নতুন পৃথিবীতে সবাইকে স্বাগমতম!
সাম্প্রতিক সময়ে ‘কেলেঙ্কারি’ শব্দটি উচ্চারণ করলে মনের পর্দায় প্রথমেই ভেসে উঠবে লর্ডস টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের ম্যাচ পাতানোর (স্পট-ফিক্সিং) বিষয়টি। কিন্তু এরই মধ্যে যে বাংলাদেশের বিনোদন জগতে মহাকেলেঙ্কারির একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, স্পর্শকাতর বিষয় বলে তা হয়তো তেমনভাবে সামনে আসেনি। বলা হচ্ছে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভার কথা, যিনি এক মেরিল বিউটি সোপের বিজ্ঞাপন দিয়ে নিমিষেই লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন।
প্রভার সঙ্গে তরুণ ব্যবসায়ী রাজিব হাসানের দীর্ঘ ৮ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। না, কেলেঙ্কারি বিষয়বস্তু মোটেও এটি নয়।
কারো সঙ্গে কারো প্রেম থাকতেই পারে। সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর একটি অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারে লন্ডন থেকে চলতি বছর এমবিএ শেষ করে আসা রাজিবের সঙ্গে তার বাগদানও সম্পন্ন হয় এবং আগামী ১৯ ও ২৫ ডিসেম্বর যথাক্রমে তাদের বিয়ে ও বৌ-ভাতের দিন নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু হঠাৎ করেই গত ১৯ আগস্ট প্রভা ছোট পর্দার আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা অপূর্বের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন। না, এটিকেও কেলেঙ্কারি বলা যাচ্ছে না। কারণ মিডিয়া জগতে প্রেম, বিয়ে, ডিভোর্স খুব কমন ব্যাপার।
তাছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের তার বিয়ের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর অধিকার রয়েছে। বলে রাখা ভালো, অপূর্বরও এর আগে একজনের সঙ্গে ৯ বছরের প্রেম ছিল।
বিয়ের খবর বের হওয়ার প্রথম দু-তিন দিন সবখানে আলোচনার ঝড় বইলেও মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দিয়ে বিষয়টি স্বাভাবিক করে ফেলার চেষ্টা করেন তারা দুজন। বিভিন্ন পত্রিকায় মহা-উৎসাহে তাদের নিয়ে ফিচার ছাপায়। তবে মূল আলোচনায় ছিলেন প্রভা; কারণ সবার প্রশ্ন ছিল- প্রভা এমন কাজ কেন করলো? অপূর্ব এমন করলো কেন- এ প্রশ্ন কিন্তু শোনা যায়নি।
২৬ আগস্ট দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক “প্রভার অপূর্ব জীবন” শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশ করে। সেখানে প্রভা বলেন, “আমাদের সম্পর্কটা মূলত এক বছর তিন মাস আগে শুরু হয়েছিল। প্রেম আসলে করা যায় না, এটা হয়ে যায়। আমার আর অপূর্বর প্রেমটাও কীভাবে যেন হয়ে গেছে। একটা সময়ে এসে মনে হলো, অপূর্বকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
রাজিবের সঙ্গে আমার সংসার করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমি রাজিবের মধ্যে অপূর্বকে খুঁজে বেড়াতাম”। রাজিব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাখেন তো ওসব আলোচনা। অতীত নিয়ে ভেবে লাভ আছে?” কিন্তু ওই অতীতই তার বর্তমানকে এখন বিষিয়ে তুলছে!
