ডাস্টবিনে মাথা নুইয়ে চুল কেটে দেয়া হয় ১৬ শিশুদের লেখাপড়া শেখাতে ভর্তি করেছি টর্চার করতে নয় : অভিভাবক
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে মধ্যযুগীয় কায়দায় ১৬ শিশু ছাত্রকে ডাস্টবিনের ওপর মাথা রেখে চুল কেটে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি আইডিয়াল স্কুলের ইংরেজি শাখার ৪র্থ শ্রেণীতে এ ঘটনা ঘটে। এ ছাত্রদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এভাবে চুল কেটে দেয়ার ঘটনা সে স্কুলে প্রায়ই ঘটে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এছাড়াও ছাত্ররা ক্লাসে পড়া না পারলে কিংবা দুষ্টুমি করলে তাদের মাথা নিচু করে (নিলডাউন) বসিয়ে রাখাসহ বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়। এছাড়াও কেউ লেখাপড়া না পারলে তাদের অন্য ছাত্রদের থেকে আলাদা করে কারাহাজতের মতো একটি স্থানে আটকে রেখে শাস্তি দেয়া হয়।
কোন ছাত্রের অভিভাবক এভাবে শাস্তি দেয়ার প্রতিবাদ বা অভিযোগ করলে ওই ছাত্রের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হয়। এছাড়াও তাদের বস্নাকলিস্ট (কালো তালিকাভুক্ত) করে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। শিশু ছাত্রদের অভিভাবক, স্কুলশিক্ষক ও সরজমিনে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। কয়েকজন ছাত্রের অভিভাবক জানান, আইডিয়াল স্কুলের ইংরেজি শাখার ৪র্থ শ্রেণীর কমপক্ষে ১৬ জন ছাত্রকে গত ২২ সেপ্টেম্বর স্কুলের এক শিক্ষক ডেকে নিয়ে চুল বড় হয়ে গেছে_ এ অভিযোগে প্রচ- মানসিক নির্যাতন করে। পরে সেলুন থেকে নাপিত ডেকে এনে তাদের মাথার চুল এলোমেলো করে কেটে দেয়া হয়।
চুল কাটার অপমান সহ্য করতে না পেরে ৯ থেকে ১০ বছরের বয়সের শিশুরা বাসায় গিয়ে বাবা/মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। শিশুদের করুণ কান্নায় পুরো পরিবারে ক্ষোভ দেখা দেয়। তাদের অনেকেই বিষয়টি এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। অনেকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে জানিয়েছেন। তারা চুল কেটে দেয়া শিশু ছাত্রদের নাম ও রোল নম্বর এ প্রতিবেদকের কাছে প্রকাশ করেছেন।
চতুর্থ শ্রেণীর আবর্যার, সাগুপ্তি, ফারহান, রাদ, আলভি, কাব্য, নিহাল, আনিস, মুত্তাকিন, মাহির, জাওয়াদ, হাসান, আবদুর রহমান, আবদুল্লাহ, সাফিন নামে ১৫ জন শিক্ষার্থীকে মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে স্কুলে চুল কেটে দিয়ে অহরহ মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী সংবাদ'কে জানান, ঈদের ছুটির পর স্কুলে গেলে শরীর চর্চার শিক্ষক তার ছেলেকে (ইংরেজি শাখায় ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র) বকাবকি করে এক পর্যায়ে নাপিত ডেকে মাথায় ৩/৪ জায়গায় চুল কেটে দেয়। এভাবে একই শ্রেণীর আরও ১৪/১৫ জনকে ডেকে নিয়ে ডাস্টবিনের ওপর মাথা নুইয়ে রেখে শাস্তি হিসেবে মাথার ২/৩ জায়গায় চুল কেটে দেয়া হয়। চুল কাটার সময় ছাত্ররা শিক্ষকদের ভয়ে কাঁপতে থাকে বলে কয়েকজন ছাত্র জানায়।
৪র্থ শ্রেণীর শিশু ছাত্রের অভিভাবক নিঘাত সুলতানা সংবাদকে বলেন, আইডিয়াল অর্থ আদর্শ। আমরা বাচ্চাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ওই স্কুলে দিয়েছি। কিন্তু সেখানে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। এতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি এই নির্যাতন বন্ধের দাবি জানান।
গতকাল রোববার দুপুরে এ প্রতিবেদক সরজমিনে আইডিয়াল স্কুলে গেলে ২ ছাত্র এ প্রতিবেদককে বলে, স্কুলের ছেলেদের টুপি পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও চুল খুব ছোট করে কাটতে বাধ্য করা হয়। চুল বড় দেখা গেলে তা কাটার জন্য নোটিশ দেয়া হয়। না কাটলে নাপিত ডেকে মাথার ২/৩ জায়গায় কেটে দেয়া হয়। এছাড়াও ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়।
আবার কাউকে ক্লাস থেকে বের করে বাইরে কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কাউকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গতকাল দুপুরে ৪র্থ তলার ৪০২ নম্বর রুমে এক শিশু ছাত্রকে ক্লাস চলা অবস্থায় ফ্লোরে হাঁটুর উপর মাথা নিচু রেখে বসিয়ে রাখতে দেখা যায়। ২ ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলে তারা এই প্রতিবেদককে বলে, 'এটা ক্রেকডাউন'। এছাড়াও 'নিলডাউন' আছে।
কয়েকজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়।
গতকাল দুপুরে এই প্রতিবেদক ৪/৫ জন ছাত্রকে ক্লাস রুম থেকে আলাদা করে হাজতখানার মতো ৩ পাশে দেয়াল ও রড দিয়ে ঘেরা এক জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পান। এটা কেমন সাজা জানতে চাইলে ২ জন ছাত্র বলে, এটাতো 'নরমাল শাস্তি'।
এ ব্যাপারে গতকাল আইডিয়াল স্কুলের ইংরেজি শাখার এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ'কে বলেন, এ স্কুলে চুল ছোট রাখার ব্যাপারে কড়াকড়ি আছে। তবে এ ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন।
আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগমের সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, নিয়ম হলো ছাত্রদের চুল ছোট থাকবে। ছাত্রদের বছরের শুরুতে যে ডায়েরি দেয়া হয় তাতে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। তা অনুসরণ করতে হয়। ছাত্রদের চুল কেটে দেয়ার বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান। তিনি বলেন, চুল বড় হলে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ডাস্টবিনে ছাত্রদের মাথা নুইয়ে চুল কাটার খবর তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে শুনেছেন বলে জানান।
ইংরেজি শাখার এক শিক্ষক ছাত্রদের চুল কেটে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, শাহজাহান আলী নতুন শিক্ষক, তিনি না বুঝে নাপিত ডেকে ছাত্রদের চুল কেটে দিয়েছেন। তিনি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ধরনের আর ঘটনা ঘটবে না বলে তিনি জানান।
ইংরেজি শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক ইস্কান্দার আলী বিশ্বাস সংবাদ'কে মোবাইল ফোনে জানান, ছাত্রদের চুল কাটার জন্য নোটিশ দেয়া হয়।
প্রথম নোটিশে না কাটলে দ্বিতীয়বার নোটিশ দিয়ে ৭ দিন সময় দেয়া হয়। সময় শেষ হওয়ার আগে ভুল করে শিক্ষক শাজাহান আলী ১৫/১৬ জন ছাত্রের চুল কেটে দিয়েছেন। এজন্য তারা দুঃখিত। এমন ভুল আর হবে না বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর শারীরিক শাস্তি বন্ধে নতুন করে নীতিমালা জারির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এরপরও খোদ রাজধানীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।