LIVING IN CUONTRY SA
নদী যখন সৈকতে
ভুমিকা
তখন ১৯৯২ সাল। মাদ্রাসা থেকে হঠাৎ করে স্কুলে এসে সপ্তম শ্রেণীতে এসে ভর্তি হয়েছি। চারিদিকে নতুন পরিবেশ। বেশ চমৎকার লাগছিলো। দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল\ ডিসেম্বরের ৯ তারিখে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুলের কৃষ্ণচুড়া গাছের সামনে এসে দাড়ালাম।
আমার বিগত এক বছরের এক ঘনিষ্ঠ (!) ক্লাসমিট আজ শহরে চলে যাচেছ। সেখানে থেকে পড়াশুনা করবে। হঠাৎ আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। বাড়ি ফিরে মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ভাবলাম, এখনতো বেশ অবসর, পুরো এক বছরের হর্ষ বিষাদের ঘটনাগুলো লিখে ফেললে কেমন হয়। কিন্তু পারলাম না।
মানুষ স্বভাবতই কল্পনাপ্রবণ। তাই সবকিছু মিলিয়ে আমার কলম থেকে যা বেরিয়ে আসলো, দেখতে তা অনেকটা উপন্যাসের মতো। খুব ছোট্টবেলার লেখা বলে অনেক ভুল থাকতেই পারে। ক্ষমা সুন্দরদৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
--লেখক
।
। এক। ।
রক্তিমাভা গ্রাম।
আঁকা বাকাঁ মেঠো পথ বয়ে চলেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে।
গ্রামটির মধ্যদিয়ে একটি শুষ্ক নদী চলে গেছে। নদীটি অনেকটা সুতার মতো সর হয়ে এসেছে। একদা নদীটি ছিলো প্রমত্ত । বিশাল জলরাশি গর্র্জন করে উঠতো। নদীর নাম ছিলো কান্নামাখা।
সত্যিই যেন অনেকটা কান্নামাখা নদী। কিন্তুু কালের গর্ভে মিলিয়ে গেছে বেশ ক‘টি যুগ। নদী বললে এখন লোকে আর হয়তো বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু স্থানীয় জনগন আজও মাঝে মাঝে এ নদীর তীরে বসে এর অতীত কাহিনী আলোচনা করে। নদী তীরে গড়ে উঠেছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
সে বিদ্যালয়ে পড়ে ছোট্ট একটি মেয়ে, নদী। এ বছর ষষ্ঠ শ্র্রেণীতে এসে ভর্তি হয়েছে।
নদীর বাড়ী পাশের গ্রামে। গ্রামের নাম নারিকেল বাড়িয়া । নারিকেল বাড়িয়া থেকে পায়ে হেটে স্কুলে আসে নদী, গেয়ো মেঠো পথ পেরিয়ে ।
সে মধ্যবিত্ত পরিবারের আদুরে মেয়ে । তারা তিন বোন, দুই ভাই। সবাই অবিবাহিত। নদী সবার ছোট। সে সবার ছোট বলে সবার খুব আদরের ।
বাবা অবসর প্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আফজাল হোসেন । বাবা নদীকে খুব বেশি আদর করেন। আজ তিনি অতি বৃদ্ধ,সাদা দাড়িবিশিষ্ট ব্যক্তি । গায়ে আর পর্বের ন্যায় এত জোর নাই। নদীর বড় ভাই শহিদ কলেজে পড়ে ।
নদী ও তার বড় দুবোন ডলি ও হাবীবা একই বিদ্যালয়ে যথাক্রমে ষষ্ট , দশম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। নদী অত্যš মেধাবী ছাত্রী । স্কুলে এসেই তার নানাবিধ স্বকীয় গুনে সবার মন কেড়ে নিয়েছে। শিক্ষকেরা নদীকে অতি আদরের দৃষ্টিতে দেখেন । নদীর স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক একরাম আহমদ।
ক্লাসে ঢুকেই আজ তিনি নদীকে বললেন, “দী ব্যালী অনলী ইটস্ এন্ড úীপ----” থেকে শুর করোতো। উছারণ নিয়ে একরাম স্যার অনেক কষাকষি করেন । নদী পড়তে শুর করল। একরাম স্যার থামিয়ে দিয়ে বললেন- ‘হয়নি‘। আমার শুনে চেষ্টা কর।
তাতেও নদী ব্যর্থ হলে তিনি সোহেলকে ইংরেজি পড়তে বললেন । এভাবে প্রায়
প্রতিদিন চললো ইংরেজি ক্লাশ। ক্রমে সোহেল একরাম স্যারের প্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো।
সোহেলের বাড়ী স্কুলের পর্ব দিকে। তার ইংরেজী উচারণ শুদ্ধ হলেও লেখাপড়ায় ঘোড়ার ডিম।
অপর দিকে নদী অত্যš মেধাবী ছাত্রী। ক্রমে দিন যেতে লাগলো। একদিন ক‘টি দুষ্ট ছেলে মিলে সোহেলকে বললো,
ঃচল্না; কমনরমে গিয়ে নদীর সাথে আলাপ করে আসি।
ঃকমনরমে গিয়েই তারা শুর করল -
ঃ“সোহেলতো আসতেই চায় না, অনেক বলে কয়ে নিয়ে এসেছি। ” নদী বিরক্ত সুরে বলল,
ঃ“তোমাদেরকে কে বলেছে তাকে নিয়ে আসতে ?”
ছেলেগুলো বলে উঠল -
ঃকেউ বললেই বুঝতে হবে ? ’
ঃকেন? না বললেও বুঝে নিতে হয় নাকি ?
ঃঅবশ্যই ! তোমার হাবভাব দেখেই তো ্আমরা বুঝে নিয়েছি।
ঃকি বলতে চাও তোমরা?
ঃকেন? তুমি কি সুহেলের জন্য অপেক্ষা করছিলে না?
ঃমুখ সামলে কথা বলো নইলে স্যারের কাছে বিচার দেব!
ঃযা সত্যি তাই বলছি, এত লাগছে কেন?
