স্বপ্ন ছুঁয়ে
ঘুম থেকে উঠে দীপা প্রথমে বুঝতে পারল না এটা সকাল না বিকেল! এই সমস্যাটা তার মাঝে মাঝেই হয়। কেমন যেন ভুলে যায় কিছুক্ষণের জন্য সকাল না বিকেল! ছোটবেলাতেও এটা হত। একবার বিকেলে সে ঘুম থেকে উঠে একা একা স্কুল ড্রেস পরে ফেলেছিল স্কুলে যাবে বলে!ঘটনাটা দেখে কি যে হাসছিল মা। বারান্দায় এসে দাঁড়াল ও। বিকেলটা কেমন করে যেন সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকালে কখনই বিষন্ন লাগে না। অথচ বিকেলবেলা ব্যাপারটা ঠিক উলটো। বিষয়টা বুঝতে পারে না দীপা। কেন যে এমন হয়। চোখের কোণায় একটা নড়াচড়া দেখে ঝট করে পাশ ফিরে ও।
যা ভেবেছিল তাই। পাশের বাড়ির ছাদ থেকে তাকিয়েছিল ছেলেটা, হঠাৎ করে দীপা তাকাতেই তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। হেসে ফেলল ও। ঘরে ঢুকতেই নিপা এসে দাঁড়াল ওর সামনে। "উফ আপা তুই যে কি, দুপুরে কেউ এত ঘুমায়? ছুটির দিন গুলাতে কেউ এমন ঘুমায়? চল না, সিনেপ্লেক্সে যাই।
"জাগো", মুভিটা চলতেছে। "। নিপার কথার গাড়ি একবার চলতে শুরু করলে থামে না। ওর দিকে তাকিয়ে মনটা খারপ হয়ে গেল দীপার। কেউ কি জানে কি অদ্ভুত ভালো একটা মন আছে এই মেয়েটার।
কিন্তু ওর চেহারাটা ভালো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল দীপা। "কিরে আমাকে দেখে এমন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? আবার চুপ করে হাসছিস!"। "নিপা তোকে না আজ অনেক সুন্দর লাগছে"। দীপা জানে, এই কথাটা বললে কত খুশি হয় নিপা! "ধুর", বলেই খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল নিপার চোখ।
সকালবেলা গলির মোড়ে দেখা হয়ে গেল পাশের বাড়ির ছেলেটার সাথে। "শুনেন",সামনে দাঁড়িয়ে বলে দীপা। ভয় পাওয়া চোখে তাকায় ছেলেটা। "আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন? তাহলে যে বিকেলবেলা আমাকে বারান্দায় দেখলে তাকিয়ে থাকেন? তখন ভয় পান না?", হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে দীপা। সহজ হতে পারে না ছেলেটা।
কেমন বোকার মত তাকিয়ে থাকে। "কারো বারান্দায় উঁকি দেয়া কিন্তু ঠিক না", কথাটা বলেই চলে যায় ও। ছেলেটাকে পিছনে রেখে রাস্তার এ পাশে আসতেই বাবাকে দেখতে পায়। দীপার বাবা মিনহাজুর রহমান কোন কিছু করেন না। ওদের দোতলা বাড়ির ভাড়া থেকে যা পান আর গ্রামের জমিজমা তা দিয়ে ভদ্রলোক সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।
বাবার খুব মজার একটা ব্যাপার আছে। রাস্তায় বাবার সাথে হাঁটলেই বাবা আস্তে আস্তে কথা বলেন আর অনেক উপদেশ দেন! সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে এটা দীপা। খুব মজা লাগত এটা। কারণ বাবা যখন এভাবে কথা বলতে বলতে স্কুলে দিয়ে আসতেন, তখন রাস্তায় যাই কিনতে চাইত দীপা , তাই কিনে দিতেন তিনি। "কিরে ভার্সিটিতে যাচ্ছিস?"।
'হ্যাঁ , বাবা"। "আয় তোকে রিকশা ডেকে দিচ্ছি"। ভার্সিটির বাসের কথা বলে দীপা যা বলল তা বাবা খেয়াল করলেন না। কারন তিনি কথা বলা শুরু করেছেন। মজা লাগছে দীপার," শোন, ভার্সিটিগুলোতে তো রাজনীতি আর রাজনীতি।
খবরদার , ওগুলোতে জড়াবি না কিন্তু। পড়াশোনায় একদম ফাঁকি দিবি না......................"। রিকশাতে উঠে চোখে পানি চলে আসে দীপার।
অস্থির ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকচ্ছে রাশেদ। সামনে চা।
মুখে দিচ্ছে না। দূর থেকে কিছুক্ষন দেখল দীপা ব্যপারটা। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, "তুমি তো আমার সামনে এত অস্থির থাকো না। কিন্তু একা বসে থাকলে এমন করো কেন?"। বেশ লজ্জা পেয়ে বলেছিল রাশেদ,"তোমার জন্য অপেক্ষা করলেই কেমন যেন অস্থির বোধ করি।
