যেন বাংলাদেশই কলংকিত হলো
শওগাত আলী সাগর
নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে গত সোমবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নামধারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি অংশ যে জঘন্যতম ঘটনা ঘটিয়েছে তা ন্যূনতম বিবেকবোধ আছে এমন যে কোনো মানুষকেই হতবাক করে দিয়েছে, করেছে লজ্জিতও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা এমনকি একই দলের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা অহরই ঘটে থাকে। অগ্রহনযোগ্য হলেও এই সব খবর এখন আর সাধারন জনগোষ্ঠীকে মোটেও ভাবায় না। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় প্রকাশ্যে মারমারিতে জড়িয়ে পড়া ? ভাবতেও যেন গা শিউরে ওঠে! কিন্তু গা শিউরে ওঠার মতো জঘন্য কাজটি ঘটেছে এবং যারা ঘটিয়েছে তারা প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারেই তা ঘটিয়েছে।
একটি দেশের সরকার প্রধানের সমর্থক গোষ্ঠী যেমন থাকে, তার বিরুদ্ধপক্ষও থাকে।
এটাই গনতান্ত্রিক রীতি। কিন্তু সরকারপ্রধান যখন নিজ দেশ ছেড়ে ভিন্নদেশে অতিথি হয়ে যান, তখন আর তিনি শুধুমাত্র সরকার প্রধানই থাকেন না, তিনিই তখন পুরো বাংলাদেশ। তাঁর গায়ে অসম্মানের কাঁটা লাগলে পুরো দেশই অসম্মানিত হয়। জাতির দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ এমন লোকদেরই নিয়ন্ত্রনে যাদের দেশপ্রেমতো দুরের কথা দেশের জন্য সম্মানবোধটুকুও নেই। থাকলে বিশ্বের রাজধানী বলে খ্যাত নিউইয়র্কের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম হতো না ।
প্রকাশ্যে মিছিল, মিটিং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া , ভিনদেশি যাত্রীদের লাগেজ ভাঙচুর করার যে বিবরণ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে তাতে এই লোকগুলোকে কোনো বিবেচনায়ই রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে মানা যায় না। মনে হয়, এরা যেন পেশাদার কোনো গুণ্ডাবাহিনী। এই সব গুণ্ডাবাহিনীই যখন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর আশীর্বাদ পায় তখন আর নাগরিক হিসেবে আমাদের মুখ লুকোনোরও জায়গা থাকে না ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে এসেছেন জাতিসংঘের ৬৫তম অধিবেশনে যোগ দিতে। তাঁর এই সফরকে ঘিরে নিউইয়র্কে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বরে আগেই সংবাদ মাধ্যমগুলো আভাস দিয়েছিলো।
মূলত: বাংলাদেশের সরকার প্রধানের জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সময়টায় এই ধরনের উত্তেজনা তৈরি হওয়া নতুন কিছু নয়। বিগত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসেন, তখনো অধিবেশনে যোগ দিতে যাবার সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। পাল্টা হিসেবে বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মী-সমর্থকরা আনন্দ সমাবেশ করেছে। এতে এই দুইটি দলের আদৌ কোনো লাভ হয়েছে কী না তা কোনো দলই যে খতিয়ে দেখে নি তা নিশ্চিত। আওয়ামী লীগ দল হিসেবেও সেদিন এই ধরনের তৎপরতাকে নিরুৎসাহিত করেনি।
নিউইয়র্কের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কথাই বাদ দিলাম, যদিও নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ একজন নেতা নামের আগে ‘অধ্যাপক’ শব্দটি ব্যবহার করেন, কেন্দ্রীয় নেতারাও তাদের নিরস্ত্র করার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অন্তত আমরা খবর পাইনি। আওয়ামী লীগ সেদিন বেগম খালেদা জিয়াকে নিতান্তই বিএনপি নেত্রী হিসেবে দেখেছে, প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে নি। আওয়ামী লীগের মনে হয়নি, বিদেশ-বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অসম্মান হলে বাংলাদেশেরই অসম্মান হয়।
এ বছরও শেখ হাসিনার সফরকে ঘিরে একই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগ মিডিয়ায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ঘোষনা করেছিলো, প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি শেখ হাসিনা ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণদানকালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক খালিদ হাসানের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও সকল সহযোগী অঙ্গসংগঠন, জাতীয় শ্রমিকলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, নিউইয়র্ক স্টেট আওয়ামী লীগ, নিউইয়র্ক সিটি আওয়ামী লীগ, নিউ ইংল্যান্ড আওয়ামী লীগ, বোস্টন আওয়ামী লীগ, নিউজার্সি আওয়ামী লীগ, ফ্লেরিডা আওয়ামী লীগ, লসএঞ্জেলস আওয়ামী লীগ, ক্যালিফর্নিয়া আওয়ামী লীগ, ওয়াশিংটন ডিসি আওয়ামী লীগসহ প্রবাসের মুক্তিযুদ্ধের পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শান্তি সমাবেশ করবে।
অপরদিকে নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপি গত ৬ সেপ্টম্বর জ্যাকসন হাইটসে এক সভা থেকে ঘোষণা দিয়েছে, নিউইয়র্কে যেখানে শেখ হাসিনা, সেখানেই প্রতিরোধ। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতৃবৃন্দ ২৭ সেপ্টম্বর জাতিসংঘ সদর ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশেরও ঘোষনা দেয়। ফলে ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়েই উত্তেজনা তৈরি হচ্ছিলো। কিন্তু তারঁ আগেই বিমান বন্দরেই এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটবে তার জন্য সম্ভবত কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা বিমান বন্দরে গিয়েছিলো তাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে।