অগত্যা নদী ছাত্রীদের নিয়ে অফিসে বিচার দিলো। সাজা স্বরপ ইংরেজি স্যার একরাম আহমদই প্রদান করলেন প্রতেককে দশটি করে বেতের বাড়ি আর সযের্র দিকে আধ ঘন্টা চেয়ে থাকা। সুহেলও বাদ গেলো না। এরপর থেকে শুর হলো ক্লাশে টিপ্পনি কাঁটা।
ঃ কোথাকার কোন গ্রামের মেয়ে এসে সবাইকে শাসন করছে।
ঃ করবে না! যে মেয়ে! আগামীতে রোজ কাজও করাবে।
ইত্যাকার বহু কথা চলতে থাকলো। আ¯ে আ¯ে পরীক্ষা এগিয়ে এলো। দুষ্ট ছাত্ররা দুষ্টামী নিয়ে মেতে থাকলো। নদী পাঠে মন দিলো।
ক্রমে পরীক্ষা আরো সন্নিকটে এল। কিন্তুু সোহেল তার বন্ধুদের নিয়ে লেখাপড়া রেখে দুষ্টামি চালিয়ে গেল। পরীক্ষা শুর হলো। পরীক্ষা হলে সিট পড়ল পাশাপাশি সোহেল ও নদীর। নদীর কলমে
দ্রততা।
সোহেলের কলমে স্থিরতা। স্থির দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে ওর পেপারের দিকে।
ঃনদী; হাতটা সরানা; একটু লিখি!
ঃকী যা তা বলছিছ! হাত সরাবো কেন?
ঃপ্লিজ সরানা ।
স্যার এসে এক টানে সোহেলের পেপার নিয়ে গেলেন।
সোহেল অনেক কান্নাকাটি করে পেপার নিয়ে এলো কিন্তুু কিছু লিখতে পারলো না।
নদী পর্ণ উত্তর করলো। পরীক্ষা শেষে ফলাফল বের হলো। নদী প্রথম স্থান অধিকার করে সপ্তম শ্রেণীতে উঠলো। সোহেল আ¯ে আ¯ে আরও দুরš হয়ে উঠছিলো । ফলাফলের নোটিশে তার নাম না দেখে সে অত্যš ক্ষেপে গেলো।
সহপাঠী ছাত্ররা বললো-
ঃকি রে সোহেল ; তোর ফল তো ভালই; প্রথম হয়েছিস।
ঃদেখ জামিল। ভাল হবে না বলছি; দলবল নিয়ে কেটে পড়। নইলে এক ঘুষিদিয়ে----------‘
ঃতুই দিবি আমাকে ঘুষি! তোর দলবল তো এমনিতেই কেটে পড়েছে।
ঃতবেরে ব্যাটা দেখ! বলেই সোহেল জামিলের গায়ে এক ঘুষি বসিয়ে দিল।
প্রত্যুত্তরে জামিল ও তার দলবল নিয়ে সোহেলকে চোর পিটা পিটলো। অবশেষে মারামারি নিয়ে অফিসে বিচার, দুদলে সংঘর্ষ, মনোমালিন্য ইত্যাদি নিয়ে সোহেল লেখা পড়া প্রায় ছেড়ে দিয়ে অধঃপতনের দিকে যেতে শুর করল আর রোজ ¯ু‹লে এসে একটা না একটা বিবাদ বাধিয়ে দিত। অপরদিকে তখন স্কুলে আবির্ভাব ঘটলো এক নতুন ছাত্রের। সে মেধাবী, ধনী ও অমায়িক ব্যবহারের। নাম সৈকত।
সৈকত খিলগাওয়ে এক স্কুলে পড়তো। পাঠশালা শেষ করে ঐ স্কুলে গিয়েছিলো। কিন্তুু স¤্রতি স্কুলে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে দাঙ্গা চরমে উঠলে সৈকত নিজ গ্রামে ফিরে আসে ও স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি
হয়। স্কুলে সৈকত জামিলের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে। তার বাড়ি স্কুলের অতি সন্নিকটে।
তারা পর্ব পরিচিত। তাই সৈকত তার সাথে বেশী মিশে।
তখন জানুয়ারী মাস । স্কুলে তখন বার্যিক ক্রীড়া চলছে। ক্লাশ খুব একটা হয় না।
দু‘চারটা ক্লাশ পরে ছেলেরা বল নিয়ে মাঠে নামে । কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট খেলে। মেয়েরা ও ঘরোয়া খেলায় মেতে উঠে । এভাবে ক্লাশ চলতে থাকলো, খেলাধুলাও চলতে থাকলো।
।
। দুই। ।
সৈকত পরিবারের ছোট ছেলে। তারা দু‘ ভাই ও দু‘বোন।
বড় ভাই এফ, আর, সি, এস, দিয়ে বউসহ বিদেশে ডাক্তারি করেন। যথেষ্ট টাকা পয়সা ও আছে। মেঝ ভাই ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বিদেশে চাকরি করেন বিধায় সেখানে থাকতে হয়। দু‘ভাই বাহিরে থাকেন।
মেঝভাবী বাড়িতে। এক বোনের বিয়ে হয়েছে ও অন্যজন জাফনা যার বিয়ের আলাপ চলছে। জাফনা এ বছর এস.এস. সি. দিয়েছে। শ্যামলা মেয়ে সে। রূপের জৌলুস নেই একেবারে।
লেখাপড়ায় মাঝারি মানের হলে ও অত্যš ভদ্র ও নম্র। ডলি , জাফনার ক্লাশমিট। ডলি অসাধারন রপবতী। লেখাপড়ায় ও খুব ভলো। আর এ ডলিরই ছোটবোন নদী।
