আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেয়াল-বন্দনা



জীবনে প্রথম যে প্রাণিটির কাছে হেরেছিলাম, সেটি শেয়াল। মেজ আপা রসিয়ে রসিয়ে শেয়ালের গল্প বলতেন। টসটসে পাকা আঙ্গুল খেতে না পেরে শেয়াল যে কেন এটাকে 'টক' বলেছিল, ওটা মাথার এন্টেনায় ধরার মতো বয়স তখনও হয়নি। টক আঙ্গুর দেখতে কেমন, জিজ্ঞেস করতেই আপু সমস্যার মূল কোথায় তা বুঝে ফেললেন। মুরগি চোর এ প্রাণিটির কাছে আর হারতে হয়নি।

তবে এখনও শিশুরা যে প্রাণিটির পাণ্ডিত্যের (যে সব কিছু পণ্ড করে, সেই পণ্ডিত!!) ছবক প্রথম পায়, সেটি শেয়াল। গ্যাদাকালে তারা চাঁদকে মামা ডাকে। আর একটু ডাঙর হলে আত্মীয়তার ওই পিঁড়ি শেয়ালই দখল করে। আর শিশুরাও শেয়ালকে মামা ডেকে তৃপ্তি পায়। সেই প্রাচীন কাল থেকে মানুষ নানাভাবে শেয়ালকে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে।

ঈশপের গল্পে শেয়াল ধূর্ত, পঞ্চতন্ত্রে হিংস্র ও কুবুদ্ধিদাতা, লোককাহিনীতে ধূর্ত, বুদ্ধিদাতা ও লোভী। বুঝতেই পারছেন, 'সব শেয়ালের এক রা' হলেও বিশ্বের কোনো প্রান্তের মানুষ শেয়ালকে অভিন্ন ভাবে অনুভব করেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শিবাশোধন কমিটি' গল্পে শোধনের পর শেয়ালের নাম রাখেন খাসালেজুরি ও সুকোমল লাঙ্গুলী। অথচ জীবনানন্দ দাশ 'সেই সব শেয়ালেরা' কবিতায় শেয়ালকে হতমান ও পঙ্গু মানুষের প্রতীক বানিয়েছেন: 'যেইসব শেয়ালেরা --জন্ম জন্ম শিকারের তরে দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভেতরে নীরবে প্রবেশ করে, বার হয় চেয়ে দেখে বরফের রাশি জ্যোৎস্নায় পড়ে আছে উঠতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি সেই সব হৃদয়যন্ত্র মানুষের মতো আত্মায় তাহলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময় জন্ম নিতো সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে আমারো নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে। ' সংস্কৃত শৃগাল শব্দ থেকে বাংলায় শিয়াল শব্দটি এসেছে।

শেয়াল তার কথ্য বা চলিত রূপ। আর সংস্কৃত 'শৃজ' ধাতু থেকে আসা শৃগাল শব্দটি মহাভারত ও মনুসংহিতায় রয়েছে। শৃজ ধাতুর দুটি অর্থ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে 'যে কোনো রকমের রক্তের গন্ধ পেলেই যার জিভে জল আসে এবং নিজেই নিজের জিহবা লেহন করে। ' দ্বিতীয় অর্থ হলো : 'যে প্রাণি শঠতা ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে নিজের স্বভাব প্রকাশ করে দেয়।

'শেয়লের 'শিবা' নামটি রয়েছে ঋগ্বেদে। এটা নিত্য স্ত্রীলিঙ্গ হলেও বাংলায় তা পুংলিঙ্গ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। শিবা মানে 'যে শুয়ে ডাকে'। আবার রাতের বেলা এটা অনেকটা প্রহরীর মতো যাম বা প্রহর ঘোষণা করে বলে এটা 'যামঘোষ' নামেও পরিচিত। মাংশাসী শেয়াল আবার জাম প্রেমিক।

জাম পাকলে এটাকে জাম গাছের তলায় ঘুর ঘুর করতে দেখা যায় বলে এটাকে জম্বুকও বলা হয়। আবার কোনো কারণে এটা ক্রুদ্ধ বা ব্যর্থ হলে 'ফে ফে' শব্দ করে বলে এটাকে 'ফেরব' বলা হয়। এটার ডাক বহুদূর থেকে শোনা যায় বলে এটা 'ক্রোষ্টা', কান দুটি শিংয়ের মতো খাড়া বলে 'শম্বুকর্ণ' আর প্রায়ই হাড়-মাংস মুখে নিয়ে এটাকে দৌড়াতে দেখা যায় বলে এটা 'ক্রব্যমুখ'। এটা ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। শিকার আর বিপদ দেখলে এরা একসঙ্গে ডেকে ওঠে।

অপরিসীম ধৈয্যের কারণে এটা সাধারণত শিকার মিস করে না। খেঁক শেয়ালও এদেশে আছে। এরা আকারে শেয়ালের চেয়ে ছোট। আবার স্বাধীনচেতা। কিন্তু শেয়াল সামাজিক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।