তাহলে কেলেঙ্কারি কোনটি? কেলেঙ্কারি হলো- গত কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশে ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে প্রভা ও রাজিবের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের খুবই আপত্তিকর কিছু নগ্ন ভিডিও ফুটেজ এবং প্রতিদিনই তাদের নতুন ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে আপলোড করা হচ্ছে। এ নিয়ে শোবিজসহ সারা দেশেই চলছে মুখরোচক আলোচনা।
২৯ আগস্ট স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘বাংলাভিশন’-এর রাতে সংবাদে এ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। পরোক্ষভাবে এ প্রতিবেদনে ওই ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের দোষ চাপানো হয় রাজিবের ওপর। সবমিলিয়ে বেশিরভাগ লোকেরই ধারণা বদ্ধমূল হয়, এ ফুটেজ ছড়িয়েছেন প্রেমিকাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে ব্যর্থ হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রেমিক রাজিবই ।
ওই প্রতিবেদনটি দেখার পর এতদিন ধরে এ বিষয়ে নিজেকে আড়ালে রাখা রাজিব মিডিয়ার সামনে হাজির হন। ৩০ আগস্ট একটি অনলাইন দৈনিককে তিনি বলেন, যে ভিডিও ফুটেজগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, তা অবশ্যই তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে ছড়াচ্ছে।
কারণ ভিডিওগুলো আমার ও প্রভা, দুজনেরই মোবাইল ও ল্যাপটপে ছিলো; যা আমাদের একান্তই ব্যক্তিগত। কেউ নিজের একান্ত ভিডিও ফুটেজ এভাবে প্রকাশ করতে পারে না। দীর্ঘদিন আগেই ওগুলো আমরা ডিলিট করে (মুছে) দিয়েছিলাম। ওগুলো হয়তো আমাদের কাছ থেকে গোপনে কেউ সরিয়ে নিয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো ঘোলা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দুজনেরই সামাজিক অবস্থানকে বিনষ্ট করার জন্য কেউ এ কাজে লিপ্ত হয়েছে।
বর্তমান যুগে অত্যাধুনিক টেকনোলজির মাধ্যমে এটি অবশ্যই বের করা সম্ভব, কে বা কারা এটি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছে। আপনারা দয়া করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে আইনের আশ্রয়ে নিয়ে আসুন।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, রাজিব যদি সত্যিই একান্ত গোপন এ ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ না করে থাকে কিংবা কাউকে দিয়ে না করিয়ে থাকে, তাহলে তাদের মোবাইল বা ল্যাপটপ থেকে এগুলি তৃতীয় ব্যক্তির কাছে গেল কীভাবে? এর উত্তর খুবই সহজ। কারো ল্যাপটপ বা মোবাইল যতই ব্যক্তিগত হোক না কেন, সেটি কোন না কোন সময় তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে যেতেই পারে। আর প্রভা-রাজিবের হয়তো জানা ছিল না যে, রিকভারি সফট্ওয়ারের মাধ্যমে ডিলিট (এমনকি শিফ্ট-ডিলিট) করে দেয়া ফাইলও হার্ডডিস্ক বা মেমোরি কার্ড থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
তাদের ক্ষেত্রে হয়তো এমনটি ঘটে থাকতে পারে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, অপূর্বের সঙ্গে যদি প্রভার সম্পর্ক এক বছর তিন মাস আগে (মে, ২০০৯) শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তার রাজিবের সঙ্গে বাগদানে রাজি হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? অর্থাৎ একই সঙ্গে দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছিলেন তিনি। হয়তো তখনো তিনি কাকে বিয়ে করবেন, সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেননি, যেটা পেরেছেন মাত্র এক রাতের ব্যবধানে!
পশ্চিমা বিশ্বে সেক্স-স্ক্যান্ডাল কমন বিষয় হলেও কিংবা ইন্টারনেট ও পত্রিকায় হলিউড সেলিব্রেটিদের এ সংক্রান্ত খবর পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলেও দেশের মিডিয়া জগতের শীর্ষস্থানীয় একজন মডেল ও অভিনেত্রীর এমন ঘটনা মেনে নেওয়ার জন্য আমাদের সমাজ এখনো প্রস্তুত নয়। প্রভার মতো জনপ্রিয় একজন মডেল ও অভিনেত্রীর ভিডিও ফুটেজ যদি এমন নির্বিকারে প্রকাশ পায়, তাহলে অন্যদের বেলায় কী হবে?
