ব্ল্যাঙ্ক
আমি তখন পানশালায় বসে মদ্যপানে বিভোর ছিলাম। আর ক্লান্ত শহরের মধ্য যৌবনবতী রাত আমার শরীরের ক্ষয়িষ্ণু হাড়গুলো খুবলে খুবলে খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ আগেই অনাগত চতুর্থ সন্তানের গর্ভপাত ঘটিয়ে এসে শ্রান্ত শরীর ও মনের সাময়িক ধকল কাটাবার উদ্দেশ্যে আমি সারারাত পানশালায় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পরিকল্পনায় বাধ সাধলো হতচ্ছাড়া বুড়ো ওয়েটার,"বার বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে। This must be your last peg,ma'm!" বিরক্ত দৃষ্টিতে আমি ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে কিছু অশ্রাব্য গালাগাল নিক্ষেপ করলাম।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখতে পেলাম আমার গলা থেকে কেবল বুনো শুয়োরের মত ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। অতঃপর বাধ্য হয়ে টলমল পায়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। কাউন্টারে বিল মিটিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম বড় রাস্তায়। সারামাস সুপার শপে কাজ করে পাওয়া বেতনের অর্ধেকটাই এখন চলে যাচ্ছে সাপ্তাহিক মদ্যপানে। বাকি অর্ধেক দিয়ে ঘরে সান্ধ্য বাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকা আমার জীবিত তিন ছেলেমেয়ের পেটের ক্ষুধা মিটবে কিনা তা নিয়ে ভাবার মত মানসিক বা স্নায়বিক অবস্থা আপাতত নেই।
এরকম একেকটা রাতে আমার যাবতীয় মানবিক যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে আকাশের তারাগুলি খুলে নিয়ে একটা একটা করে মুখের ভেতর পুরে দিতে ইচ্ছে হয়। অথবা ইচ্ছে করে রাস্তার মোড়ে অতিকায় দৈত্যের মতন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দূরবর্তী ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলিকে গিলে খেতে। সমস্ত শহরের যাবতীয় গুপ্ত অন্ধকারকে ধর্ষণ করে তারা নির্লজ্জের মত চারিদিকের সব অশ্লীল দৃশ্যাবলিকে নগ্ন করে দেয়। তাদের তীব্র ভর্ত্সনায় আমি অন্ধকারেও নিজের শরীর লুকোবার একতিল জায়গা খুঁজে না পেয়ে নিষ্ফল আক্রোশে তাদের অভিসম্পাত করতে থাকি। এরকম রাতে এমনকি ঘরে ফিরতেও ইচ্ছে করে না আমার আর।
মুখ খোলা তিনটে বিরাট হা নিয়ে বসে থাকা তিনজন ক্ষুধার্ত মানবসন্তান ছাড়া আর কিই বা দেখার আছে সেখানে? কেউ কি ভালবাসার আশ্রয় নিয়ে অপেক্ষা করে সেখানে আমার? করে না। সেই ঘরের সাথে আমার সম্পর্ক কেবল প্রয়োজন ও প্রয়োজন পূরণের। আশ্রয় ও আশ্রিতের। তবুও ঘরে ফিরতে হয়। আরো একটা সংগ্রামমুখর দিনশেষে জীর্ণ আর ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়ার তাগিদে একটা নোংরা,ভাঙ্গাচোরা লোকাল বাসের কালো ধোঁয়ার পিঠে চেপে গভীর রাত্রে অবশেষে ঘরে ফিরি।
এবং ফিরেই দরজার ওপাশে সেই ঘৃণিত মুখের সাথে চোখাচোখি হতেই বিতৃষ্ণায় অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে নেই। তাতে রেহাই পাওয়া যায় না। কানের ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা তেলতেলে অস্বস্তিকর কন্ঠস্বর, "কেমন কাটালে আজ দিনটা ডার্লিং? নতুন নাগরের খোঁজ মিলেছে নাকি কোনো?" তার চোখেমুখে ধূর্ত হাসি খেলে যায়। আমার ইচ্ছে করে মুহূর্তেই সেই মুখের উপর একদলা থু থু ছিটিয়ে দেই অথবা পেটের ভেতর সর্পিলাকারে পাক দিয়ে ওঠা সবটুকু বমি উগড়ে দেই ওতে। তার বদলে কেবল নিস্পৃহ দৃষ্টিতে শীতল কন্ঠে জবাব দেই,"দূরে থাক তুমি জারজ সন্তান।
তোমার গায়ের গন্ধও অসহ্য আমার পক্ষে। " খ্যাক খ্যাক করে পিশাচের হাসি হেসে ওঠে সে। ধূর্ত চাহনিটা আমার চোখের ওপর ফেলে বলে,
- তাতেই তোমার খুব সুবিধে হয় বুঝি? আমার অনাকাঙ্খিত উপস্থিতিতে তোমার দেহ ব্যবসায় ভাটা পড়ছে বুঝি আজকাল!
