আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমি একজন কবি। কিছুটা বিপরীত ভাবধারা থেকেই আমার এই দৃঢ় উচ্চারণ। ঠিক কাকে কবি বলা যায় তা নিয়ে আমার জ্ঞানের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তবে, যে কারণে আমি এই কবি আর কবিতার সংজ্ঞায়নে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি তা একটু খোলাসা করা দরকার। সাম্প্রতিককালে আমার পরিচিত কতিপয় সুজন, কপালে কবি’র ট্যাগ লাগিয়ে নিজেদের কবি হিসেবে জাহির করার যে প্রয়াস হাতে নিয়েছেন, তাতে ‘কবি’ আর ‘কবিতা’র সংজ্ঞায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত আমার আত্মবোধগম্যতার কারণে হলেও। কবিতা দু চারটে রচিত হোক বা না হোক, কবি হিসেবে ওদের পরিচয়ের খবর বেশ হাস্যরসের যোগান দেয়।
খুব ছোটবেলার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয়ঃ যিনি অল্প কথায় ছন্দবদ্ধ শব্দ চয়নে তাঁর মনের ভাবের প্রকাশ ঘটান তিনিই কবি।
একথা বলছি এই কারণে যে, ছোট বেলায় কবিতা পড়তে পড়তেই আমরা ‘কবি’ স্বত্তার সাথে পরিচিত। সহজ কথায় যিনি কবিতা লেখেন, তিনিই কবি। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় ‘কবিতা’ কী? মুল ব্যাপারটা হচ্ছে- কবিতার সংজ্ঞায়ন যদি সম্ভব হয়, কবিকে সংজ্ঞায়িত করতে আর বেগ পেতে হয় না। আসুন দেখি, কবি বা পোয়েট-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Dictionary.com কী বলেছেঃ A person who has the gift of poetic thought, imagination, and creation, together with eloquence of expression. তাহলে মোটামুটি বলা যায়, কবি হতে হলে আপনাকে ন্যুনতম কয়েকটি গুনের অধিকারী হতে হবে। যেমনঃ আপনার পোয়েটিক থট্ থাকতে হবে, imagination বা কল্পনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে, এবং এগুলোর সমন্বয়ে আপনার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বাগ্মীতা থাকতে হবে।
থাকতে হবে বললে একটু হয়তো আপত্তিজনক হয়ে যেতে পারে, বরং বলা ভালো, থাকা দরকার।
এবার চলুন, আমরা কবিতা কী তা একটু বুঝতে চেষ্টা করি। এটা একারণেই যে আমরা আগেই বলেছি, যিনি কবিতা লেখেন তিনি কবি। সুতরাং কবিকে চিনতে হলে আগে কবিতা বুঝতে হবে। Dictionary.com-এ গিয়ে Poem বা কবিতার বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা পাওয়া যায়।
প্রথমেই যা পাওয়া যায় তা হলোঃ a composition in verse, esp. One that is characterized by a highly developed artistic form and by the use of heightened language and rhythm to express an intensely imaginative interpretation of the subject. এবার আসুন আমরা উপরের সংজ্ঞাটাকে একটু বিশ্লেষন করি। কবিতার গুনাগুন অনুধাবন করতে গিয়ে, উপরোক্ত সংজ্ঞাটির কয়েক গুচ্ছ শব্দের উপর বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। ‘a highly developed artistic form’, ‘the use of heightened language and rhythm’ এবং ‘to express an intensely imaginative interpretation of the subject’ আলোচনার সুবিধার্থে আমরা dictionary.com –এর সংজ্ঞাটাকে এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দগুচ্ছে ভাগ করেছি। এই শব্দগুচ্ছকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কোন নির্দিষ্ট বিষয়কে যদি যথাযথ শব্দচয়নের মাধ্যমে একটি উন্নত শৈল্পিক আকারে দাড় করানো হয় তাহলে তাই কবিতা। কবিতার সংজ্ঞায়নে কবি William Wordsworth-এর এই লাইনটি বিশেষ উল্লেখের দাবিদারঃ "poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility"
কবিতা মুলত এক বিশেষ ধরণের রচনা যাতে খুবই উন্নত মানের শৈল্পিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি তার মনের ভিতরে কাজ করতে থাকা বিষয়টির একটা শাব্দিক রুপ দেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ একটু আগ বাড়িয়ে বলেছেন, আপনার মনের সেই ভাবনা সমুহের প্রকাশ হবে প্রধানত শান্ত বা স্থিরাবস্থায় আপনার মনের মধ্যে ভেসে ওঠার মধ্য দিয়ে। কবিতাকে তাই কেউ হয়তো শব্দ নিয়ে খেলা, আবার কেউবা ভাবের বাহন বলে অভিহিত করেছেন। সহজ করে বলতে গেলে, আপনার মনের কথাগুলোকে যদি খুবই শিল্প-সমন্বিত উপায়ে আপনি একটি শাব্দিক রুপ দেন, তা হয়ে যায় কবিতা। কবিতাকে কোন নির্দিষ্ট আকার বা ফর্ম-এ বেধে ফেলতে যাওয়ার ব্যাপারটা হয়তো তাই মুর্খতারই নামান্তর। তবে কবিতা বা poem-এর সাথে যেহেতু verse শব্দটার একটি ওতোপ্রতো সম্পর্ক বিদ্যমান, তাই কবিতার কথা শুনলেই আমরা মোটামুটি ছন্দ খুজে পাওয়ার একটা প্রয়াস চালাই।