সৈকত অনেকটা আতœকেন্দ্রিক ছেলে। তাই সে পরিবারের কোন ঘঁটনায় তেমন ভ্রুক্ষেপ করেনা। তার বোনের বান্ধবী কে কখন বাড়িতে এসেছিল কিনা এসব কিছুই সে জানেনা। সে সর্বদা রিডিং রূমে থাকে। বিকেলের দিকে পল্লীর ছোট গ্রন্থাগারে যায়।
সেদিনকার দৈনিক পত্রিকাটা পড়ে। মাঝে মাঝে দু‘একটা গল্প বইও পড়ে। তাই সৈকত নদীর পরিবার সম্বদ্ধে কিছুই জানে না। নদীকে জানার তো প্রশ্নই উঠে না। অবশ্য এর পেছনে কারণ আছে।
সৈকতের পিতাও অবসরপ্রাপ্ত সরকারী আয়কর কর্মকর্তা। বর্তমানে ছোটখাটো একটা টেক্সটাইল মিলের মালিক। তা নিয়ে আর সংসার নিয়ে তিনি ব্য¯। তাই সৈকত গায়ে ফুঁদিয়ে বেড়াতে পারে।
সৈকত খুব মনোযোগী ছাত্র।
ক্লাশে ক‘দিনেই সবার মন জয় করে নিল। আর এ আর্শ্চয্য প্রতিভা দেখে একদিন একরাম স্যার তাকে ক্লাশ ক্যাপ্টেন করে দিলেন। ছাত্ররা তাকে অসাধারন ভাবে মান্য করে। এমনকি সোহেলকেও মানতে হয়। প্রথমদিকে অবশ্য সোহেল মানতে রাজী হয়নি।
যখন দেখলো ক্লাশের সকল ছেলেই তকে মান্য করে, তখন তাকেও মানতে হল। তাছাড়া দুষ্টামি করলেই সৈকত নাম লিখে স্যারের কাছে দিয়ে দিবে; পড়ার ব্যাপারে পরীক্ষা পর্বে ,টাকা পয়সার অভাবে,ইত্যাদি যে কোন বিপদেই সৈকত সবাইকে সাহায্য করে। সুতরাং তাকে মানতে হল। সে দিন দিন
ক্লাসের সেরা ছাত্রে পরিনত হতে চলল। একদিন এক শিক্ষক তাকে বললেন,
এবার সৈকত কে ক্লাসে ১ম হতে হবে ।
ছাত্ররা কখনও ক্লাসে ১ম থেকে ১০ম স্থানে স্থান পায়নি। (বলাবাহুল্য গত বছর ১ম থেকে ১০ম স্থানের মধ্যে কোন ছাত্র ছিল না)।
সংগে সংগে নদী প্রতিবাদ করে উঠল,
না স্যার ! আমি প্রাণেপণে চেষ্টা করবো ১ম স্থান দখল করতে।
এভাবে প্রতিযোগিতাসুলভ মনোভাব নিয়ে লেখাপড়া করলে তোমরা আরও উন্নতি করলে পারবে । স্যার বললেন ,
আমি আমার সাধ্য মত চেষ্টা করব ।
সৈকতবলল , ঠিক আছে দেখা যাবে কে কত পার।
ইতিমধ্যে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা ও এসে গেল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নদী তো তার আর সৈকতের প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখে ‘থ‘ মেরে গেল। সৈকত তার চেয়ে ভাল স্কোর করেছে। নদী দুহাতে মুখ ঢেকে ছোট্ট খুকির ন্যায় কাঁদতে লাগলো।
শিক্ষক ক্লাশে এসে তাকে সাšনা দিলেন।
এদিকে সৈকতও তার রিপোর্ট নদীর সাথে মিলিয়ে থ’ হয়ে গেল। সে প্রতিজ্ঞার পর থেকে খুব মন দিয়ে পড়া শুর করেছিল। কিন্তুু মোট মার্কে সে নদীর থেকে বেশী পেলেও গ্রামারে সে কম পেয়েছে। তাই সে প্রাণপণে গ্রামার পড়তে লাগলো।
সে মনে করেছিল সব বিষয়েই সে বেশী নম্বর পাবে। আর তাই সে এ পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে গ্রামারের স্যার খুজলো। অপরদিকে নদীও প্রাণপনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ কোত্থেকে একটা ছাত্র এসে তাকে পিছনে ফেলবে, এ তার মোটেও সহ্য হলো না। কিন্তু সে ছিলো অটঁল স্বভাবের ।
নদী যে শুধু মেধাবী তাও নয়। অত্যš ফুটফুটে উজ্জল গাত্রবর্ণের দ্বাদশী বর্ষীয়া বালিকা। তাই সে তাকে প্রতিহিংসা করে কিছু বলতেও পারলো না। কেননা ওর চোখে তাকিয়ে কথা বলতে গেলে কথা বেঁধে যায়। কখনও কোন বিষয়ে দুর্বলতা বা দর্ব্যবহার করে না।
মনে মনে নদী সুযোগ খুঁজছে তাকে দু‘একটা কথা শুনিয়ে দেবার, কিন্তু পারে নি। এমতাব¯ায় একদিন তাদের সাথের এক ছাত্রী অসুস্থ। ছাত্র ছাত্রী সবাই
মিলে তাকে দেখতে যেতে ইছা প্রকাশ করলো। সৈকত নিজে স্যারের কাছে দরখা¯ লিখে দরখা¯ খানা নদীর হাতে দিয়ে বললো,
দয়াকরে দেখোতো দরখা¯ লিখা হয়েছে কি না?
