কেমন করে সময় কেটে যায়...
আমরা চার ভাইবোন... এক ভাই(আমি)...তিন বোন...
বড় বোনটা আমার চেয়ে চার বছরের বড়...আমার ছোটটা দেড়বছরের ছোট...
আর একেবারে ছো্টটা আমার চেয়ে দশবছরের ছোট...ক্লাস সিক্সে পড়ে...
গত বছরের মে মাসে আপুর বিয়ে হয়... দুলাভাই ডেন্টিস্ট... সরকারী চাকুরী...সিলেট পোস্টিং...
আমার পড়াশোনা সিলেট ...আমার ছোটটার পড়াশোনাও সিলেট ...
নানুর বাসা সিলেট...মামার বাসা সিলেট...সবদিক মিলিয়ে ভালোই...
সমস্যা হচ্ছে বাসায়... পিচ্চিটা বিয়ের তিন মাস আগে থেকেই কান্নাকাটি...
'তোমরা সবাইমিলে সিলেট থাকবা... আমি কেমনে থাকব???
আব্বু-আম্মু সারাদিন বাইরে থাকবে...আমি বাসায়,একলা একলা কি করব???'
আপুর ইন্টার্ণী তখনো শেষ হয় নাই...বিয়ের পরও বছর খানেক ঢাকায় থাকা লাগবে..
এইসব বলে-কয়ে তারে সাময়িক বোঝ দেয়া হয়... একটু পর,যেই সেই..
যাই হোক,ভালয় ভালয় বিয়ে-শাদী শেষ হলো...
একটা নতুন আত্বীয়তা...নতুন সম্পর্ক...শুধু নতুন না... নতুন এবং আপন...
শুধু আপন না... সবচেয়ে আপন... এত কম সময়ে,কিভাবে যে এইটা সম্ভব... আল্লাহ মালুম...
আলহামদুলিল্লাহ... অনেক সহজে,অনেক ভালোভাবে অনেক জটিল একটা ব্যাপার সারলো...
আমার দুলাভাইটা অনেক ভালো... কিছুটা ক্র্যাক... তারপরো ভালো...
বিয়ের পর প্রথমবারের মতো আমি আর দুলাভাই সিলেট যাচ্ছি...আপু বাসায়...
বাসে করে ...দিনের বেলা...বাস যাত্রাবাড়ী ক্রস করার পর গান ছাড়লো... মমতাজের গানের সিডি...আমি আর দুলাভাই হাসাহাসি করছি...হঠাৎ করে একটা গান বাজা শুরু করলো...
'কে যায়রে...ভাটির গান গাইয়া...আমার ভাই-বইনরে কইও নাইওর নিতো আইয়া...'
এতো অদ্ভুত গানটা...এতো মায়া নিয়ে গানটা গেয়েছে...এতো হাহাকার...
বোনটা গানে গানে নৌকার মাঝিদের বলছে,মাঝিরা যেন তার ভাইদের একটু খবর দেয়...
ভাইরা এসে যেন তারে একটু বাপের বাড়ীতে নিয়ে যায়...অনেকদিন বোনটা নিজের বাড়ী যায় না...বাপরে দেখেনা...মারে দেখে না...মেলায় যায়না... বোনটার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে...
আমার কাছে আর এইটা গান নাই...কি যেন একটা শুনছি...আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে...এত পানি কোত্থেকে আসছে,আল্লাহই যানে...আমি শুনছি আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি...
দিনে দুপুরে কি এক বিচ্ছিরি অবস্থা... সিলেট-ঢাকার নিয়মিত যাত্রী হওয়ার কারণে,বাসের সুপারভাইজার আমাকে চেনে... সে হটাৎ খেয়াল করলো,আমার অবস্থা...উঠে এসে জানতে চাইলো,কি হইসে? আমি যতই বলি,কিছুনা...বেটা কিছুতেই ছাড়েনা...এক পর্্যায়ে পাশে ঘুমায় থাকা দুলাভাইরে ডাক দিলো...বলে,'আপনি,ওনাকে কিছু বলেছেন?' কান্নাকাটির মাঝখানে আমি হাসা শুরু করলাম... দুলাভাইতো পুরা ভ্যাবাচ্যাকা...আমি সুপারভাইজার কে গানটা আবার দিতে বল্লাম...গান আবার বাজে...দুলাভাই শোনে...আমি শুনি...দুলাভাই আমার মাথায় হাত বুলায়...এক সময় দেখি,দুলাভাইয়ের চোখও একটু ভিজা... আমি হাসি...হাসতে হাসতে শেষ...
নতুন সংসার... সিলেট-ঢাকা-গাজীপুর (আপুর শশুরবাড়ী)...ভালোই কাটছে...
আপু সিলেট যায়...আমরা সিলেট থাকি...হোস্টেল-নানুর বাসা-আপুর বাসা...সব কাছাকাছি...
আপু ঢাকায় থাকে...ছুটি-ছাটায় আমরা ঢাকায় আসি... দুলাভাই দুই সপ্তাহ পর পর একদিনের জন্য ঢাকায় আসে... ভালোই যাচ্ছে সময়...
সময় যায়... আপুর ইন্টার্ণীও শেষ হচ্ছে আস্তে আস্তে...
গত দুইমাস ধরে আমি বেশ অসুস্থ... সিলেট থেকে বাসায় চলে আসছি...
সারাদিন বাসায় বসে থাকি...রোজার মাস ছিলো...আমারব ছোটোটাও বাসায়...
মোটামোটি বোনগুলার সাথেই সময় কাটে...ভালো মন্দ মিলিয়ে যাচ্ছে সময়...
