আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিনি না এলে রাষ্ট্রের কিছু করার নেই (স্ত্রী ও প্রেমিকাবিষয়ক একটি অসমন্বিত দ্বান্দ্বিক রচনা)

সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষণীয়।

ভালবাসা জিনিসটা কঠিন, সহজ অথবা উভয়টাই কিংবা কোনোটাই না। তবে নিশ্চিত, একে সহজ করে দেখলে সহজ। সহজ-কঠিন বিষয়টা গোল্লায় যাক, ভালবাসা এসবের ধার ধারে না। আরও অনেক কিছুকেই সে গোনায় ধরে না, প্রয়োজন মনে করে না বলেই হয়তো।

এভাবে, ওইভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। আসলে ভালবাসার বাইরে, ভেতরে ও বিপরীতে যা কিছু আছে, তার সবই-সবটাই ভালবাসা। কারণ, প্রেমের প্রতিমূর্তিতে-প্রতিরোধে-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়িয়ে যায় ভালবাসা, গড়ে ওঠে অবিনশ্বর। প্রেমহীনতা আছে বলেই তো ভালবাসাটা নির্ণিত হচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, ফিরে ফিরে আসছে, দোল খাচ্ছে পুকুর-পানি ছুঁয়ে গজারি গাছের ফাঁকে। বিড়ালছানার চোখকে এড়াতে পারেনি ভালোবাসা, বড় কোনো চোখও ভালবাসাকে চোখ-রাঙানি দিতে পারেনি।

বিপরীতে হয়তো পায়রার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে বলেছে ‌‌‌'বাকবাকুম'। এই যে বাকবাকুম কিংবা মেহেরজান, প্রেমিকার ঠোঁটের মতো কোমল এবং স্ত্রীর ঠোঁটের মতো কঠিন অথবা সজীব, রঙিন, রোম্যান্টিক- তবু সব সময় শান্তির নয়, প্রশান্তিরও নয়। ছোট-বড় সব শব্দেরই প্রবেশ ঘটেছে ভালবাসায়। শব্দ যাকে বলে, তার সবটাই প্রেমিত হয়েছে, প্রেমময় হয়েছে, প্রেমান্তরিত হয়েছে। এখনও মানুষ ও পৃথিবী যাকে ভালবাসা বলে চিহ্নিত করেনি, সেসবও একদিন ভালোবাসাময় হয়ে উঠবে।

ভালবাসার এই যে দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যের রূপখানি, এটা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। দুর্দান্তভাবে আছড়ে পড়ছে তীরে, শুভ্র মুকুট পরে। কিন্তু ঢেউ থেমে গেলেও সে থামেনি। সব ঢেউ থেমে গেলে সে পাল্লা দিয়ে খেলে যায়। ক্লান্তিতে থেমে যাওয়া ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হাসে।

তখন অনেক কিছুই মনে পড়ে তার, রবীন্দ্রনাথকেও তার মনে পড়ে। সে শুনতে পায়, থেমে যাওয়া ঢেউগুলো গাইছে 'তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও ...'। জীবনানন্দকেও তার মনে পড়ে। মনে পড়ে, 'এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কি না ...'। এভাবে ভালবাসার কাছে মনের কথা শুনতে গেলে আমাদেরও ধার করতে হয় 'পরম অণুর থিওরি' থেকে।

ফেল মারলে যাই ফ্রয়েডের থিওরির কাছে। না পোষালে সেটাকে ভেঙেচুড়ে নির্মাণ করি নতুন থিওরি, যেখানে সবকিছুকেই প্রেমের মতো মনে হয় তখন। এ কথা শুনলে কেউ হয়তো বলে উঠবে 'ভালো তো'। না, ভালোর কিছু নেই, বরং স্বাভাবিক, আর এটাই ভালবাসা, নিরন্তর। লাইফ বন্ড দিয়ে নেমে যাওয়া কয়লাখনিতেও এটা ভালবাসা।

প্যারিস-পাতায়া-অ্যালাস্কাতেও এটা ভালবাসা। অ্যাথেন্স-বাগদাদ-বৈরুতেও এটা ভালবাসা। গুয়ান্তানামো বে কিংবা কাশিমপুরেও এটা ভালবাসা। ফেসবুক-হাইফাইভ-টুইটারেও এটা ভালবাসা। ফ্রিদা কাহলো কিংবা ভাস্কর নভেরার কাছেও এটা ভালবাসা।

মার্ক্স-লেনিন-ট্রটস্কির কাছেও এটা ভালবাসা। চে-মাও-মিনহ্-রোজা লুক্সেমবার্গের কাছেও এটা ভালবাসা। ইবসেন-হিচকক-বার্গম্যানের কাছেও এটা ভালবাসা। মাইকেল-ম্যাডোনা-টেলর সুইফটের কাছেও এটা ভালোবাসা। জিনাত-মেরি-বিদিশার কাছেও এটা ভালবাসা।