অনেক খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে নদী বললো,
হ্যাঁ! তবে তুমি ভুলে ‘বিষয়’ শব্দটির বানান বিযয় লিখেছো।
লজ্জা পেয়ে সে মেয়েলিভাবে গাল লাল করে বল্লো,
সংশোধনের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
‘ধন্যবাদ তোমাকে ও‘। -প্রত্যুত্তরে নদী বললো।
। । তিন।
।
এস. এস. এস. পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। জাফনা প্রথম বিভাগে দুটো লেটারসহ পাশ করেছে। খুশিতে জাফনার পিতা আফজাল হোসেন চিšা করতে লাগলেন তাকে কলেজে ভর্তি করাতে হবে। এদিকে বড় ছেলেটি ও বাড়ী থেকে অনেক কষ্ট করে গিয়ে কলেজে পড়ে।
এদিকে তিনিও সারা জীবন শহরে থেকে এখন আর গ্রামে ভাল লাগছে না। তাই স্ব‘পরিবারে তিনি শহরে চলে গেলেন নারিকেল বাড়িয়ার ঘরটি পরে রইল অযতেœœ। সামনে টিউবয়েল । গোটা কয়েক নারকেল গাছ । বারান্দায় শান বাঁধানো হাতা চেয়ার ।
টিনের চাল তিন ইঞ্চি পাকা সাদা দেয়ালে ঘেরা ঘর, পাকা মেঝ। সবই আ¯ে আ¯ে অযতেœ নষ্ট হতে শুরু হল। টিনের চালে মরচে ধরলো। এদিকে আফজাল সাহেব স্বপরিবারে শহরে চলে যাওয়ায় নদীকে ও চলে যেতে হলো শহরে। কিন্তু হঠাৎ করে শহরে কোন স্কুলে ভর্তিও চান্স পাবে না ।
তাই ঠিক হলো পাঁচ মাস পরে নদী এসে রক্তিমাভা গ্রামের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে জানুয়ারীতে শহরে ভর্তি হবে। বইপত্র নিয়ে গিয়ে সে শহরে অধ্যয়ন শুরু করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে স্কুলে এসে ক্লাশ করতে পারলো না ।
নদী স্কুলে আসে না। সোহেলও আজকাল ¯িমিত হয়ে গেছে।
সৈকত স্কুলের জিতেন্দ্র বাবু স্যারের কাছে গ্রামার পড়ে। ইছা, বার্ষিক পরীক্ষায় যে কোন উপায়ে সে সকল বিষয়ে ফার্ষ্ট মার্কস পাবে। জিতেন্দ্র বাবু স্যার একটু একগুয়ে রকমের মানুষ। কাউকে টিউশনি পড়ান না। অনেক বলে কয়ে সৈকত ব্যর্থ হওয়ায় একদিন দাওয়াত করে এনে পিতাকে দিয়ে কাজ হাসিল করলো ।
এখন জিতেন্দ্র বাবু স্যার রোজ অধিকাংশ সময় তার পেছনে ব্যায় করেন। জিতেন্দ্র বাবু স্যারের চেষ্টায় সৈকত সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে প্রমোশন নিলো। মাসখানেক পর বার্ষিক পরীক্ষা। সে মনযোগ দিয়ে অষ্টমের বইগুলো পড়তে শুর করলো দিন রাত জিতেন্দ্র বাবু স্যার তার পাশে পাশে । দ্বৈত আপ্রাণ চেষ্টায় সে একমাসে এক বছরের পড়া কন্ঠস্থ করে ফেললো।
অপরদিকে নদী শহরে থেকে কিছুই জানলো না। সে সৈকতকে হারানোর জন্য মনদিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে গেল।
এদিকে সৈকত যে ক্লাসে প্রমোশন নিয়েছে তার ক্লাশ টিচার মাহমুদ আলী কথায় কথায় একদিন জিতেন্দ্র বাবু স্যারের সাথে প্রায় বাজী ধরেই বসে থাকেন,‘আপনার সৈকত কখনও আমার ক্লাশে ৫ নম্বরের ভিতরে ঢুকতে পারবে না । আমার দীর্ঘ এক বছরের কষ্টে গড়া ছেলে মেয়ে গুলি। আপনি দেখে নেবেন।
প্রত্যুত্তরে জিতেন্দ্র বাবু স্যারও মিটমিটে হেসে জবাব দিলেন, দেখা যাবে। বলাবাহুল্য অষ্টমের ৪/৫ টি ছাত্রছাত্রী অত্যš মেধাবী। তারা এবার স্কলারশীপ দিবে । সুতরাং মাহমুদ আলী স্যারের এ গর্ব অযুক্তিক নয়। তাদের পিছনে তিনি প্রচুর কষ্টও করেছেন।
অবশেষে পরীক্ষা এল। নদী শহর থেকে এসে ব্যাপার দেখে একেবারে থ‘। সে ভাঙ্গা মন শক্ত করে পরীক্ষা দিল। সবার পরীক্ষা ভালই হয়েছে। ইতিমধ্যে মাহমুদ আলী স্যারের ছাত্রদের স্কলারশীপ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে।
৩ জনেই বৃত্তি পেয়েছে। মাহমুদ আলী স্যার বেশ আনন্দিত।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। স্কুল প্রাঙ্গনে কৃষ্ণচুড়া গাছে ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো রক্তসম ঠকঠকে লাল।
পাখীরা ডাকছে। চাষীরা মাঠে ধান কাঠছে। অগ্রাহায়নের প্রকৃতিতে আজ সবদিকে যেন নবান্নের উৎসব। হঠাৎ করে থেকে থেকে যেন পাখির কুজন থেমে যােছ । চাষীরা ক্লাš হয়ে জমির আলে বসে পড়ছে ।
ধানের মৌ মৌ গন্ধে চারিদিক ছেয়ে যােছ । কিষান কিষানিদের চোখে ঘুম নেই । ধান মাড়ানোর কাজে আর ধান ভানার গানে সারা রক্তিমাভা গ্রাম আজ মুখরিত । এমন সময় যেন সকলেরই হৃদয়ে দোলা লাগছে এক অনাবিল আনন্দ অনুভূতি। যেন অপর্ব শিহরণ।
কিন্তু দু‘টি প্রানীর হৃদয়ে আজ যেন সাড়া শব্দহীন , নিথর , নি¯ব্ধ । আজ স্কুলে শেষ পরীক্ষা। বিকেলে পরীক্ষা । শুধু সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীর । চেনা মুখ ।
জিতেন্দ্র বাবু স্যার, মাহমুদ আলী স্যার, আর একরাম আহমদ স্যার । সকল উৎকন্ঠা পেরিয়ে পরীক্ষা শেষ হলো। সকল ছাত্রছাত্রী বিদায় নিেছ একে অপরের কাছ থেকে। স্কুল প্রাঙ্গন কোলাহল মুখরিত হলেও কি একটা বেদনা যেন থেকে থেকে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করছে। লম্বা ছুটি।
সবাই পরীক্ষা পরে বেড়াতে যাবে। কিন্তু নাজিম আজ ভাবছে নদী হয়তো আর কোন দিন এ স্কুলে আসবে না। আর দেখা যাবে না ওকে স্কুল করিডোরে। বেজে উঠে বিদায় ঘন্টা। জিতেন্দ্র বাবু স্যার নদীকে লক্ষ্য করে বলেন, কিরে নদী, সৈকতের চেয়ে ভাল হয়েছে তো?