যদিও বেশ পুরাকাল হতেই Blank Verse বা ছন্দহীন কবিতা রচিত হয়ে আসছে। তবে এ বিষয়ে উইকিপিডিয়া যা বলে তা হলোঃ Poetry often uses particular forms and conventions to suggest alternative meanings in the words, or to evoke emotional or sensual responses. Devices such as assonance, alliteration, onomatopoeia, and rhythm are sometimes used to achieve musical or incantatory effects. অর্থাৎ বলা চলে, Blank Verse বা ছন্দহীন কবিতা রচিতে হলেও কবিতা বলতে আমরা কিছু নির্দিষ্ট ফর্ম-এর কথাও বুঝে থাকি যার মাধ্যমে কবিতা মিউজিক্যাল ইফেক্টস্ অর্জন করে।
কবিতার আলোচনার ক্ষেত্রে এর Genres-এর আলোচনা সবিশেষ জরুরি, কারণ এর মধ্য দিয়ে আমরা কবিতা রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ন্যুনতম হলেও ধারণা অর্জন করতে পারি। কবিতার কতগুলো উল্লেখযোগ্য Genre হলোঃ গীতি কবিতা, শোক কবিতা, ব্যাঙ্গাত্মক বা বিদ্রুপাত্মক কবিতা, নাট্যকাব্য এবং মহাকাব্য। এ সব ধরণের কবিতার মধ্য দিয়েই কবিরা মুলত কখনো নিজস্ব আবেগ অনুভুতি আবার কখনো চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন।
তবে মহাকাব্য রচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, পৌরাণিক বা ধর্মগ্রন্থভিত্তিক কাহিনির আশ্রয় গ্রহনের ঘটনা সমধিক। এই বিষয়ে আমরা ইংরেজ কবি মিল্টনের ‘Paradise Lost’ ও ‘Paradise Regained’ এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাধ বধ’ মহাকাব্যের কথা উল্লেখ করতে পারি। তবে, কবিতার বিষয়বস্তু বা সাবজেক্ট ম্যাটার যাই হোক না কেন, তা সকল মানুষের উপযোগী করে রচিত হওয়া বাঞ্চনীয়, এই মত আধুনিক কাব্যতত্ত্ববিদদের। একারণেই বোধকরি, আধুনিক কবিদের কবিতার বিষয়বস্তু প্রধানত মানুষ।
কবিতা যে ‘imitation of life’, সে কথা বহুকাল আগে বলে গেছেন Aristotle. Poetics-এর মধ্যে Aristotle লিখেছেনঃ Since the objects of imitation are men in action, and these men must be either of a higher or a lower type (for moral character mainly answers to these divisions, goodness and badness being the distinguishing marks of moral differences), it follows that we must represent men either as better than in real life, or as worse, or as they are.
কবিতা এক গভীর জীবনবোধের বিষয়।
কবিতা রচনা করার আগে কবিতার পাঠক হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন সকল কবি। যত বেশি কবিতা পড়া যায়, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তা তত বেশি সহায়ক হয়ে ওঠে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, সমসাময়িক কালে কবি’র ট্যাগ লাগানো এই কবিরা কবিতা অধ্যয়ন থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে দাঁড়িয়ে। ভাবখানা এমন, যেন ভূতপূর্ব কবিরা কোন কবিই ছিলেননা। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ভাষার ব্যাবহারও একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ছন্দ মেলাতে গিয়ে যদি ‘Language Laps’ হয়ে যায়, তাহলে তাতে ছন্দের গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তা বড়ই দৃষ্টিকটু ঠেকে। একটি চমৎকার কবিতা তখনই বের হয়ে আসে, যখন জীবনবোধ, চমৎকার শব্দচয়ন, ও কল্পনার অবাধ বিস্তার—এই তিনের অপূর্ব মিশেল ঘটানো যায়। অথচ, কবির ট্যাগ লাগানো এই কবি দের বেলায় জীবনবোধ তো যেন কবিতার হন্তারক! সুগভীর জীবনবোধ নয়, বরং আত্মমত প্রচারই কবিতা লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য এই সকল কবিদের কাছে। আর, শব্দচয়নের কথা না বলাই ভালো। শব্দচয়নের বাহারী রুপ দেখে তো শব্দ বাবাজী নিজেই কুপোকাত!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।