- চুপ কর অসভ্য বদমায়েশ! একটা নোংরা পুরুষমানুষ তুই। আজ এই চুলোয় মুখ দেখাতে এলি কি করে? পঞ্চম বান্ধবীও তোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে বুঝি? করবেই তো - একটা নর্দমার কীটের চাইতেও অধম তুই।
- অধম হই আর যাই হই, তোর বাপের পয়সায় মৌজমাস্তি করি না।
করলে নিজের পয়সায় করি। শোন নটী, এই বাড়িটা আমার। আমি এটা বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভালো খদ্দের পাবার অপেক্ষায় আছি কেবল। তুই আর তোর জারজ সন্তানরা যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা কর।
ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে হয়না যেন।
- কি বললি তুই? বাড়ি বিক্রি করবি? এই বাড়ি কি তোর বাপের পয়সায় কেনা? বাড়ি কেনার অর্ধেক পয়সা আমি দিয়েছিলাম - ভুলে গেছিস তুই? তুই কে একা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবার?
- অতশত বুঝি না আমি। বাড়ি বিক্রি হবেই। তুই নিজে থেকে না গেলে কুকুরের মত পিটিয়ে তাড়াবো তোকে।
- নর্দমার শুয়োর! তোর জুয়া আর নেশার টাকা মেটাতে তুই এখন আমায় আর আমার বাচ্চাদের ঘরছাড়া করতে চাস? আমি দেখে নেব কি করে তুই এই বাড়ি থেকে আমাদের তাড়াস।
বেজন্মা কুকুর কোথাকার...........
আমার তারস্বর চিত্কার আর গালাগালকে ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শীষ বাজাতে বাজাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে - আমার জুয়াড়ি ও নেশাখোর নামসর্বস্ব স্বামী। আমি ক্লান্ত হয়ে ধুপ করে ভাঙ্গাচোরা খাটের ওপর বসে পড়ি। শরীরটা কিছুতেই চলছে না আর। আমার তিনটি সন্তান অভুক্ত আছে কিনা সেটুকু জিজ্ঞেস করার মত ধৈর্য্যও থাকে না আমার। আমি বিনাবাক্যে খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।
ঘুমের ঘোরেও অজস্র খন্ড খন্ড স্মৃতিকাতর দৃশ্যাবলী আমার চোখের পাতাকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে বসে। একটা সময় ঘর সংসার ছিল আমাদেরও - হঠাৎ মনে পড়ে। এমনকি হাস্যকরভাবে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও সেখানে ভালবাসাও ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে মনে পড়ে যায়। সে আমার হাতে হাত রেখে চোখের ইশারায় কথা বলত প্রায়শঃই আর বলত, ভালবাসায় ভাষার প্রয়োজন সীমাবদ্ধ,অলক। অনুভূতিটা তো কেবল চোখ থেকেই পড়ে নেয়া যায়, যদি বোঝার মত মন থাকে কারো।
আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে মৃদু হাসতাম। কিন্তু চোখের ভাষাগুলো ধীরে ধীরে কিভাবে বদলে গেল একটু একটু করে টের পাওয়া গেল না। শুধু টের পেলাম আধো অন্ধকার গলির ভেতর একদা স্বপ্নভ্রান্ত চোখে আমাদের দুজনের একত্রে সাজিয়ে তোলা ছিমছাম ঘরে ফিরতে অনীহা বাড়ছে তার। চোখটা একসময় ছিল ভালবাসায় ভরপুর.......সেখানে এখন কেবল হিংস্র মাদকতা আর কামজ নেশার ছায়া।
আমি ভালবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম।
এই বিপরীত আচরণ তাই অসহ্য ঠেকলো আমার। ঘৃণায় কুকঁড়ে গিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিলাম এমনকি তার ছায়ারও আশপাশ থেকে। প্রয়োজন মেটাতে একটা সময় বেশ্যাবাড়ির নিয়মিত খদ্দের হয়ে উঠলো সে, জানতে পেরেও কিছু করার ছিল না আমার আর। তারপরও আমাদের নিয়মিত দেখা হত প্রাত্যহিক পাশবিকতা আর অশ্রাব্য গালাগালের আসরে। তিনটি সন্তানের যন্ত্রণাকাতর নির্বাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা একে অপরের নরকযাত্রা কামনা করে অশ্লীল ও তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে বিদ্ধ করে তুলতাম পরস্পরকে।