মুখে শুষ্ক হাসি টেনে সে বলে উঠে- আপনি ওকে প্রমোশন দিয়েছেন স্যার।
আরও দু‘একটি কথা হয়। এদিকে সৈকত বাহিরে একমনে চিšা করে চলছে। আজ সে নদীকে কিছু কথা বলবে। হঠাৎ তার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ কওে নদীর সাথে মিক্স করে একটা লাল ড্রেস পরে আসে।
এসেই দেখে নদী কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে একাকী দাড়িয়ে। প্রফুল্ল চিত্তে সে সামনে গিয়ে দাড়ায়। ভাবে সে মনের কথা বলবে আজ নদীকে। কিন্তু সামনে যেতেই সব কথা ভুলে যায় সে। ভেবেছিল নদীকে আজ বাড়িতে নিয়ে আসবে।
সে কথাও ভুলে যায়। শুধু এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। হঠাৎ নদী সেদিকে তাকাতেই চার চোখের মিলন হয় । কিন্তু সৈকতের তীক্ষ¥ দৃষ্টির কাছে নদী হার মানে। লজ্জায় সে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
বলে উঠে কিছু বলবে?
না! মানে----, মানে----, মানে----! তুমি চলে যােছা । এ--কে--বা--রে--। আমতা আমতা করে বলে উছে সে। হঠাৎ যেন কোন গভীর চিšা ভেঙ্গেছে এভাবে।
তারপর দু‘জনেই নিরব।
উভয়ের স্থির চিত্তে বহু অব্যক্ত কথা। কিন্তু কারো কাছে বলা হলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর জড়তা ভেঙ্গে নদী বলে - আসি।
ও! সৈকত একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।
চিরতরে রক্তিমাভা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল নদী।
আর সৈকত এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো তার গমন পথের দিকে।
। । চার। ।
সময় প্রবাহমান। প্রকৃতির চিরায়ত নিয়মে কাল তার নিজস্ব গতিতে প্রবাহিত হতে লাগলো । কেউ তাকে কোন দিন থামাতে পারে নি। আজও সে থেমে নেই। সকল বাধা, বন্ধন, হাঁসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা,আবেগ, অনুভূতি উপেক্ষা করে সে বয়ে চলেছে অনšের সঙ্গে মহামিলনের আশায়।
চলা ছাড়া অন্য কিছু জানে না সে আর। নিরবে সর্বদা বয়ে চলে। পিছনে রেখে যায় স্মৃতি। মানুষ যাকে আকড়ে ধরে ঁেবচে থাকতে চায়। কাল তা মুছে দিতে চায়।
কিন্তু সৈকত যে স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও রক্তিমাভায় প্রায় প্রত্যেহ হাই স্কুলে আসে। ক্লাস করে। কিন্তু আজ আর তার সেই প্রথম দিনের অনুভূতি নেই। নেই সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। মনে হয় সে যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে।
শেষ পরীক্ষার দিনটা ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখে; ৯ই ডিসেম্বর। বছর পরিক্রমায় ক্যালেন্ডার বদল হলেও মুছে যায় নি তার মনের কোঠা থেকে তারিখ আর সেই মধুমাখা মুখখানা। যা চিরšন স্মৃতি হয়ে হৃদয়ে আছে। স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে আবার বই নিয়ে মুখ গুজে থাকে সৈকত। সারাক্ষণ লেখালেখিতে আর পড়ায় ডুবে থাকতে চায়।
হারিয়ে যেতে চায় লেখাপড়ার ভুবনে। ভুলতে চায় তার অতীত স্মৃতিকে। কিন্তু ভুলতে চাইলেও সহজে ভুলা যায় না। যতই সে চায় স্মৃতিকে দরে ফেলতে ততই স্মৃতি তাকে আঁকড়িয়ে ধরে রাখতে চায়।
ক্রমে নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা নিকটবর্তী হয়।
লেখাপড়ায় দ্বিগুন উৎসাহে সৈকত মন দেয়। দিন রাত্রি চলে প্রচেষ্টা। কিভাবে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া যায়। জিতেন্দ্র বাবু স্যারও আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। বহু বাঁধা বিঘœ পেরিযে এবারও সে সাফল্যের সঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করে দশম শ্রেণীতে উন্নীত হয়।
আবারও আসে বার্ষিক ¯োর্স,কিন্তু সেই যে ৯ই ডিসেম্বর নদী চলে গেছে আর সে ফিরে আসে নি, সৈকত খেলাধুলায় মোটেই ভাল নয় তাই সে ¯োর্সে মন দেয় নি। লেখাপড়া নিয়েই ব্যা¯ থাকে। কিন্তু স্মৃতি বড়ই যšণাদায়ক । তাইতো নদীকে স্মরণ করে সে নদীদের শহরের বাসায় গিয়েও লজ্জায় ফিরে আসে। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
ঈদ আসে। ঈদ চলে যায়। সৈকত খুব একটা আনন্দে যোগ দেয় না। কোন আনন্দই তার কাছে আর তেমন ভালো লাগে না। লেখাপড়ায় যতই ডুবে থাকে না কেন ক্ষণিকের অবসর পেলেই তার সম্মুখে ভেসে উঠে নদীর নি¯াপ কোমল মায়াবী মুখখানার এক অপর্ব ছবি।
ভূলতে ও পারে না সে, যেন হৃদয়ের মন্দিরে গেঁথে আছে যšণার এক কালো পাথর যা সরানো যায় না। সৈকত বিজ্ঞান আর অংক নিয়ে ব্য¯ থাকে। কোন রকম সময় কেটে যায়। ক্রমে প্রি-টেষ্ট পরীক্ষা এসে যায়। সে থানা সদরে, শহরে বিভিন্ন স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে বিখ্যাত সব শিক্ষকদের কাছে পড়তে শুর করে।
