নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
১
প্রতিদিন ভোরে আমার খোঁজে পথে বের হয় সে। আজানের সময়। কুয়াশায় কিছু দেখা যায়না। ডিউটিরত চৌকিদারের বাঁশি কানে আসে। গায়ে পরে নেয় সাদা পাঞ্জাবী।
শীতে জমে যায় পায়জামার পা। সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে, আবেগে বিড় বিড় করে সে আমাকে ডাকে। যদিও মুখস্ত শব্দের অর্থ সে অর্ধেক জানে, আমি যেন তার কিছুই বুঝি না। সে কেন আমাকে ডাকে?
আমি তো তার সঙ্গে আছি। তার বাড়িতেই থাকি।
চশমার রিডিং লেন্সে, চোখের সুরমায়, কিস্তি টুপিতে, আলনায়, সেগুন কাঠের খাটে, রবারের স্যান্ডেলে, আয়নায়, এমন কি খাটের নিচে রাখা থুতুর চিলমচিতে। ঘুমন্ত স্ত্রীর সরে যাওয়া বুকের আঁচলে, শিথিল চামড়া ও শিরা-উপশিরায়। বিস্বাদ প্রেম ঢেলে দেয় যে রাত, দ্রুত ক্লান্ত হয় যে রাত - আমি সে সবের নিরব সাক্ষী। আমি স্নেহ ভরে ছুঁয়ে দেই সবাইকে - আধাপাকা চুল, লেপ্টে যাওয়া টিপ, কাকের পা বসানো চোখের কোণা, ভ্যাসিলিনে জোড়া দেয়া ঠোঁট।
সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখেছে - জানেনি ক্যালেন্ডারে ছাপানো সূর্যাস্তের ছবিতে আমার চিহ্ন।
দ্বিপাক্ষিক পত্রিকা, উপন্যাসের বই, মুখ খোলা সস্তা বলপেন, খোয়াবনামায় দু:স্বপ্নের অফসেট বৃত্তান্তে আমি লুকানো। ভাঁজ করা কাঁথায় শুয়ে থাকি আমি গৃহহীনের মতো। সুতী কাঁথার নকশায়, কালো কম্বলের লোমে, ফোলানো পাশ বালিশে - সবখানেই ছিলাম এবং থাকবো। ঘুম থেকে উঠে মেসওয়াকের ডালে দাঁত কেলিয়ে সে নিচে থুতু ফেলছে। অশ্রাব্য শব্দে দলাবদ্ধ সাদা ময়লায় আমি ঝরে গেছি।
খাবার মনে করে উড়ে আসা কাকের পাখায় আমি উড়ে এসেছি, নিচের ফুটপাথে শুয়ে থাকা টোকাইয়ের শরীরে ঘুমিয়েছি। ছেলেটার শুকনো মুখ চট থেকে বেরিয়ে এসেছে। ড্রেনের ধার ঘেঁষে তার ছোট্ট উরু। শিয়রে পড়ে থাকা কমলার খোসায় মাছিরা ভনভন করছে। ক্লিনিকের ডাস্টবীনে যে কমলাগুলো পড়েছিলো সেগুলো মূলত: আমি।
মাতামহের আরোগ্য চেয়ে ফলগুলো কিনেছিল এক তরুনী, আমি সেখানেও উপস্থিত ছিলাম।
২
বানানো পুঁথিতে এসব লেখা নেই। অন্যদের বানানো গল্প শুনেও লাভ নেই। মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুতে আমি অদৃশ্য । মনের চোখ মেলে দেখলে সর্বত্রই আমাকে পাবে ।
তারা সমস্ত বিন্দুতে ছড়িয়ে থাকা বিধাতাকে ভালবাসে। আমি তাদের বলতে চাই, যাকে এত ভালবাসো বলছো, তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে হাটতে খারাপ লাগে না? ড্রেনের পাশে চটের কম্বলের ভিতর শুয়ে থাকা আমাকে কেন দেখনি? আমার খুশীর জন্য কত কিছুই না করেছ। ভোর বেলা ঘুম ছেড়ে ছুটে যাচ্ছো আমার জন্য। অথচ আমাকে তোমার পথ বন্ধ করার অপরাধে আধা ঘুম জাগালে। গালি দিয়ে জাগালে।
অকথ্য গালিতে ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে। আধজাগা চোখে কেঁদে দিয়েছে। যে দু'চারটা কুকুর প্রতিবাদ করেছে, তার ভেতর একটি কুকুর আমি নিজে। এই যে পাশ দিয়ে রিক্সাওয়ালা সিটি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। সেখানে দুজন যাত্রীও আমার ভক্ত।
কিন্ত ওরা ব্যস্ত। দুর্ব্যবহার দেখে, ঘেউ ঘেউ শুনে কেউ ফিরে দেখে নি। রিকশার স্পোকে ঘুরতে ঘুরতে আমিও চলে গেছি, চালকের খালি পায়ে, তার প্যাডেলের চাপে।
