আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“দ্য মাস্টার অফ সাসপেন্স” – আলফ্রেড হিচকক



মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় । কিছু মানুষ আছে যারা সারজীবন তাদের স্বপ্নকে সত্য করার পিছনে ছুটে এবং স্বপ্নকে সত্য করে । সেই দলেরই একজন মানুষ আলফ্রেড হিচকক । অল্প বয়স থেকেই যার ধ্যান-ধারণা এবং স্বপ্ন চলচ্চিত্রকে ঘিরে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ মানুষটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই কাটিয়েছেন । তিনি সারাজীবন পঞ্চাশটিরও অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ।

চলচ্চিত্রের ভাষায় নান্দনিকতা , সাসপেন্স , থ্রিলিং এর পথপ্রদর্শকও তাকে বলা হয় । এজন্যই তাকে “দ্য মাস্টার অফ সাসপেন্স” বলে । যার নান্দনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে একের পর এক চমৎকার সাসপেন্স , থ্রিলিং চলচ্চিত্র । সাসপেন্স , থ্রিলিং জিনিস কি তা দর্শকদের মাঝে তিনি দারুণভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন এবং দর্শকদের টানতে সক্ষম হয়েছেন । আর তাই আলফ্রেড হিচকক নামটি আজও এক কিংবদন্তীর নাম , চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে আদর্শ একজন পথিকৃত ।

আলফ্রেড হিচকক ইংল্যান্ডের লন্ডনে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান ছিলেন তিনি । তার স্কুল এবং কলেজ ছিল জিসুইট ক্লাসিক স্কুল সেন্ট ইগনাতিয়াস কলেজ ও সালেসিয়ান কলেজ । আলফ্রেড হিচককের বয়স যখন প্রায় পাঁচ বছর, তার বাবা তার খারাপ ব্যবহারের জন্যে নিকটবর্তী থানা পুলিশের কাছে প্রেরণ করেন তাকে পাঁচ মিনিট বন্দী করে রাখার জন্যে , আর অল্প বয়সের এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিই হয়ত পরবর্তীতে তার সিনেমাজুড়ে আতংক, সাসপেন্স এ ব্যাপারগুলোকে বেশি আনতে আগ্রহী করে তুলে । মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তিনি লন্ডন কাউন্টি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড নেভিগেশন এ যান সেন্ট ইগনাতিয়াস ছেড়ে ।

শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ড্রাফটসম্যান এবং অ্যাডভারটাইজিং ডিজাইনার হিসেবে ক্যাবল কোম্পানি “হেনলি”তে কাজ করেন । ১৯১৯ সালে হেনলি টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় তার লেখা “গ্যাস” , যেখানে অল্পবয়সী এক নারীকে তার লেখা আবর্তিত হয় । তার পরবর্তী লেখার নাম ছিল “দ্য ওমেন পার্ট” , এটাও একই সালে প্রকাশিত হয় একই পত্রিকায় । এখানে একজন স্বামী ও তার স্ত্রীর মাঝে সাংঘর্ষিক জীবনের কথা ফুটে উঠে । এছাড়া “সরদিদ”, “এন্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো” এর মত লেখাও তিনি লিখেছেন ।

তার সর্বশেষ লেখা ছিল “ফেডোরা” , যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী কেমন হবে তা নিয়ে । ১৯২০ সালের দিকে এসে আলফ্রেড হিচকক আগ্রহী হয়ে উঠেন ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রের প্রতি । তিনি লন্ডনে ফিল্ম প্রোডাক্টশনে কাজ করা শুরু করেন । “প্যারামাউন্ট পিকাচার”র লন্ডন শাখায় তিনি টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন । এরপর তিনি “ইসলিংটন স্টুডিও”তে কাজ করেন ।

এরপর টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে চিত্রপরিচালক তিনি আত্নপ্রকাশ করেন । ১৯২২ সালে “নাম্বার থার্টিন” নামে চলচ্চিত্রে হাত দেন তিনি । কিন্তু তার জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটি অসম্পূর্ণই থেকে যায় । এরপর একের পর এক তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যান । আর চলচ্চিত্রে তিনি ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তার নান্দনিকতা ।

১৯২২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাধারে নির্মাণ করে যান বিভিন্ন চলচ্চিত্র । যাতে উঠে এসেছে সাসপেন্স , থ্রিলিং । ১৯২৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন “দ্য প্লেজার গার্ডেন” । এ চলচ্চিত্রটি ছিল ব্রিটিশ-জার্মান প্রোডাক্টশনের এবং চলচ্চিত্রটি দারুণ জনপ্রিয় হয় । এরপর হিচকককে আর তাকিয়ে থাকতে হয়না ।

এরপর তিনি বিভিন্ন প্রোডাক্টশনের ব্যানারে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেতে থাকেন । ১৯২৭ সালে মুক্তি পায় তার চলচ্চিত্র “দ্য লডজার” । একই বছরের ডিসেম্বরে হিচকক বিয়ে করেন আলমা রিভিলিকে । “দ্য লেডি ভেনিশেস(১৯৩৮)” ও “জ্যামাইকা ইন(১৯৩৯) “ এর মত চলচ্চিত্র নির্মাণ এর পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরতে শুরু করে আমেরিকাতেও । আলফ্রেড হিচকক ১৯৪০ সালে পুরো পরিবার নিয়ে পা বাড়ায় হলিউডে ।

শুরু হয় তার হলিউডে চলচ্চিত্র জীবন । ডেভিডও সেলযনিকের প্রযোজনায় চলচ্চিত্র “রেবেকা”। চলচ্চিত্রটি শুরু হয় ১৯৪০ সালে । ১৯৪২ সালে “সাবতিউর” মুক্তির পর হলিউডে পরিচালক হিসেবে তার একটা শক্ত অবস্থান হয় । এরপর “সাইকো (১৯৬০)”, “ফ্রেঞ্জি(১৯৭২)”, “ফ্যামিলি প্লট(১৯৭৬)” এর মত চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেন ।

