হযরত রাসূলে করীম সা. এরশাদ করেন-জান্নাতে প্রবেশ করবে না- মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, জুয়াড়ী ও সর্বদা মদ্যপায়ী ব্যক্তি। (দারমী)
হযরত আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষ প্রানে- নবী করীম স. এরশাদ করেন- আল্লাহপাক তার ইজ্জতের শপথ করে বলেন, হারাম ঘোষিত হবার পর যে মদ্যপান করবে, আমি তাকে কিয়ামতের দিন পিপাসার্ত রাখবো।
আর যে তা বর্জন করবে আমি তাকে জান্নাতের পবিত্র ঝর্ণা থেকে পান করাবো।
হযরত আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, মদ্যপায়ী, আত্মিয়তার বন্ধন ছিন্নকারী এবং যাদু টোনায় বিশ্বাসী ব্যক্তি কখনো বেহেস্তে যাবে না।
নাসাই ও বাইহাকী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, আনসারীদের দুটি গোত্রের ব্যাপারে মদ্যপান হারাম হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তারা মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পরস্পর ঘুষাঘুষি করেছিল। নেশা যখন দূর হয় তখন নিজেদের অবস্থা দেখে বলল, এটি অমুক ভাইয়ের কীর্তি।
অথচ ইতিপূর্বে তাদের মধ্যে ছিল পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব। মদ পানের কারণেই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ ও ধস্তাধস্তীতে মেতে উঠে। পরস্পরের মধ্যে মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের স্থলে সৃষ্টি হয় হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-কলহ আরো কত কি? তখনই নাযিল হয় আলোচ্য আয়াত এবং মদ্যপান চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়। উপরোক্ত হাদীস ছাড়াও আরো অনেক হাদীসে মদ্যপানের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
মদ্যপান অন্যান্য মন্দ কাজের মূল উৎস
পূর্বকালে একজন বড় বুযুর্গ ছিলেন।
আল্লাহর ইবাদত আর বন্দেগী ছাড়া তার কোন কাজ ছিল না। হরদম আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। একবার একটি চরিত্রহীন নারী তার প্রেমে পড়ল। মহিলাটি তার বাঁদীকে উক্ত বুযুর্গের নিকট প্রেরণ করলেন। বাঁদী এসে আবেদকে বলল- হুজুর আমি আপনার নিকট এসেছি একটি বিষয়ে আপনি আমার সাক্ষ্য দানের আহবান করতে।
আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে চলুন। আবেদ লোকটি বাঁদীর কথা মত তার সঙ্গে রওয়ানা হল। অবশেষে বাঁদী একটি বড় মহলে প্রবেশ করল। ভেতরে একটির পর একটি দ্বার অতিক্রম করতে লাগল এবং সাথে সাথে প্রত্যেকটি দরজা বন্ধ করে সম্মুখে অগ্রসর হল। অবশেষে একটি কক্ষে এসে দাঁড়াল।
কক্ষটিতে একজন সুন্দরী নারী অবস্থান নিয়ে আছে। তার নিকট ছিল ছোট্ট একটি শিশু এবং মদের ভান্ড। মহিলা বলল- আপনাকে কোন সাক্ষ্য প্রদানের জন্য এখানে আনা হয়নি, আনা হয়েছে অন্য কাজে। আপনাকে এখানে তিনটি কাজের যে কোন একটি কাজ করতে হবে। কাজগুলো হল- আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করা, মদ পান করা, এ শিশুটিকে হত্যা করা।
উক্ত তিনটি কাজের যে কোন একটি কাজ অবশ্যই আপনাকে করতে হবে। বলুন আপনি কোনটি গ্রহণ করবেন? আবেদ বলল, যদি তোমার নিকট থেকে মুক্তি লাভের কোন পথ না থাকে তবে আমাকে মদ পান করিয়ে দাও। (কেননা সে মদ পানকে অপর দুটি থেকে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর মনে করেছে) কথামত তাকে মদ পান করানো হল। ফলে আবেদ নেশাগ্রস্থ হল এবং মহিলার সাথে রাত্রি যাপন করলো আর শিশুটিকেও হত্যা করল। সুতরাং বুঝা গেল মদ হল সকল পাপাচারের মূল উৎস।
যদি কোন ব্যক্তি মদ পান করে, নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে তার জন্য সকল পাপ করা সম্ভব এবং সহজ। যেমনটি উপরের ঘটনা দ্বারা প্রতিয়মান হল।