আর কিছু না হোক, এ বিষয়টিকে অন্যরা একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে নিতে পারে। যদি কেউ কারো সঙ্গে এমন অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়, তাদের এখন আর উচিৎ হবে না খেলাচ্ছলেও তা ভিডিও করা।
প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের ফল পাবেই, তবুও তার ফল সে একাই ভোগ করুক; দশ জনকে নিয়ে ভোগ না করাটাই উত্তম।
একটু কল্পনা করা যাক, রাজিব-প্রভা-অপূর্বর পরিবারের সদস্যদের মনের অবস্থা। এ লজ্জায় তারা কোথায় মুখ লুকাবেন? মেয়ের গোপন বিয়ের খবর শুনে প্রভার বাবা মজিবুর রহমান অসুস্থ হলে তাকে মোহাম্মদপুরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। এখন তার অবস্থা কী হতে পারে!
গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি গ্রামের ব্যবসায়ী আনিসুজ্জামান শিকদারের ছেলে সোহেল একই গ্রামের হাজী ফজলুল হকের স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে এক সন্তানের জননী মনিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তা মোবাইলে ভিডিও করে, যাতে ওই ভিডিও মাধ্যমে ব্লাকমেইল করে যখন খুশি মনির সান্নিধ্য পেতে পারে। স্থানীয় একটি দোকানে সোহেল ওই মোবাইলে গান ডাউনলোড করতে গেলে তার অজান্তেই ওই দোকানদারের মাধ্যমে ভিডিও ফুটেজটি এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
এতে দুপরিবারের টনক নড়লে গত ২৫ জুলাই সোহেলের ভগ্নিপতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এসআই ফারুক আহম্মেদের মধ্যস্থতায় উভয় পরিবারের সম্মতিতে সোহেল ও মনির বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রভার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ আর নেই। কারণ তিনি এখন অপূর্বের স্ত্রী। এ ঘটনার পর কক্সবাজার থেকে সদ্য হানিমুন সেরে আসা নব-দম্পতির অনুভূতি কী হতে পারে, সে দিকটি না হয় বাদই থাকলো। তাছাড়া তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যতও বা কি হবে, এটিও এখন নতুন প্রশ্ন।
কিংবা প্রভার ভবিষ্যত সন্তান যখন বিষয়টি জানবে, তখন তার ‘মা’ সম্পর্কে তার কী ধারণা হবে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- এমন ভিডিও কি না ধারণ করলেই হতো না? এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক ন্যায়নীতি-বাধ্যবাধকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। বেশিরভাগ তথাকথিত প্রেমই এখন একটি পর্যায়ে গিয়ে শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। সীমা অতিক্রম না হয় ওইটুকু পর্যন্তই থাকতো। তাই বলে এমন ছলা-কলা করে তা ভিডিও করতে হবে! এখানে চলে আসে রুচিবোধের প্রশ্ন। তাও না হয় মানা গেল যে, সবার রুচি বোধ সমান হয় না।
কিন্তু দেশপ্রেম?
প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে দেশপ্রেম আসছে কোথা থেকে? দেশপ্রেম আসছে এ কারণে যে, প্রভার যে ভিডিওগুলি ইন্টারনেটে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে সেগুলির নাম- বাংলাদেশি সুপারস্টার/মডেল/টিভি স্টার প্রভা’স এক্সক্লুসিভ সেক্স-স্ক্যান্ডাল ভিডিও ইত্যাদি।
বাংলাদেশ এমনিতেই নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত। তার ওপর যদি এমন নোংরা ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা অত্যন্ত হতাশার, বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। নিজের পরিবার, ভবিষ্যত সন্তানাদি, সমাজের জন্য, সর্বোপরি দেশের স্বার্থে এ সংক্রান্ত অঘটন থেকে নিজেদের সরিয়ে আনার সময় এখনই। এজন্য রাজিব-প্রভাদের মতো প্রেমিক-প্রেমিকার চিন্তা-চেতনায় যেমন পরিবর্তন দরকার, তেমনি মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন তাদেরও, যারা নিঃসংকোচে ও বিনা বাধায় ইন্টারনেটে এ ধরনের ভিডিও আপলোড করে চলেছে।
নাজিম মাহমুদ
[সাপ্তাহিক "শীর্ষ কাগজ"-এর ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।