সেখানে নতুন কোনো ভাগ্যহতের আগমন ঘটাবার পরিকল্পনা ছিল না আমার। কিন্তু পরিকল্পনা সবসময় স্থায়ী হয় না। অদৃষ্ট মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর পরিহাস করে পাশবিক তৃষ্ণা মেটায়। তাই ছয়মাস পর একরাত্রে আমার শীতল হয়ে পড়া শূন্য বিছানায় জান্তব হুঙ্কার জানিয়ে আগমন ঘটল তার। হিংস্র শ্বাপদের মত আমার ওপর দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
তীব্র ঘৃণা আর বিবমিষায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা কোনো কাজে দিল না আমার। তার পাশবিক হাতের নির্মম ক্রুদ্ধ পেষণের নিচে চাপা পড়ে আমি সংজ্ঞাহীনতায় তলিয়ে গেলাম।
অবশেষে তার দুই মাস পর আজ গর্ভপাত ঘটিয়ে সব পাপক্লান্ত অন্কুরোদ্গমন্মুখ বীজের বিনাশ ঘটালাম।
এবং বলতে দ্বিধা নেই স্বাভাবিক মাতৃসুলভ ক্রন্দনে চোখ ভিজে উঠলো না আমার। কেননা ঘৃণার চাষ এতদিনে মুখ্য হয়ে উঠেছে আমাদের মাঝে........এছাড়া বাকি সবকিছুই গৌণ।
তা হোক নিজ সন্তান বা অন্য যেকোনো মূল্যবান সম্পদ।
অথচ ভাবতে অবাক লাগে মায়ের আদরের সন্তান ছিলাম একটা সময় আমিও। শৈশবের আনন্দমুখর দৃশ্যগুলি ভীড় করে একে একে আমার চোখের সামনে। যখন মা আমায় কোলে বসিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে হাত নেড়ে অদ্ভুতুড়ে সব মুখভঙ্গি করে ঘুমন্ত রাজকন্যার রাক্ষসপুরী ভ্রমণের কাহিনী শোনাতেন, আমি ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম। আবার রাজকুমারের সাথে প্রাণান্তকর যুদ্ধে রাক্ষসের পরাজয়ের সাথে সাথেই প্রবল উচ্ছ্বাসে কলকলিয়ে হেসে উঠতাম।
তার ফাঁকেই মা টুপ করে মুখে খাবার তুলে দিতেন - আমার খেয়াল থাকত না আমি এতক্ষণ যাবৎ না খাওয়ার বায়না ধরে এসেছি।
আমার সন্তানদের শৈশবটাও তো এমনই হবার কথা ছিল। অথচ তার বদলে তারা পেয়েছে হিংস্র কদর্যতা আর তিক্ততায় ভরা ক্লেদাক্ত শৈশব। আগাগোড়া বিষন্নতার ধূসর রাংতায় মোড়া তাদের শৈশবের চিত্রপট। সেখানে মায়ের ভালবাসা অনুপস্থিত ; নেই বাবার অখন্ড প্রশ্রয় অথবা আনন্দমিশ্রিত রংধনুকালের প্রতিচ্ছবি।
স্নেহবিজড়িত ঘুমপাড়ানি গানের পরিবর্তে মায়ের অপরিসীম অবহেলা আর উদাসীনতায় তাদের বেড়ে ওঠা। অথচ আমার স্নেহময়ী মা চারপাশের যাবতীয় প্রতিকূলতা আর অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমায় বড় করে তুলেছিলেন পরম যত্ন ও ভালবাসায়। শৈশবেই বাবার মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে আমার লালন পালনের খরচ যোগাতে মাকে কাজ নিতে হয়েছিল ইটের ভাটায়। নিজে বিষাক্ত কার্বনের কালোধোঁয়া ফুসফুসে শুষে নিয়ে নিয়ে আমার জন্য তিনি রচনা করেছিলেন রূপকথার মত সুন্দর শৈশব। সেই আমার ভেতরে এতখানি ক্লেদাক্ততা কখন কি করে ঢুকে গেল আমি জানতেই পারলাম না! দীর্ঘদিন ইটের ভাটায় কাজ করার ফলে মায়ের ফুসফুস আক্রান্ত হয়েছিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে এবং তার পার্শপ্রতিক্রিয়ায় আরো অনেক যন্ত্রণাকর রোগের উত্থান ঘটেছিল অল্পবয়সেই।