সু্স্থ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মাদকদ্রব্য পরিহার করা প্রধান ও গুরুত্বপর্ণ কাজ। পরিবার-সমাজ দেশ তথা বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্দ্ব-কলহ, দূরিভূত করতে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার কোন বিকল্প নেই। যে সমাজ যতটা মাদকমুক্ত হবে সে সমাজ হবে ততোটা সুশৃঙ্খল, উন্নত ও সুস্থ।
আর যেখানে যত বেশি মদ-জুয়ার প্রচলন হবে সে সমাজ ততটা হুহু করে এগিয়ে যাবে অবনতি, অবক্ষয় আর দ্বন্দ্ব-কলহের দিকে। কারণ যেখানে মদ্য পানের ব্যধি থাকবে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মিথ্যে, ব্যভিচার, গাল-মন্দ, ঝগড়া, বিবাদ-বিসম্বাদ, মারামারি, হানাহানি থাকবে। সেখান থেকে জন্ম নিবে বড় থেকে আরো বড় অপরাধ, সন্ত্রাস। যা প্রথমে পরিবার এবং পরে সমাজ, দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিবে সহসাই। সুতরাং এসকল অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস দূর করতে হলে প্রথমে আমাদের দেশ ও সমাজকে মাদকমুক্ত করতে হবে।
তা না হলে আজকের মাদকাসক্ত তরুণ সমাজ আগামীদিনে দেশ ও জাতির কাল হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সুস্থ্য, সুন্দর ও সুশীল সমাজ গঠনে মদ-জুয়া পরিহার করার তাওফীক দিন।
মদ্যপানে যে সকল সমস্যার সৃষ্টি হয়
মদ্যপানের দ্বারা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি তা হলো, মানুষের প্রধান এবং মূল বস্তু জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেক বিনষ্ট হয়। যার ফলে সৃষ্টির সেরা একজন মানব হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হয়। শেয়াল কুকুরের মত কিংবা তার চেয়েও অধম হয়ে পড়ে।
কেননা সুস্থ একটি শিয়াল ও কুকুরের মধ্যে যে অনুভূতি ও চতুরতা বিদ্যমান থাকে তাও থাকে না একজন নেশাগ্রস- মানুষের মধ্যে। যে কারণে একজন মদ্যপায়ী মানুষ দুনিয়ার কোন অন্যায়, পাপাচারে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। যে কোন অন্যায়ে জড়ানো তার পক্ষে সহজ এবং সম্ভব। এ কারণেই মদ্য পানের ফলে সমাজে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমনঃ
১. মদ্যাপায়ীর স্থায়ীভাবে হুশ-জ্ঞান হ্রাস পাওয়া ২. তড়িৎ গতিতে দৈহিক ও মানসিক অবনতি সাধিত হওয়া ৩. স্মৃতি শক্তি বিলুপ্ত হওয়া ৪. মেধা শক্তির অবক্ষয় ৫. অঙ্গহানি বা দেহের মূল্যবান অঙ্গ বিনষ্ট হওয়া ৬. অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা অর্থ অপচয় ৭. পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি ৮. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘৃণা ও ভুল বুঝাবুঝির সূত্রপাত ৯. সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হওয়া ১০. আল্লাহর স্মরণ হতে বিমুখ হওয়া ১১. অচেতনতার কারণে ঈমানহীন মৃত্যুবরণ ১২. যানবাহনে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ১৩. দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ১৪. স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মিয়-স্বজনের হক্ব নষ্ট হওয়া ১৫. সমাজে চুরি-ডাকাতি, যিনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি হওয়া ১৬. অহেতুক কথা বা কাজে বিরাট ঝগড়ার সূত্রপাত ১৭. অকালে মৃত্যুবরণ ১৮. উপহাসের পাত্র হওয়া ১৯. বংশের মর্যাদাহানী ইত্যাদি।
মদ্য পানের উক্ত ভয়াবহতা ও ক্ষতির দিকগুলো বিবেচনা করে আজ থেকে দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহপাক যে হুশিয়ারি বাণী ঘোষণা করেছেন আজকের জাতি তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। কুরআনের সেই চিরন্তন বাণীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আজ সারা বিশ্ব জীবন বিনাশী মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এটি কুরআনের চিরন্তন মুজেযা। আল্লাহপাক আমাদের কুরআন বুঝার এবং তদানুযায়ী আমল করার তাওফিক দিন। আমীন॥
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।