লেখাপড়ায় সে মরিয়া হয়ে উঠে । যে কোন ভাবে হোক সে ভাল রেজাল্ট করবেই। এই তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল বের হয়। তীব্র প্রতিযোগীতামলক মনোভাব নিয়ে সে পড়ছে।
সে নদীর চেয়ে ভাল রেজাল্ট করবেই। সেজন্য তার বিরাম নেই। সে চায় আরো উন্নতি; আরো ভাল মার্ক। চাওয়ার যেন শেষ নেই তার। যত পায় তত আরও চায়।
আসলে পৃথিবীতে যখন মানুষ আসে বিধাতা তাকে দিয়ে দেয় বেঁচে থাকার সম্বল হিসেবে কিছু নেয়ামত। মানুষ তাকে পুঁজি করে চায় তার এই নেয়ামত আরও বাড়াতে। কিন্তু তার এ চাওয়ার যেন কোন শেষ নেই। এই চাওয়া পাওয়ার খেলা খেলতে খেলতে একদিন সে বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে ।
।
। পাঁচ। ।
এদিকে নদীও শহরে গিয়ে বসে নেই । শহরের একটি বড় স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছে ।
সেও মনোযোগ দিয়েছে লেখাপড়ায় । অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই সে তার অমায়িক ব্যবহার, মিষ্টি ভাষা প্রতিভা প্রভৃতি দ্বারা সবার মন জয় করে নিয়েছে । টিলার পাশেই ছোট একটি নীড় । শহরের ভিতরে হলেও অনেকটা কোলাহল মুক্ত এলাকা। চারিদিকে দেয়াল ঘেরা ছোট টিনের চালের আর পাকা দেয়ালের সুøিগ্ধ কুটির।
প্রকৃতি উদার হলেও পল্লীর ন্যায় ততটা নয় । তবু নদী মানিয়ে নিতে চায়। শহরে ইটের পাঁজরে কীট মানুষগুলোর সাথে মিশে সে আতœবিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যেতে চায় কিন্তুু পারে না। অতীত স্মৃতি তাকে পীড়া দিতে শুরুু করে। কিন্তু পুর্ণ উদ্যোমে সে চালিয়ে যায় সাফল্যের প্রচেষ্টা ।
যেন জীবন সংগ্রামের অনš সমুদ্রে সে তার ছোট তরী খানায় শক্ত হ¯ে হাল ধরে থাকে । পরীক্ষা নিকটবর্তী হয়। জগতের চলমান তালে ঘড়ির কাটার সাথে সমাšরাল তালে এগিয়ে যেতে থাকে নদীর জীবন । সে এখন আর ছোট্টটি নেই । মাতা -পিতার স্নেহ, ভাইয়ের আদর, সারাবেলা বইয়ের সং¯র্শে দিন কাটে নদীর ।
নবম দশম পেরিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার দ্বার প্রাšে এসে পৌছে নদী । সে এখনও “ নীল বিহঙ্গ’ বিদ্যালয়ের ছাএী । সামনেই তার রয়েছে উজ্জল ভবিষ্যতের স¦প্ন । আছে রক্তউজ্জল গোলাপের ¯র্শের সুখকর অনুভুতির আকাখা, আছে হ্নদয় দুলিয়ে দেয়া অতৃপ্ত সুখের আশা । নদী এখন পঞ্চদশবর্ষীয়া বালিকা ।
সামনেই সে হয়ে উঠবে যৌবনের উম্মদনায় উম্মদীনি । ষোড়শীর সর্বাঙ্গে^র সকল রপের জৌলুস ছড়িয়ে পড়বে ভুবন ব্যাপী । কত ভ্রমর বাগানে হানা দিবে কোমল কুসুমের অš:স্থলের মধু, পাপড়ির ¯শর্ আর অপর্ব মাধুর্র্য উপভোগে। কিন্তুু কেউ কি একবারও তলিয়ে দেখবে তার হৃদয় । এদিকে সৈকতের প্রবেশিকা পরীক্ষা এসে যায় ।
পরিশ্রমের সর্বশেষ প্রচেষ্টা যেন মনে হয় সে চালিয়ে যােছ। খোদার নাম স্মরন করে সে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয় । একে একে সবকটি পরীক্ষাই তার ভাল হল । এখন বিশ্রামের পালা । সে দ‘ুহাত তুলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায় ।
“হে পরম দয়ালু । হে রাহমানুর রাহীম । তুমি তোমার এ গোনাহ্গার বান্দাটিকে রহম কর। তার সকল প্রচেষ্টার ফল, তার মনোবাসনা, ইছা আকাখা পর্ন কর । তুমি তো তার হৃদয়ের গভীরতম কণা পর্যš উপলদ্ধি করতে পার ।
দিন পেরিয়ে সপ্তাহ যায় । অলস বসে সৈকতের অসহ্য লাগে । সেও শহরে গিয়ে নেমে যায় কাজে । কখনও কলেজ ভর্তি কোচিংয়ে, কখনও গ্রন্থাগারে, কখনও টাইপ রাইটিংয়ে শিখতে, কখনও বা ক¤িউঁটার শিখতে। সে চিনে নদীদের বাসা ।
কিন্তুু যায় না । এর পেছনে একটি কারণ আছে ।
সৈকত এস. এস. সি. পরীক্ষার পর্বে একবার নদীদের বাসায় গিয়েছিল । সেদিন ছিল শেষ রমজান । পরদিনই ঈদ ।
এদিকে তখন পরিবহন ধর্মঘট সকালে শহরে গেলেও বাড়ি ফেরার জো-নেই । অনেক লোকই হেটে বাড়ি ফিরছে অথবা অন্য কোন বিশেষ উপায়ে । অগত্যা সৈকত বিপাকে পড়ল । তার অবশ্য শহরে অনেক আতœীয় ছিলেন । ইেছ করলে কারো বাসায় থাকতে পারতো ।
কিন্তুু হঠাৎ তাকে এক প্রবল উম্মাদনায় পেয়ে বসল । মনে করল একবার নদীদের বাসায় গেলে কেমন হয় । অনেক কষ্ট করে যোগাড় করা ঠিকানা নিয়ে সে গেল তাদের বাসায়। ইফতার ও করল তাদের বাসায় । ইফতার করল তার ভাইয়ের সাথে।
