সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষণীয়।
মৃত্যুর আগ মুহূর্তে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পূর্ব সময়ে আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কি তার অমরত্বের কথা ভাবছেন? চে জবাব দেন ‘আমি ভাবছি, বিপ্লবের অমরত্বের কথা’। তারপর তাকে প্রায় ১০টি গুলি করা হয় এবং তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এটা ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবরের ঘটনা। এখানেই শেষ...।
মৃত্যু তো আসবেই, এটা পৃথিবীর একটি অমোঘ নিয়ম। বিপ্লব চলাকালীন মৃত্যু, এটাও নতুন কোনো ঘটনা নয়। এভাবে এমন করে, এই পৃথিবীতে অজস্র বিপ্লবী এবং আদর্শিকের মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুর পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপ্লবীর বিপ্লব বিদ্যমান ছিল, আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে— চে’র বিপ্লবও মৃত্যুবরণ করেছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাছাড়া চে আইডল হিসেবে নন, বেঁচে আছেন ক্রেজ হয়ে, তা-ও বেহিসেবী তারুণ্যের টি-শার্টে।
এটা অবান্তর কোনো কথা নয়, নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান।
আসলে, কেবল টি-শার্ট নয়, বারের দেয়াল, আইসক্রিমের মোড়ক, সিগারেট, বিয়ার, কোটপিন, জুতো, টাই এবং অন্তর্বাস—এ রকম আরও অনেক কিছুতেই আছেন তিনি; প্রবলভাবেই আছেন; এসবের জন্য অপ্রতিদ্বন্দ্বীই বলা যায়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছেন বিপ্লবী থেকে ব্র্যান্ড। আর তিনি যে জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি নেই, সেটি হচ্ছে ‘কার্যকর চিন্তাক্ষেত্র’। তাহলে আমাদের অপরাধ কী, তার মৃত্যু কেন আমাদের অপরাধী করে দেয়? হ্যাঁ, আমরা অপরাধী, সন্দেহ নেই।
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীবাসীরই অপরাধ হচ্ছে, তারা চে’র বিপ্লব ও আদর্শের জায়গা থেকে সরে এসে তাকে সেলিব্রেটিতে পরিণত করেছে। এমন তো কথা ছিল না—চে নিজেও এমনটি কখনও চাননি। তাই হয়তো কবির উচ্চারণ ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়’।
আমাদের এই বাংলাদেশে, ব্যাপারটা ঠিক তা-ই। টিন-তরুণ ছেলেরা চে’র ছবি সম্বলিত টি-শার্ট পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চে’র পোস্টার পড়ার ঘরে টানাচ্ছে। চে’র স্টাইলে সিগারেট খাচ্ছে তারা। ভালোই, এভাবে কত জিনিসই তো বিচিত্রভাবে চোখের সামনে পড়ে। অস্বাভাবিক কিছু না। ঢাকার আজিজ মার্কেটে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য গড়ে ওঠা ফ্যাশন হাউসগুলোও চে’র ছবি দিয়ে টি-শার্ট করেছে, বিক্রিবাট্টাও বেশ ভালো।
সমর্থকরা বলে থাকেন, দেশে দেশে চে’র ঘর আছে। আছে সত্যি, কিন্তু সেগুলো হচ্ছে টি-শার্টের দোকান। আর এ দেশে তার ঘর হচ্ছে আজিজ মার্কেটের ‘নিত্যউপহার’, ‘মেঘ’, ‘রাখাল বালক’ এবং আরও কয়েকটি ফ্যাশন হাউস। আর এই ঘরগুলোর অবস্থাও বেশ রমরমা, লাভজনক। আর এসবের কল্যাণেই আজ ‘চিড়া-কলাময়’ আজিজ মার্কেটে এখন ব্রাকের এটিএম বুথ—শেষ পর্যন্ত টাকার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে চে গুয়েভারার বিপ্লব।
পুঁজিবাদের মধ্যে গড়ে উঠছে চে’র জন্য ঘর-আশ্রয়। সাম্রাজ্যবাদ তাকেও পুঁজির উপলক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে এবং তাকে বিপ্লবী থেকে ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। পুঁজিবাদের অন্যতম শক্তিশালী প্রক্রিয়া হচ্ছে ‘ব্র্যান্ডিং’। ... চে নিজেই বলে গেছেন, ‘আমরা যেন বিষয় কিংবা অর্থের প্রতি অনুরক্ত না হই। আমাদের অনুরাগ থাকা উচিত চেতনার প্রতি, আদর্শের প্রতি।