প্রতিদিনই সে খুঁজে খুঁজে পার হয় স্টেশনের মোড়। বিড়ির দোকান।
যে লোকটা পশমের বানরটুপি পড়ে জেগে আছে সারা রাত, তার অনেক টাকা কেড়ে নিয়েছে মাস্তান। আমি শুধুই কেন যেন দেখি অথর্ব পুরুষের মতো! আজ যেমন ঝুলছি - হজমীর প্যাকেটে, চানাচুরের পলিথিন মোড়কে, সুতোয় ঝোলানো লাল লাটিমে - পিছন কায়দা করে লুকানো জন্মনিরোধকের প্যাকেটে। ৬০ ওয়াটের বাতি জ্বলছে, তবুও সে আমাকে দেখেনি। সুপারি ও খয়েরের কৌটার আড়ালে, যেখানে লাল কাপড়ে মোড়া থাকে কেঁচি কাটা পান। সে অবশ্য মুখে গুঁজে দিয়েছে এক খিলি।
পিক ফেলছে পথে - আমি তো শুয়ে ছিলাম সেখানেও এবং ছুড়ে দেয়া কয়েকটা আধুলীতে।
সহোদরের মতো ঝুলতে থাকা কলার কাঁদি ও বনরুটির প্যাকেটটা আমার পরিচিত। দেবদারুর শাখা থেকে টিনের চালে থেকে টুপ টাপ শিশিরের সঙ্গে আমি ঝরে যাই। ছত্রাক আক্রান্ত লাল পাতায় কুঁচকে থাকি। নির্বাচিত কমিশনারের সারিবদ্ধ পোস্টারে অকারণে ভিজতে থাকি।
ঐ যে পুকুর যেখানে দল বেঁধে মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাতে মুখে পানি দিয়ে পবিত্র হয়ে, মনে মনে বলছে আমার নাম!
পুকুরের আস্বাভাবিক উঁচু দেয়ালের ওপারে জেলহাজত - সেখানেও কেউ কেউ আমাকে চাইছে। সিঁধেল চোর, যে তার শিশুটিকে রেখে এসেছে বাড়িতে, সামান্য কয়টা টাকার জন্য যার পিঠে প্রহারের দাগ । প্রতিদিন সুর্যোদয় গোনে সেই অপরাধী। জমির কোন্দলে যে খুন করেছে আপন ভাইকে, সে প্রতি সন্ধায় সুর্যাস্ত দেখে অস্থির হয়।
ওরা না চাইলেও ওদের সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে থাকি। সেই মরচে ধরা বৃটিশ লোহার শিক, সদ্য ধৃত মুখে কাপড় দেয়া যৌনকর্মী, যার শরীর সিফিলিসের দখলে। সেখানে নিশ্চিন্তে আমার আসা যাওয়া। হয়তো আমি মানুষ আসক্ত, আমিও আক্রান্ত অসুখের ঘায়ে।
ভোর থেকে সন্ধা অবধি আমাকে না পেয়ে চোখে চোখে পানি ঝরছে।
বইয়ের পাতায় লেখা অক্ষর ঝুলছে। অথচ সকাল সন্ধা যে ঘরে আমাকে খুঁজতে গিয়েছে তাতে আমি নেই। হয়তো আছি। বহুদুর নদী থেকে জল নিয়ে ধুয়ে রাখে সেই মামুলী ঘর। ফুলের ডালি দিয়ে সাজায়।
আমারই ফুলের শরীর আমাকে দেয় মিথ্যে প্রতিমা গড়ে।
যে পরিশ্রান্ত কৃষক শহরে এসেছে পুত্রের জন্য নোটবই কেনার জন্য - তার লাঙ্গলে আছি আমি। যে লাইব্রেরিয়ান দ্বিগুণ দামে ঠকালো তাকে, যে ক্ষমতাশীন লোক শক্ত হাতে পাওনা নিয়ে নেয় বই বিক্রেতার কাছে - সবই কষ্ট দেয় আমাকে। বহুবিধ প্রতারণা আমাকে বিষন্ন করে। যে পোয়াতি মেয়ে গলা ধাক্কা খেয়ে সতীত্ব বাঁচাতে উঠান লেপ্টে আছে - তাদের জন্য আমার কিছুই যেন করার নেই - আমি শুধুই কাঁদি।
ঘন্টায় ঘন্টায় ছুটে যাই টগবগে ফুটন্ত পানিতে। একটু চাল একটু সব্জি একটু ভাতের মাড় হয়ে। ওভার ব্রীজ দিয়ে সারিসারি মানুষ চলে, দিগন্তে শোষিত অর্থের দালান, পাশে পড়ে থাকা অনাহারী, ক্ষত পূঁজের মাছিরা পাখির মতো উড়তে থাকে এদিক ওদিক। যুদ্ধের ময়দানে, ছুরি তরবারী বা আত্মঘাতি বোমার স্প্লিন্টারে। কখনো আমার জন্যই শবদেহের মিছিল হয়, উচ্ছাস হয়, বিসর্জন হয়।
অথচ ঘৃণা, যুদ্ধ আর অপমানে যখন কেউ মিশে যায় আমার দেহের মাটিতে আমি নি:শব্দ অভিমানে চলে যাই বহুদুরে।
-----
ড্রাফট - ১.০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।