রেড স্কয়ার কিংবা হোয়াইট হাউসেও এটা ভালবাসা। কৃষকের হাওলাতি জমিতেও এটা ভালবাসা। আর কৃষকের যে জমি মাড়িয়ে দাস ক্যাপিটালওয়ালাদের বাংলো গড়ে ওঠে, সেখানেও এটি ভালবাসা। তারপর অনেক পরে ক্লান্তি কেটে যায়। ঢেউগুলো নতুন করে জেগে ওঠে।

এরপর দীর্ঘ বিরতিতে ঢেউয়ের সঙ্গে দেখা মেলে। তখন একজন অন্যজনকে বলে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন ...'? এই যে কোথায় ছিলেন, দূরে ছিলেন, অদেখা ছিলেন, সব বাক্যই দূরত্ব বোঝায়। কেবল বনলতার দূরত্বের কথা আমি বলছি না, আমি তাবৎ পৃথিবীর বনলতাদের কথা বলছি। যারা সিঁধুর-টিপ লাগায় অথবা ডিজুস, তাদের কথাও বলছি। বোরকা পরাদের কথাও বলছি এবং আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর রাফ অ্যান্ড টাফ এক্সিকিউটিভদের কথাও বলছি।

বস্ত্র-বালিকাদের কথাও কিন্তু আমি বাদ দিচ্ছি না। ধর্ষিতাদের কথা আমি বলছি, এসিডদগ্ধদের কথাও আমি বলছি এবং পতিতাদের কথাও আমার কাছে গুরুত্বহীন নয়- সবাই কিন্তু দূরে যায়। কোথায় যায়? দূর কাকে বলে? তার চেহারাটা কেমন? ... রাক্ষুসে চক্ষু আর রক্তাক্ত লকলকে জিহ্বাওয়ালা? না, দূর জিনিসটা এত্তোটা শক্তিশালী না। তা ছাড়া খুব একটা কঠিন কিছু বলেও মনে হয় না। কোনো কিছুর কাছে গেলেই যদি সেটা ঘুচে যায়, তবে তার দৌড় বোঝাই যায় অতি সহজে।

আসলে দূর বলে কিছু নেই। এটাকে পাত্তা দেওয়া ঠিক না, তবে অনুভব করতে দোষ কী? অনুভবের চেহারাটা কবি মর্মান্তিকভাবে এঁকেছেন- ‌'এইখানে এলে মনে হয়, তুমি সবচেয়ে বেশি নেই'। ... দুর্দান্ত, বিশাল অনুভব। অনুভবের বস্তুগত অবস্থান কী। যেসব বিষয়বস্তু আমরা সচরাচর অনুভব করি, সেটারই বা নির্ণেয় রূপ কী।

স্ত্রী, মা, বাবা এবং ভাই-বোনের মতোই একজন আত্মীয়। প্রেমিকা; রেজিস্টার্ড কোনো আত্মীয় নয়, কাগজপত্রের বালাইহীন, নিঃস্বার্থ কাছে আসা। তিনি না এলে রাষ্ট্রের কিছু করার নেই, সংবিধানের কিছু করার নেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও কিছু নেই। পরিবার-পরীক্ষা-পাঠশালা ফেলে তিনি চলে আসেন। পাশে বসেন, কাছে বসেন, সাইনবোর্ড পড়ে দূরেও বসেন, কিন্তু বসেন।

অন্তত স্বামী-স্ত্রীর আচরণ করেন না। বসে, বসে থাকতে থাকতে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, এত বছর তোমার সঙ্গে ..., অথচ আজও আই লাভ ইউ বলা হলো না। ছেলেটা হাসে, গুনগুনিয়ে বলে, আই লাভ ইউ আর কবুল তো একই ব্যাপার। মেয়েটা বলে আই লাভ ইউ আর কবুল কি তাচ্ছিল্যের বিষয় নাকি? ছেলেটা উত্তর দেয়, তাচ্ছিল্যের বিষয় নয় বলেই তো স্বামীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা করো। তোমার কাছ থেকে তো এতদিনে কিছু হলেও শিখলাম।

