তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে ঘিরে জট খুলছে না রাজনীতির। ফলে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। একদিকে দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অনড় মনোভাব, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা_ কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। সংকট উত্তরণে প্রধান দুই দল সংলাপে না বসলে বর্তমান গুমট পরিবেশ রাজনীতিতে আরও বড় ধরনের জট তৈরি করতে পারে বলে সবার আশঙ্কা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পুরো পরিস্থিতি ক্রমেই দুই দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এখনই প্রধান দুই দলের সংলাপ জরুরি। নইলে পরিণাম কারও জন্যই শুভ হবে না।
সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে নানামুখী চাপে বিচলিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার নিয়েও সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান, নানা ইস্যুতে কূটনীতিকদের চাপ, সর্বোপরি সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানান প্রশ্ন ও সংশয় বিরাজ করছে।
বিশেষ করে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন_ তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সরকারের দায়িত্বে থাকবেন কি না, এ নিয়ে সরকারের মধ্যেও দোদুল্যমানতা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হলে প্রধানমন্ত্রীই সপদে থাকবেন_ আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বলেছে, সরকারের মেয়াদ শেষে শেখ হাসিনার এক দিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।
সূত্রে জানা যায়, বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া আলটিমেটামে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপিও সংকটে পড়েছে। তবে সম্প্রতি আবারও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংলাপে বসতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। দুই দলের কোনো পর্যায়েই কোনো যোগাযোগ নেই বলেও জানা গেছে। তবে বিরোধী দল চাইলে সংসদের ভেতরে যে কোনো ইস্যুতে আলোচনায় রাজি সরকার।
বরাবরের মতো বিএনপিকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বানও জানিয়ে যাচ্ছে দলটি। এতে রাজি নয় বিএনপি। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সংসদে এসে কথা বলা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব মানবে না বিএনপি। আওয়ামী লীগও সংসদের বাইরে কথা বলতে নারাজ। বিএনপি মনে করে, সংসদে কোনোভাবেই সমঝোতায় পেঁৗছা সম্ভব নয়।
সংকট নিরসনে সংসদের বাইরেই কথা বলতে হবে। তবে মতৈক্যে পেঁৗছালেই কেবল জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যেখানেই হোক দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দুই দলকে এখনই সমঝোতায় পেঁৗছা জরুরি বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। শেষ পর্যন্ত প্রধান দুই দল সংলাপে যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই দেশে একটি নির্বাচন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এটা হয়তো এখন না হলেও শেষ পর্যন্ত একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসবে দুই দল।
কারণ, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হলে ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই হবে। আর আওয়ামী লীগ তা করবে না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক কিংবা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেও জনমত বিএনপির পক্ষে যেতে পারে। সুতরাং গণতন্ত্রের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসতে হবে। আর না বসলে পরিণতি কী হবে সময়ই তা বলে দেবে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, জাতীয় শোক দিবসে কেক কেটে যারা আনন্দ-ফূর্তি করে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। এ নিয়ে বিএনপি সরারসি কোনো মন্তব্য না করলেও দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, সংলাপ-সমঝোতায় না এলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাবে। এর দায়দায়িত্ব নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, 'দেশে রাজনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে যদি এ সংকটের সমাধান না করা হয়, তবে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে।
' আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ না হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে সমঝোতার পথ তত ক্ষীণ হয়ে আসছে। তিনি বলেন, দেশের গণতন্ত্র, সংবিধানের পথ কণ্টকাকীর্ণ হলে বিএনপি দায়ী হবে।
সংকটাপন্ন পরিস্থিতির দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষমতা যাবে_ এটা ভেবে সরকার এখন নতুন চক্রান্ত শুরু করছে। তারা তৃতীয় শক্তির কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগ বা দেশের জন্য শুভ হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সরকার 'জরুরি অবস্থা' জারি করে বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে মহাসংকট সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, গুরুতর অসুস্থতার জন্য প্যারাসিটামল খেয়ে যেমন কোনো কাজ হয় না, ঠিক তেমনই আমাদের জাতীয় সমস্যা সমাধানে শুধু একটি নির্বাচনই সমাধান নয়। এর স্থায়ী সমাধান করতে হলে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ তৈরি করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে। অবস্থা দিন দিন জটিলতার দিকেই যাচ্ছে। এ জন্য জাতীয় মতৈক্যের বিকল্প নেই। দলীয় সরকারের অধীনে একতরফাভাবে নির্বাচন করলেও তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। সবকিছু বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর এখনই সংলাপ-সমঝোতা জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের ভাষ্য হলো, আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্বাচন করলে কিংবা নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় থাকলে গণতন্ত্রের জন্য চরম ক্ষতি হবে। দেশ এক সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে চলে যাবে। এ পরিস্থিতিতে যে কোনো শক্তি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, যা আমাদের কারও জন্যই কাম্য নয়। তাই সংলাপের সম্ভাবনা শেষ পর্যায়ে থাকলেও শীঘ্রই প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতায় পেঁৗছা জরুরি। নইলে দায়ভার রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ-সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতা হবে। না হলে শুধু রাজনীতিবিদদেরই নয় ক্ষতি হবে দেশের অর্থনীতির। সর্বোপরি দেশের জনগণকে এই ভোগান্তির শিকার হতে হবে। আর বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনরা যদি একতরফাভাবে নির্বাচন করে, তা দেশি-বিদেশি কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ ধরনের আত্দঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া আওয়ামী লীগের ঠিক হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।