১৯৫৫ সালে প্রচারিত আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্ট এর মাধ্যমেই তার পরিচিতি মানুষের কাছে বেশি পৌঁছায় । ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আলফ্রেড হিচকক আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট লাইফ এচিবমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান । অনুষ্ঠানে তিনি একটা কথাই বলেন আর তা হচ্ছে চারজন মানুষের কথা । তারা হচ্ছেন এডিটর , লেখক ,তার মেয়ে প্যাট এবং তার স্ত্রী আলমা রিভিলি । যাদের স্নেহ , ভালোবাসা ও উৎসাহ ছাড়া তিনি এতদূর আসতে পারতেননা ।

১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের সাথে “দ্য শর্ট নাইট” নিয়ে কাজ করেন যা তার মৃত্যুর পরে স্ক্রিনপ্লে হয় । তার অনেক চলচ্চিত্রেই তার একমাত্র মেয়ে প্যাট্রেচিয়া হিচকককে দেখা যায় । “সাইকো” , “স্টেইজ ফ্রাইট” এর মত চলচ্চিত্রে । “এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি” ম্যাগাজিনে বিশ্বের সেরা একশত চলচ্চিত্রের মধ্যে তার চলচ্চিত্র “সাইকো”, “ভারটিগো”, “নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট”, “নটোরিয়াস” স্থান পায় । অনেকের চোখে তার নির্মিত “শ্যাডো অফ ডাউট(১৯৪৩)” চলচ্চিত্রটি তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সবচেয়ে চমৎকার ।

১৯৪৪ সালে তার আরেকটি চমৎকার ছবি মুক্তি পায় যার নাম “লাইফ বোট”। যেখানে দেখানো হয় কিভাবে একটা নৌকার আরোহীরা বেঁচে থাকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে । তিনি গোল্ডেন গ্লোব , কিনেমা জাম্পো অ্যাওয়ার্ড , লরিয়াল অ্যাওয়ার্ড , ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড ,আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট অ্যাওয়ার্ড , একাডেমী অ্যাওয়ার্ড এর মত পুরস্কার পেয়েছেন । যদিও এই গুণীনির্মাতা কখনই অস্কার পাননি । চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তার কিছু ব্যক্তিগত মত ছিল , তার মতে তার চলচ্চিত্রগুলো তার নির্মাণের একবছর পর ক্ল্যাসিক হতো ।

তার মতে তার চলচ্চিত্র “সাইকো” ছিল কমেডি । যথাসম্ভব দর্শককে চলচ্চিত্র মধ্যে দোটানা দেখাতে হবে, যাতে দর্শক দোটানায় ভুগে । নাটকীয়তা বাদে জীবনের সবকিছুই নিস্তরঙ্গ । কিছু চলচ্চিত্র জীবনের টুকরো, জীবনের কথা বলে । এমনটাই মনে পোষণ করতেন চলচ্চিত্র নির্মাণের এই প্রবাদ পুরুষ ।

হিচকক এর আরেকটি বিশেষত্ব ছিল “ক্যামিও” । তিনি তার চলচ্চিত্রে আচমকাই আবির্ভূত হতেন । হিচকক ছিলেন ব্রিটেন এর প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাতা । ১৯২৯ সালে তিনি তার “ব্ল্যাকমেইল” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ব্রিটেনে সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু করেন । ১৯৮০ সালের ২৯শে এপ্রিল আমেরিকার কার্লিফোনিয়াতে তিনি ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ।

হিচকক মৃত্যুর কয়েকমাস আগে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর কাছ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেন । এরপর তিনি আলফ্রেড হিচকক থেকে স্যার আলফ্রেড হিচকক হন। তার চলচ্চিত্র, নির্মাণকৌশল পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত পরিচালককে পথ দেখিয়েছে । অনেক বিখ্যাত পরিচালকের আবির্ভাব হয়েছে তার চলচ্চিত্র দেখে । তার চলচ্চিত্রের ভাষা , চলচ্চিত্রের ধরণ এখনও মানুষের চোখে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।

আলফ্রেড হিচকক এমন একজন নির্মাতা যিনি চলচ্চিত্রকে দিয়েছে বহুমাত্রিক গতিধারা । চলচ্চিত্র যে কত বড় একটা শিল্প হতে পারে, মানুষের কাছে যে এর মাধ্যমে কতটা গভীরে পৌঁছানো যায় তা তিনি করে দেখিয়েছেন । চলচ্চিত্রে সাসপেন্স , থ্রিলিংয়ের জগত সৃষ্টিকারী এ চলচ্চিত্রের বিস্ময়কর নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক তাই আজও চলচ্চিত্র দর্শক-নির্মাতাদের কাছে “দ্য মাস্টার অফ সাসপেন্স” হিসেবেই বেঁচে আছেন । আলফ্রেড হিচককের কিছু চলচ্চিত্র প্রতি নেয়া তার আয় - দ্য লেডি ভেনিশেস(১৯৩৮) -$৫০,০০০ সাসপিশন(১৯৪১)- $২,৫০০/ সপ্তাহ নটোরিয়াস(১৯৪৬)- $৭,০০০/সপ্তাহ রেয়ার উইন্ডো(১৯৫৪)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ(১৯৫৬)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা ভারটিগো(১৯৫৮)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট(১৯৫৯)-$২৫০,০০০+১০%লাভ সাইকো(১৯৬০)-৬০%লাভ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।