আমারও মনে হয় বিয়ে-শাদী করা উচিত। মেয়েটা কোমল স্বরে বলে, বিয়ে করলে বলো, চলে আসি, অন্য কোনো মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না। ছেলেটা ঈর্ষাকাতর হয়ে বলে, তুমি বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে সংসার করছ, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কও ভালো রাখছো, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে দোষ কী? মেয়েটা বেশ আহ্লাদি কণ্ঠে বলে, জি না, আমি তোমার মতো এত্তো বিশাল হৃদয়ের প্রেমিকা হতে পারিনি যে, তুমি অন্যকোনো মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করবে আর আমি সহ্য করব! তারপরও ভালবাসা বলে কথা, প্রেম-পরকিয়ার রিয়্যালিস্টিক বিশুদ্ধ কথা, ভালবাসার আনুষ্ঠানিকতাও একটা বড়ো কথা এখানে। একক-যৌথ প্রেম, ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো মার্কা প্রেম, ছোট-বড় প্রেম, দিন দশেকের প্রেম, অর্ধযুগ বিচ্ছিন্ন থেকে নতুন সম্পর্কোন্নয়নের প্রেম এবং তুই-তুমি-আপনি সম্বোধনে বিভ্রান্তিকর প্রেম, বলা যায় দেশের সীমানায় এমন ভালবাসার আনুষ্ঠানিকতা অনেক। যদিও রাষ্ট্রের অনেক লিমিটেশন্স আছে, বাইন্ডিংস আছে, খেদ আছে, ক্যাম্পাস আছে, মারামারি আছে এবং ভার্জিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছে।

... তার পরও কাঁটাতার এবং কাঁটাতার-পিলারের সীমানায় দাঁড়িয়ে অনেক কিছুই ভাবতে হয়। ভাবনায় এসে পড়ে ভালোবাসার কাছে কাঁটাতার কখনও দেশ নয় এবং জঙ্গিবিমানও কখনও দেশ নয়। একটি কবুতর কোথাও উড়ছে, এটাই ভালোবাসার স্বদেশ। শিশির-সকালটাও ভালোবাসার স্বদেশ। যেখানে সূর্য ডোবে প্রতিদিন, সেটাকেও ভালোবাসার কাছে স্বদেশ বলে মনে হয়- ভালোবাসাটা এমনই।

তাই তো ভ্যালেন্টাইন ডে। কেবল ইউরোপ-আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নেই, কিন্তু নামটাই কেবল সেসব দেশীয়। বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতা। ২৪ ঘণ্টাও স্থায়ী হয় না। রাষ্ট্রীয় কোনো বাজেট নেই।

সিটি করপোরেশনের কোনো তত্পরতা নেই। পারিবারিক কোনো বরাদ্দ নেই। ওদের মন চায় না বলেই করে না- মনটা ভালোবাসায় সমর্থিত না থাকলে যা হয়! বুঝতে হবে ১ ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইন ডে এক জিনিস নয়। প্রেমিকা আর স্ত্রী এক জিনিস নয়- বাংলা কথা, মাকে মেরিলিন মনরো হতে হয় না, স্ত্রীকেও মেরিলিন মনরো হতে হয় না, কিন্তু প্রেমিকাকে একটু-আধটু মেরিলিন মনরোর মতো হতেই হয় ...। আরও অনেক কারণ কিংবা অকারণ আছে এ বৈষম্যে ও বৈচিত্র্যে।

তবে কোনো ধরনের যুক্তি-তর্ক ছাড়াই প্রেমিকা ও স্ত্রীকে ভিন্ন ভাবতেই হবে। মানুষের জীবনে স্ত্রী আসে ঝড়ের মতো, উল্কার মতো, মাইনের মতো, করাতের মতো। আর প্রেমিকা আসে জোছনা রাতে আলোয় আলোয় প্রকম্পিত শুকনো পাতার মতো, ঘুরে বেড়ানো স্মিত বাতাসের মতো, ধীরে সুধীরে। বাপের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রী আসতে চায় না, কান্নাকাটি করে, গাড়িতে উঠতেই চায় না। কাঁদতে কাঁদতে চেহারাটা লাল হয়ে যায়।

তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় বাপের বাড়ি। আর প্রেমিকা যখন আসে, ধীরেই আসে। সে কান্নাকাটি করে না, চলে আসে। স্বামীরা স্ত্রীকে মারধর করে, কেন করে, জানি না। কিন্তু প্রেমিকাকে কেউ নিছক আঘাতেরও কল্পনা করে না।

স্ত্রীরা স্বামীকে আদেশ দেয়, চোখ রাঙিয়ে কথা বলে, কান ধরে উঠবস করায়। আর প্রেমিকারা আবদার-আবেদনেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাড়ি থেকে বেরুলে স্ত্রীকে সর্বোচ্চ একবার ফোন করলেই চলে। প্রেমিকার খোঁজখবর নেয়া হয় অনেক। অবসর হয়ে কল্পনায় প্রেমিকার চুল স্পর্শ করার মাঝে যে আনন্দের বরাভয়, সে রকম আনন্দ কি স্বামীরা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েও পেয়েছে কখনও।

মনে হয় না- আসলে প্রেমিকারা বড় ভালো। ভালো থাকুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।