চিকিত্সা দিয়েও তাকে খুব বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। মৃত্যুর আগে মা তার শেষ চিঠিতে আমায় লিখে গিয়েছিলেন, "অলকা মামণি,আমি জানি তোমার মায়ের মতই একদিন তুমিও মা হবে। তোমার এই চিরদুঃখিনী মা তোমায় আশীর্বাদ করে যাচ্ছে,আর্থিক অনটনের দরুণ তোমার মা তোমায় শৈশবের যেই আনন্দগুলো থেকে বঞ্চিত রেখেছেন,তুমি যেন তোমার সন্তানদের তার সবটুকু দিতে পার। তোমার পরম মমতার আশ্রয়ে ওদের প্রার্থিত শৈশব ভরে উঠুক অনাবিল হাসি আনন্দে। জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি যেন ভালবাসার অফুরান পেয়ালা হাতে নিয়ে তুমি তাদের পাশে থাকতে পার চিরনির্ভরতায়- এই আশীর্বাদ করি।
"
চিঠিটার কথা মনে পড়তেই আমি ঘুমের ঘোরেও ডুকরে কেঁদে উঠি। হঠাৎ প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে আমার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সে। নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে ঘরের চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। তারপর কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে, ভালো খদ্দের পেয়ে গেছি আমি বাড়িটার জন্যে।
কাল পরশুর মধ্যেই তারা বিক্রির সবকিছু চূড়ান্ত করে নিতে চায়। বাড়ির দলিলটা কোথায়? আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি, এই বাড়ি তোমার একার সম্পত্তি না! তোমাকে কিছুতেই এটা বিক্রি করতে দেব না আমি। সে আমার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তীরবেগে ঢুকে যায় শোবার ঘরে। অতঃপর ঘরের সর্বত্র লন্ডভন্ড করে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে বাড়ির দলিল। প্রায় আধাঘন্টা যাবত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও কাঙ্খিত দলিলাদি খুঁজে না পেয়ে সে হিংস্র পশুর মত গোঙাতে গোঙাতে আমার চুলের মুঠি টেনে ধরে বলে,
- কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস মাগী? জলদি বল বলছি।
- তোর মত শুয়োরের হাতে ওই দলিল দেব না আমি। কি করতে পারিস তুই কর।
- শেষবারের মত সাবধান করছি তোকে। ভালোয় ভালোয় দলিল আমার হাতে দিয়ে তোর জারজ সন্তানদের নিয়ে এখান থেকে বিদেয় হ। নইলে প্রাণে মারা পড়বি ঈশ্বরের শপথ।
- আমি বেঁচে থাকতে না।
- মরেই যা তবে।
কথাটা বলার সাথে সাথেই এক নৃশংস ক্রূর হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। সেই হাসি দেখে আমার শরীরের রক্ত জল হয়ে আসে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার তিন সন্তানকে পাশের ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে এনে আমার সামনে ফেলে সে।
তারপর তড়িতগতিতে শোবার ঘরের দরজাটা বাহির থেকে আটকে দিয়ে আমাদের দৃশ্যতঃ কক্ষবন্দী করে ফেলে। অতঃপর দরজার ওপাশ থেকে চিত্কার করে বলতে থাকে, কেমন করে বাঁচিস এবার দেখি। গ্যাসের পাইপলাইনটা খুলে দিলেই সারা ঘরে গ্যাস ছড়াতে শুরু করবে। তারপর শুধু একটা দেয়াশলাই জ্বালাবার দেরী। তোর হাতে মিনিট দশেক সময় আছে।
যদি পারিস তো নিজেকে আর নিজের জারজ বাচ্চাগুলিকে নরকযাত্রা থেকে উদ্ধার কর।