যদি তুমি না আস"। অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দীপা। " কি ব্যাপার , তোমার না এখন ক্লাশ?"। হাসে রাশেদ কিছু বলে না। "তুমি যে এত ক্লাশ ফাঁকি দাও! "।
" নাস্তা করে আসছ?"। "না" বলে দীপা। "তাহলে বস, নাস্তা নিয়ে আসি। " নাস্তা শেষ করতেই রাশেদ বলে," দীপা তোমার সাথে কথা আছে"। "বল , শুনছি"।
"তুমি তোমার মার ব্যাপারটা আমাকে জানাও নি কেন?"। স্তব্ধ হয়ে যায় দীপা। ওরা দু বোন ছোট থাকতে মা আরেকজনের সাথে চলে গিয়েছিল। দীপা তখন ক্লাশ টুতে পড়ে। একদিন সন্ধ্যাবেলা অবাক হয়ে দু বোন দেখল, মা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আর বুয়াকে বলে গেল , মিনহাজ সাহেব না আসা পর্যন্ত বাসায় থাকতে। 'আমি তোমাকে বলি নি, কারন তুমি জানতে চাও নি। আর এটা বলা কত কষ্টের তা তুমি বুঝবা না"। "আমি জানতে চায় নি কারন আমি ভেবেছিলাম তোমার মা নেই"। "কি বলতে চাও এখন? আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও না , এটা? এরকম পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়েতে তোমার মা রাজি হবেন না, তাইতো?"।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাশেদ।
গুলশানের এই বাড়িটার ঠিকানা দীপা আগে থেকেই জানত। কিন্তু কোনদিন ইচ্ছা হয় নি এখানে আসতে। আজ সেই বাড়ির গেটের সামনে নিজেকে দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল। খুব ইচ্ছা করছে একবার ভিতরে ঢুকতে।
কেমন আছেন সেই মহিলা এখন, একবার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। গেটের দারোয়ানকে ডাকার আগ মুহুর্তে ঘুরে দাঁড়ায় দীপা।
কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল নিপা। "কিরে আপা, কোথায় ছিলি তুই? তোর ফোন বন্ধ কেন? রাশেদ ভাই দুপুর থেকে বসে আছে। "উত্তর না দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায় দীপা।
"বাবা কোথায়?"। "শুয়ে আছে রুমে"। দীপাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল রাশেদ। 'তুমি বাসায় এসেছ কেন?'। " তোমার ক্লাশ তো একটায় শেষ ছিল।
এরপর তোমাকে পেলাম না। ফোন ও বন্ধ। খুব অস্থির হয়েই তোমার বাসায় এসেছি। " সোফায় বসে পড়ে দীপা। "দীপা শোন,আমার বাবা নেই তুমি জান।
মা ভাইদের সংসারে পড়ে আছেন কোন মতে। আমি কিন্তু তোমার মার ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিলাম শুধু এটা ভেবে যে, তুমি আমাকে কেন এটা বললা না। তুমি তাহলে নিশ্চয় ভেবেছিলে, এটা জানলে আমি তোমাকে ছোট ভাবব। তোমার এই ভাবনাটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। তাই কথাগুলো বলেছিলাম।
কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝলা। " চুপচাপ বসে থাকে দীপা। "আমার টিউশনি আছে,আমি যাচ্ছি"। চলে যায় রাশেদ।
মাঝরাতে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় দীপা।
কি চমৎকার জোছনা বাইরে। হঠাৎ খুব কান্না পায় ওর। এসময়ে ফোনটা বেজে ওঠে। "দীপা, তুমি কি কাঁদছ?", "না ", ধরা গলায় বলে ও। " দীপা, কবিতা শুনবা? "।
"শুনব"। "প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস.....তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ"। "তুমি কি এই দুই লাইন ছাড়া আর কিছু পারো না!" হাসতে হাসতে বলে দীপা। ওপাশ থেকে জবাবটা শুনে দীপা। আরেকবার তাকায় বাইরে।
কি অসহ্য সুন্দর আলো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।