নামাজাšে সে প্রায় ঘন্টা দুয়েক গল্প করে বাধ্য হয়ে উঠতে হল । কারণ সে বুঝতে পারল তাকে এখানে কেউ ঠিক মেনে নিতে পারছে না । আর সে কখনও কারো করণার পাত্র হতে চায়না । কিন্তুু ধর্মঘটের জন্য সে তার আতœীয়ের বাসায় থেকে যেতে চায়নি । মন থেকে এক প্রবল জেদ তাকে চেপে বসে ।
না আর নয় আবার কোন শহরে বা প্রাšের দ্বারে নয় । এবার আমাকে ফিরতে হবে । ফিরতে হবে পল্লিমায়ের কোলে । সেই চেনা জগতে । সেই চির পরিচিত সকল মুখের কাছে যেখানে আকাশ উদার হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাবে ।
বাতাস কানে কানে গোপন সুর বিলাবে । দিগš সবুজ লাজনম্র বধুয়ার বেশে শ্যামল শাড়ী পরে মম মুখ পানে তাকিয়ে স্বর্গের হাসি হাসবে । বৃক্ষলতা আমার আগমন ধ্বনিতে মৃদু গুজ্ঞরিয়া উঠবে। পল্লী জননী উদার করে দেবে আমাকে তার সকল আদর সোহাগ। নদীদের মত শুধু কৃত্রিম অতিথেয়তার ভান করবে না।
ইত্যাকার নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে আনমনে সে হেটে চললো চির পরিচিত শহরের রা¯া ধরে বাড়ির পানে। কিš একি ! রা¯ায় গাড়ি নেই । সদীর্ঘ আঠার কিলোমিটার পথ সে যাবে কি করে। চিšা ক্লিষ্ট মনে অশ্বথতলায় বসে প্রহর গুনছিল। হঠাৎ একটা মাল বাহী ট্রাক সামনে থামল ,থামতেই শুনা গেল চেনা ক›ঠস্বর; ভেসে উঠল চেনা মুখ ।
আওয়াজ এল কিরে সৈকত! এত রাতে এখনে বসে কি করছিস । না ভাইয়া! ভাগ্যকেই ধিক্কার দিিছ । কাল ঈদ । আজ ধর্মঘটের জন্য রাত দ্বি-প্রহরেও আমি বৃক্ষতলায় । আর এত ভান করতে হবে না ।
উঠে আয় গাড়িতে । কি এত প্রয়োজন ছিল ধর্মঘটের মধ্যে শহরে আসতে । নিশ্চয়ই ছ্রেফ দুষ্টুমির জন্য এই অব¯থা। কি যে বল। এসেছি তো ধর্মঘটের পর্বে।
অবশেষে সে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরে আর আশ্চর্য্য হয়। তার দেরি দেখে ঘরে মা, বাবা, বোন সবাই অত্যš উদ্বিগ। এই রাত দ্বি-প্রহর পর্যš সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ বা বলছে রাত করে এলি কেন, থেকে গেলেই তো পারতি । মায়ের চোখের অশ্র তাকে আরও ভারাক্রাš করে তোলে।
এক অজানা ক্ষোভ নিয়ে সে অতি দু:খে শয্যা গ্রহন করে।
। । ছয়। ।
আজ ৯ই আগষ্ট। সৈকতের ভাগ্যাকাশের যেন কোন বিশেষ ঘটনা আজ ঘোষিত হতে যােছ। সারা প্রকৃতি যেন আজ অত্যš সজাগ। কান পেতে যেন কোন কিছু শোনার অধীর আগ্রহে নিমজ্জিত। থেকে থেকে থেমে যােছ পাখিদের কুজন ।
বর্ষার অবিশ্রাš বারিধারা আজ যেন অনেকটা ক্লাš হয়ে এসেছে । মনে হেছ প্রকৃতি তার আপন তালে নেচে যেতে ভুলে গেছে । প্রতিদিনকার মত আজ আর ফুল ফোটানোর বাজি চলছেনা । দোয়েলটা যেন নাচতে ভুলে গেছে । কদম গাছ থেকে যেন আজ বৃষ্টিভেজা সুরভি বের হেছ ।
সম¯ প্রকৃতি যেন তার পরবর্তী মুহুর্তগুলোর জন্য নিখিলের নিয়šার এক বিশেষ নির্দেশের অপেক্ষায় রত । আজ বিশ্ব প্রকৃতি কূলে ঘোষিত হবে প্রকৃতির প্রিয় দুলনায় দোলা সবুজ ফসলে ঘেরা, সোনালি স্বপ্ন মাখা বাংলার দামাল ছেলে সৈকতের বহুকালের সাধনার ফল । প্রকৃতি সহ সবকিছু যেন আজ সৈকতের সাথে উদ্বিগ্ন । কিছুক্ষন পরে তকে কি শুনতে হবে । শুভ সংবাদ নাকি অপ্রত্যাশিত বেদনা জড়িত কোন দুঃসংবাদ।
ছোট্ট বেলায় সৈকত দোলনায় দোলত । দোলনা কখনো বৃক্ষের এপাশে কখনো ওপাশে চলে যেত । আজ তার মন ও যেন দু্িশ্চšার দুলনায় দুলছে । কি শুনবে সে পরবর্তী মহুর্তে । আ¯ে আ¯ে অপেক্ষার সময় ফুরিেেয় এল ।
ঘনিয়ে এল অšিম মুহুর্ত । গোসল সেরে সৈকত তার সহপাঠিদের সাথে স্কুলে গেল । খবর শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। পায়ের নিচের মাটি সরে গেল । চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখল ।
সে প্রথম বিভাগে ষ্টারমার্কসহ পাঁচটি লেটার পেয়েছে । নিয়তি মেনে নিয়ে কোন রকমে বাড়ি ফিরে দ্বারবন্ধ করল । দুনয়নে নেমে এল অশ্রবন্যা । কারোও মুখ আর তার সহ্য হেছনা । সে তো অনেক ভালো রেজাল্ট আশা করে ছিল ।
কিন্তুু একি হলো? কোন দোষে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল? কি দোষ করেছিল সৈকত ? কান্নায় বুক ভেসে যেতে চাইল সৈকতের? ভূলে যেতে চাইল তার অতীত, বর্তমান। কারো মুখ আর দেখার প্রয়োজন নেই । বেঁচে থাকার শেষ সামর্থ্য যেন আজ ফুরিয়ে গেছে । নিষ্ঠুর পৃথিবীর সকল লোক আজ তার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করছে । যার সাথে তার দেখা হবে সেই
যেন তাকে ঠাট্রা করবে এরকম একটা ভাব তার মনে উদয় হয়েছে।