কিন্তু সেখানে ব্যানার ফেষ্টুন নিয়ে যেতে হবে কেন? আমেরিকার মতো উন্নত, সভ্য একটি দেশে বছরের পর বছর থেকে তাহলে তারা কি শিখলেন। ভারত-পাকিস্তান এমনকি উপমহাদেশের অন্য অনেক দেশের সরকার প্রধানই তো নিউইয়র্কে সফরে আসেন। তখন কি ভারতীয়, পাকিস্তানী বা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রবাসীরা এইভাবে বিমানবন্দরে ছুটে যায় ? আর বিএনপি ? তাদেরই বা কেন বিমান বন্দরে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে হবে? আমেরিকায় থাকছেন, অথচ আমেরিকান আইনের প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা নেই। তাদের কি বাংলাদেশের জন্যই কোনো শ্রদ্ধাবোধ আছে? পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পড়ে প্রতীয়মান হয় বিএনপি অনেকটা পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়াটা বাধিয়েছে। (আমি এই বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে আমারদেশে প্রকাশিত ইলিয়াস খানের রিপোর্টটি পড়েই এই মন্তব্য করেছি।
) আওয়ামী লীগের তাদের নেত্রীর সম্মান রক্ষার চেয়েও নিজেদের শক্তির পরীক্ষা দিতে চেয়েছে। ফলে দুটি দল মিলেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশকে অপমানিত করেছে।
গত কয়েক বছর ধরেই জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ – যেন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নিউইয়র্কের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যূ ছাড়াও নানা উটকো ইস্যূ নিয়েও প্রবাসী বাংলাদেশিরা সেখানে কথায় কথায় সমাবেশের আয়োজন করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাই এই সমাবেশগুলোর আয়োজন করে থাকে।
জাতিসংঘের সামনে সমাবেশ করা এবং স্মারকলিপি দেয়ার ভিডিও ক্লিপিং বা ছবি পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকায়। সমাবেশ আয়োজকদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজ নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের আস্থাভাজন হওয়া। নিউইয়র্কের আজকাল পত্রিকার মন্তব্য অনুসারে ‘বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বঙ্গপোসাগরের জলসীমার নির্ধারণে জাতিসংঘের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা, দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সমর্থনে বা দুর্নীতিবাজদের অবাধ মামলা প্রত্যাহারের বিরোধীতা বা দেশে বিদেশী বিনিয়োগের দাবিতে তেমন সমাবেশ দেখা যায় না জাতিসংঘ সদর ভবনের সামনে। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন দলের সমর্থকরা এখানে এসে রুটিন মাফিক সমাবেশ করছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী এলে তো পক্ষে ও বিপক্ষে সমাবেশ আয়োজন নির্ধারিত হয়ে থাকে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জাতিসংঘে আসেন। তাদের দেশের প্রবাসীরা এ ধরনের কর্মসূচি পালন করেন-এমন দেখা যায় না। ‘
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা নিষিদ্ধ করার একটি প্রস্তাবনা নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা হয়েছিলো। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেই আলোচনাটা চাপা পড়ে গেছে। নিউইয়র্কের এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর নতুন করে প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতি নিয়ে ভাবা জরুরী হয়ে পড়েছে।
সাধারনভাবে খোদ বাংলাদেশেই রাজনীতি এখন জনকল্যান বা দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত তেমন কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয় না। প্রবাসে যারা সক্রিয় রাজনীতি জড়ান তাদের অধিকাংশই কোনো আদর্শবোধ দ্বারা তাড়িন নন, বরং ভিন্ন সংস্কৃতির একটি দেশে আত্মপরিচয়ের (আইডেনটিটি ক্রাইসিস) থেকেই তারা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। কর্মসূত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠা বা আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় অক্ষম ব্যক্তিগুলো আঞ্চলিক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে পরিচয় বহন করে সমাজে গ্রহনযোগ্যতা পাবার চেষ্টা করেন। ফলে প্রায়শই দেখা যায়, পেশাজীবা সৃষ্টিশীল মানুষগুলো এই সব উদ্যোগ আয়োজন থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখেন।
আমরা স্পষ্টত:ই বলতে চাই, লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ‘গুণ্ডাবাহিনীর’ হাতে অপমানিত হবে তা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আবারো বলি, নিউইয়র্কের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্মদাতাদের আমি ‘গুণ্ডা’র বাইরে আর কিছু ভাবতে চাই না। এই ধরনের গুণ্ডামির পূনরাবৃত্তিরোধে প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতি এখনই বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিৎ তাদের দলের নামে ভিন্নদেশে যে কোনো তৎপরতা চালানো সম্পূর্ণই বেআইনি । এই বেআইনি কর্মকাণ্ডকে পৃষ্ঠপোষকতা তারা করতে পারেন না।
আবারো নিউইয়র্ক কেলেংকারিতে ফিরে যাই।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আওয়ামী-বিএনপি লেবাসধারী গুণ্ডারা জেএফকে বিমানবন্দরে প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশকে লাঞ্চিত করেছে, করেছে অপমানিত। সচেতন দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাংলাদেশিদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার আহ্বান জানাই। আসুন আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারন করি, কোনো রাজনৈতিক দলের বা অন্য কোনো পরিচয়েই বাংলাদেশকে অপমানিত করার অধিকার কারোই নেই।
লেখক : শওগাত আলী সাগর, সাংবাদিক। নতুনদেশ ডটকম এর প্রকাশক।
http://www.notundesh.com/motmotantor.html
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।