বলা যায়, হঠাত্ করেই—বাংলাদেশে অসাধারণ এক আনুষ্ঠানিকতায় অভ্যর্থিত হলেন চে গুয়েভারা। পেশাদারি গান, হাততালির কবিতা, ফর্মাল বক্তৃতা, আবেগঘন উপসম্পাদকীয়, গ্ল্যামারাস সাপ্লিমেন্ট এবং আরও কত কী! প্রশ্ন জাগতেই পারে, এসব আয়োজন তৃতীয় বিশ্বের এই দেশের মানুষকে কি চিন্তার দিক থেকে নাড়া দেবে? নির্যাতিত অসহায় মানুষের সামনে কি নতুন কোনো মুক্তির দরজা উন্মুক্ত করার উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে? হয়তো না, অথবা নিশ্চিত করেই বলা যায় ‘না’। কেননা, উপরোক্ত আনুষ্ঠানিকতা যে সময়ে এবং যে বরাভয় ও বলয়ের মধ্যে নির্মিত হলো, সেটা সম্পূর্ণই মুখোশের মতো ব্যাপার। এই শ্রেণীটা লালনকে নিয়ে ঠেকিয়েছে কুষ্টিয়ার এক কোনায়, আর হেনরিক ইবসেনকে ছড়িয়ে দিয়েছে নগর থেকে মফস্বলে এবং কৃষকের হাওলাতি জমি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে। পুরোপুরি হাস্যকর মনে না হলেও কেঁপে ওঠার মতো কোনো ব্যাপার জাগ্রত করা তাদের ধাতে নেই।
কারণ, বাংলাদেশ এখন আর কাদামাটিতে দাঁড়িয়ে নেই। যেভাবে ইচ্ছে এবং যেমন করে মন চায় তাকে সাজানো সম্ভব নয়। নতুন কোনো কাঠামোতেও গড়ে তোলা অসম্ভব। দেশটা এখন খুব শক্তিশালীভাবেই পরিপকস্ফ হয়ে উঠেছে বহুজাতিক কোম্পানির থাবায়। আর এই সাম্রাজ্যবাদী ‘পুঁজির থাবা’কে যারা এই দেশে রিক্রুট করল তারা এখন দিব্যি আলো এবং আলোচনাতেই পর্যবসিত।
বহুজাতিক কোম্পানির অন্ধকারের নিচে তারা আলো দেখতে পান। পুঁজিবাদের আনন্দে তারা আত্মহারা হন। একুশ শতকের নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুটপাটকে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে একাকার করে ফেলছে প্রতিদিন। মাল্টিন্যাশনাল করাপশনের মধ্যেই তারা দেখতে পান বাংলাদেশের স্বার্থ।
সন্দেহ নেই, বিপ্লবের ব্যাপারে অবিচল পুরুষ ছিলেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
কিন্তু তার যে বিপ্লব, যে আদর্শ, যে চেতনা—একে লালন করার সামর্থ্য এবং অধিকার সমকালীন পৃথিবীবাসীর নেই। তার আদর্শের অবিচলতা ও গতিময়তা এতটাই সুগভীর এবং সুউচ্চ যে, স্বপ্নের মতো করেই কেবল একে জিইয়ে রাখা যায়। মন মানসিকতায় যিকঞ্চিত্ বাঁদরামো অবশিষ্ট থাকলে আর এ আদর্শকে যথাযথভাবে অঙ্গীকারের আওতায় আনা সম্ভব নয়। তাহলে ধরে নেয়া যায় চে’র বিপ্লব ছিল একান্তই ব্যক্তিমানুষ চে’র বিপ্লব। উত্তরাধিকারীদের অধিকার এখানে সম্পূর্ণই অকার্যকর এবং পরমভাবে অনধিকারে নিমজ্জিত।
ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কিউবার পর রাউল ক্যাস্ত্রোর কিউবা হয়তো বা তার আদর্শ কিছুটা কার্যকর করার চেষ্টা করেছে। এখনও তাদের আদর্শিক জায়গায় চে’র অবস্থান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যমান। সে দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন তাদের স্কুল শুরু করে ‘আমরা চে’র মতো হবো’ এই শপথ বাক্য উচ্চারণ করে। লাতিন আমেরিকার দু’চারটি দেশ তাদের অনুসরণ শুরু করেছে। সেখানের দু’একটি দেশে এখানে ওখানে ঝুলে থাকে চে’র ছবি-পোস্টার।
মৃদু বাতাসেই কেঁপে ওঠে ছবিগুলো। রৌদ্রতাপে এক সময় সেগুলো ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এরপর বৃষ্টি এলে খসে পড়ে—যেভাবে ঘাতকের গুলিতে পড়ে গিয়েছিলেন চে গুয়েভারা।
লেখাটি দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।