কথাটা শেষ হওয়ামাত্রই দরজার ওপাশ থেকে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যাবার পদশব্দ শোনা যায় তার। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই আমি রান্নাঘর থেকে ভুশ ভুশ করে গ্যাস বের হবার শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাই। আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি বিকল হয়ে আসে।
হঠাৎ আমার তের, নয় ও ছয় বছর বয়সী তিন ছেলেমেয়ে আতঙ্কিত মুখে ছুটে এসে তাদের কচি কচি হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আচমকা উপলব্ধি করি, এতদিনের এত অনাদর আর অবহেলা সত্ত্বেও চরম বিপদের মুহূর্তে আজও তারা কেবল আমার কোলেই নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে- শুধুমাত্র একটি কারণে,কেননা আমি তাদের মা। মায়ের চিঠির শেষ লাইনগুলি মনে করে আমার দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। মা বলেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি যেন পরম ভালবাসায় আমি আমার সন্তানদের ঘিরে রাখি। আজ এতদিন পর আমি দুহাত বাড়িয়ে গভীর মমতায় আমার সন্তানদের জড়িয়ে ধরি। আমার দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে।
মুহূর্তের মধ্যেই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে করেই হোক,আমাকে আমার সন্তানদের এই জতুগৃহ থেকে উদ্ধার করতে হবে।
আমি মা। আমি কখনই আমার সন্তানদের এভাবে চোখের সামনে জ্বলে পুড়ে মরতে দিতে পারি না। আমি নিজে এই ব্যূহ ভেদ করতে পারি বা না পারি, আমার সন্তানদের আমি অবশ্যই এখান থেকে মুক্ত করব। ভাবতে ভাবতে আমি ঘরের চারপাশে চোখ বুলাতে থাকি।
হঠাৎ ঘরের কোণে পরিত্যক্ত আসবাবের পেছনে একটা পুরনো আয়রন কাটার আমার চোখে পড়ে। দীপাবলীর সময় কিনেছিলাম যেটা ভাঙ্গা জানালা মেরামতের উদ্দেশ্যে। আমি তড়িত গতিতে ছুটে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নেই। অতঃপর মেশিন চালু করে শোবার ঘরের জানালার কাছে ছুটে যাই মুহূর্তেই। আমি জানি আমার হাতে সময় খুব কম।
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই সারা ঘর গ্যাসে ভরে উঠবে। ঘরের ভেতর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠার আগেই যেকোনো মূল্যে আমাকে জানালার লোহার গ্রিল কেটে আমার বাচ্চাদের নিরাপদে বেরোনোর পথ তৈরী করতে হবে।
আমি ভেজা চোখের কোণ দিয়ে দেখি, আমার অসহায় তিনটি শিশু সন্তান পরম বিশ্বাসে নির্বাক করুণ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি উদ্ভ্রান্তের মত প্রানপণে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জানালার লোহার গরাদে মেশিন চালিয়ে যাই.........শত সহস্র দিন মাস ক্ষণ অবহেলার অনন্ত অপেক্ষায় কাটিয়ে আজ এতদিন পর এসে তারা তাদের স্নেহময়ী মাকে খুঁজে পেয়েছে। আমি তাদের চোখের কোণে জমে ওঠা বিশ্বাস আর আশার আলোকে আজ নিভিয়ে দিতে পারি না.......কিছুতেই না.......
উত্সর্গ: প্রিয় মা!
আমার মত কুসন্তানের যাবতীয় দুর্বিনীত ও বর্বর আচরণে অতিষ্ঠ হয়েও যিনি এখনো আমার প্রতি ঠিক ততখানিই স্নেহ ও মমতাময়ী যতখানি ছিলেন আমার জন্মের পরপর।
সবসময় ঠিকভাবে অনুভব না করলেও আমি জানি যে আমি তাকে ভালবাসি। সম্ভবত সে তা জানে না। এবং আমি তাকে কখনো সেটা গলা উঁচিয়ে জানাবার প্রয়োজনও অনুভব করি না...........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।