সৈকত কাপুরষ নয়। বা¯বতাকে অস্বীকার করে মর্ত্যধাম ত্যাগ করার মত দুরভিস›িধ তার মাথায় কখনও আসে নি । রূঢ় বা¯বতা মেনে নিয়ে যে বেঁচে রবে, যুদ্ধ করবে সেই সব কটাক্ষ ফিরিয়ে দিতে পুনরায় তাদের মুখের উপরে, যারা আজ তাকে নিয়ে কটাক্ষ করে চলছে । আজ তার কোথাও স্থান নেই একমাত্র মা-বাবার ¯েœহের কোল ছেড়ে। তার আতœীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষক-শিক্ষিকা তথা সমাজের সকলেই তার কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল ফলাফল আশা করছিলেন ।
কিন্তুু বিধাতা তার পানে মুখ তুলে তাকাননি। তার কাছে আজ তার সু-দীর্ঘ আড়াই বছরের পরিশ্রম অসাড় মনে হেছ । মনে হচেছ পৃথিবীতে সে এসেছে একের পর এক দু:খ পেয়ে যাবার জন্য । দুঃখই তার চিরসাথী । তবু সে তার নিয়তি মেনে নিয়ে লড়তে চায় আগামি দিনের সাথে ।
ছিনিয়ে নিতে চায় সাফল্যের রক্তিম সর্য । যে করেই হোক এ ধরনের ঘটনার পণরাবৃত্তি যেন তার জীবনে আর না ঘটে । সে যেন ফিরে যেতে পারে এক সুস্থ, সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশে । যেখানে তাকে দেখে আর কেউ জিজ্ঞাসিবেনা ‘কিরে সৈকত তোরতো আর ভাল ফলাফলের কথা ছিল ?‘ এসব ভাবছে আর সে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে । কেঁদে কেঁদে যেন নিজেকে শেষ করে ফেলবে ।
যতই মনকে বোঝাবার চেষ্টা করে কেঁদে লাভ নেই, যা হবার হয়ে গেছে, ততই মনে কোন অজানা গভীর বেদনায় ডুকরে কেঁদে উঠে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে ইছা করে । ইেছ করে নতুন কোন পরিবেশে নিজেকে আবিস্কার করতে । ইেছ করে দ্বি-গুন উৎসাহে যুদ্ধ করে আবার প্রমান করতে যে সে সফল হতেও জানে । নদীর বাসায় যেতে ইেছ করেনা ।
ভুলে যেতে চায় সে নদীকে । তার এখন প্রয়োজন জীবনে প্রতিষ্ঠা । তারপর অন্য চিšা । নদী তার জীবনে যতটাই সত্য হোক না কেন সেতো ওকে কোন দিন কোন কথা দেয়নি । আজ আর মনে পড়ে না নদীর কথা ।
সে শুধু চায় তার প্রতিষ্ঠা ।
। । সাত। ।
সৈকত তার এ ফলাফল পুরোপুরি মেনে নিলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে গ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য করল । বড় মায়াময় গ্রাম রক্তিামাভা। এ গ্রামেই সৈকতের জন্ম । আর জন্মস্থানের জন্য কার না মায়া রয়েছে । সে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই গ্রাম্য সর মেঠো পথ ধরে নারকেল বড়িয়া গ্রামে এক শিক্ষকের কাছে পড়তে যেত ।
কি মনোরম স্মৃতিপর্ণ দিনগুলো । বিকেলটা কাটত হয়ত বা রক্তিমাভার উত্তরের খোলা মাঠে নতুবা পর্বের ছোট ছোট টিলাময় গ্রামে । আজ তার সে সব স্মৃতি পেছনে ফেলে পাড়ি জমাতে হেছ এক অজানা গšতব্যের দিকে । ঠিক অজানা না হলেও অনেকটা তাই । ফলাফলের পরের দিনই সে ঘুম থেকে উঠে শহরে চলে গেল ।
পেছনে ফেলে গেল বিগত সতের বছরের জীবনের নানা হর্ষ বিষাদের স্মৃতি । গাড়ীর খোলা জানালা দিয়ে তাকাতে তাকাতে মনের পাতায় ভেসে উঠতে লাগলো। হাজারো সুখ দু:খের হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যাবলী । চোখ দুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল । শহরে নেমে সোজা বাসায় চলে যায় ।
ওটা ছিল তার এক চাচাত বোনের বাসা । আপাতত এখানেই সে কয়েকদিন থেকে টাইপিং ্আর ক¤িউটার এবং কলেজ ভর্তির জন্য সর্বাšকরনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে । তারপর যদি বিধাতা তার পানে মুখ তুলে তাকান তবে সে ঢাকা বা সিলেটে কোন ভাল কলেজে ভর্তি হবে । ক্রমে দিন ঘনিয়ে এল । তার টাইপ ও ক¤িউটার শিখার কোর্সও শেষ হলো ।
সে কলেজ ভর্তি কোচিংয়ে আরও বেশী মনযোগ দেয়। এক দিনের জন্য রক্তিমাভায় ফিরে মার্কশীট নিয়ে আসে। সে এক করণ কাহিনী । তার মুখে সেদিন ছিল কাল বৈশাখীর ছায়া। অসম্ভব রকম বেদনায় মুষড়ে পরে সে ।
কোন সহপাঠির মুখপানে চোখ তোলে তাকাতে সাহস পায়নি । কেন যেন অসম্ভব রকমের সংকোচ এসে জড়ো হয় সৈকতের চোখে মুখে। কোন রকমে গিয়ে উপস্থিত হয়ে মঞ্চে বক্তব্য শেষ করে মার্কশীট নিয়ে আসার উদ্দ্যেশ্যে । কিন্তুু মঞ্চে দাড়িয়েই অশ্রসিক্ত নয়নে ভেঙ্গে পড়ে এক অসম্ভব রকমের কান্নায়। বুক ফেটে যেন চৌচির হয়ে যােছ তার।
কান্নামাখা নদীর ছলছলে বয়ে যাওয়া স্রোতের পানির সুরের সাথে তার আঁখি থেকেও র্ঝর্ঝ করে ঝরে পড়ে ক‘ফোটা অশ্র। কিছুই তার মুখ
থেকে বের হয়না। কোন রকমে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় দুটো কথা বলেই বিদায় নেয় মঞ্চ হতে । বেঞ্চে বসতেই যেন মনে হয় শত কাঁটা বিধছে । কোন রকমে মার্কশীটটা নিয়েই বাড়ী ফিরে ।
খাওয়া দাওয়া সেরে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।