আমি এখনো বাসায়...পিজিতে ভর্তি ছিলাম বেশ কয়েকদিন...আপু প্রতিদিন সাথে যায়...
মাঝেমধ্যে ছোটোটাও যায়...একলা একা হাত পা নাড়তে পারিনা... ব্যায়াম করা লাগে...
আপু...ছোটোটা ধরে ধরে ব্যায়াম করায় দেয়...বেশ জটিল একটা অবস্থা...
অনেক আগেই বাসা থেকে বের হওয়...হোস্টেলে থাকা... আবার ফিরা... কেমন যেন???
ফাইভ-সিক্সে যখন পড়তাম,অনেকটা সেই রকম...
ছোটোটার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে...সিলেট ব্যাক করলো...আপুর ও ইন্টার্ণী শেষ...
এখন শুধু কিছু পেপার ওয়ার্ক বাকী...আমি আর আপু প্রতিদিন পিজিতে যাই...আপু আমারে রেখে কলেজ চলে যায়... ডাক্তার রাউন্ডে এসে আমাকে দেখে যায়... আপু কাজ শেষ করে আসে... বাসায় ফিরি একসাথে... প্রতিদিনই বাইরে একটু খাওয়া-দাওয়া হয়... পিজির নিচে একটা দোকান আছে...ঐটার কলিজার সিঙ্গারাটা খুব মজা... আজিজ সুপার মার্কেটের যে অন্তর রেস্তোরা...ঐটার খাসীর কলিজা(যদিও পাইনাই গিয়ে)...খুব তাড়াতাড়ি হাটতে পাড়িনা...আপুও অসুস্থ(আমি মামা হব,ইনশাল্লাহ)...আমি আস্তে হাটি...আপুও আস্তে হাটে... আস্তে আস্তে বাসায় ফিরি... সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছে...
আপুর কলেজের পেপার ওয়ার্ক শেষ...ইন্টার্ণীর সার্টিফিকেট তোলা হয়ে গেছে...পরশুদিন বিকেলে বাসায় ঢুকে দেখি,একেবারে পিচ্চিটা কাঁদতেসে... কি হইসে?
’দুলাভাই আসতেছে,আপুরে নিয়ে যেতে’... হুমম...
আমি বলি,নিবেইতো...সারাজীবন আপু এইখানে থাকবে নাকি???
‘ভাইইইইইইয়া!!!! এইটা তুমি কি বল্লা???’ কান্নার আওয়াজ আরো বারে...
সন্ধ্যা হয়...আপু গোছগাছ করে... আম্মু অফিস থেকে আসে... আম্মুও সাহায্য করে...
একটু পরপর চোখ মোছে... আপুও মোছে...
আমাদের বাসার যে হেল্পার ...
(ঐদিন দুপুরেও ভীষন চিল্লাইসে আপু এইটার সাথে) ওইটাও চোখ মোছে...
খাবার টেবিলে,আব্বু..
‘আজকে খালী সার্টিফিকেট তুললো...কালকেই এসে নিয়ে যাওয়া লাগবে!!! ওতো যাবেই... সবসময় থাকবে নাকি এই বাসায়???’
রাত বারটায় দুলাভাই বাসে উঠে...
আম্মু চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘সাবধানে আসতে বইল!!!’
সকালে বাসায় ঢুকে দুলাভাই ঘোষনা দিল,বিকেলে গিয়ে চেম্বার করবে,
এইজন্য ওনি দশটার মধ্যেই বাসা থেকে বের হতে চাচ্ছেন...
(বেটার চেহারা হান্ড্রেড পাওয়ারের বাল্ব এর মত জ্বলজ্বল করতেছে)...
ভালো কথা... আব্বুর আটটা থেকে স্কুল... সাড়ে দশটা পর্্যন্ত টানা ক্লাস... আব্বু একেবারে বিদায় নিয়ে বের হলো...হালকা কান্নাকাটি...
পিচ্চিটা আজকে স্কুলে যাবেনা... দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলা তখনো শুরু করে নাই...
আম্মুও ওদের বিদায় করেই অফিসে যাবে...
ফোনে টীকেট বুকিং দিতে গিয়ে একটার আগে গাড়ি পাওয়া গেলনা...
এগারটার সময় বাসা থেকে বের হলেই হবে...গাড়ীতে উঠবে রাজারবাগ থেকে...
আব্বু সাড়ে দশটার সময় আবার বাসায়...
ভেজালটা লাগাইলো নানী(বাসার বড় হেল্পার)... হটাৎ করে হাউমাউ করে কান্না...
‘বড় আফা... জামাইর বাড়ীত গিয়া আমগো ভুইল্লনা...’
সবার সাউন্ডই বারছে... কি এক অবস্থা... এগারোটা বাজলো...
সবাই একসাথে বাসা থেকে বের হবে...আম্মু অফিসে যাবে,আব্বু স্কুলে...
বের হয়ে গেলো...পাঁচতলা থেকে নামছে আস্তে আস্তে...
বিল্ডিং এর আন্টিদের থেকে বিদায় নিতে নিতে... দোয়া নিতে নিতে...
আমি আর নামি নাই... সিড়ি দিয়ে উঠতে নামতে কষ্ট হয়... দরজা থেকেই বিদায় দিলাম... বসে আছি সোফায়... একলা একা... বিয়ের সময়ও এমন লাগে নাই...
এখন যেমন লাগছে... কেমন যেন...
কি অদ্ভুত একটা সিস্টেম!!! কিচ্ছু করার নাই... কিচ্ছু বলার নাই...
কিচ্ছু করার নাই!!!!!!!!!!!!!
মনে হয় কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে...ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে
...
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।