আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক, দুই, তিন তালাক এবং চতুর্থ বিয়ে হিল্লা (১)

মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!

আমাদের দেশে তিন তালাক এবং হিল্লা বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রামে-গঞ্জে একসাথে তিন তালাক, দুই তিন দিনের হিল্লা বিয়ে বা ডিভোর্সী নারীকে আবার বিয়ে করতে না দেয়া সংক্রান্ত নানা ঘটনার কথা আমরা পত্রিকার মারফত জানতে পাই। আমরা অনেকেই সেগুলোকে ইসলামের প্রকৃত আইন বলে মনে করি। তাই আমি এ পোস্টে চেষ্টা করেছি কোরআনে সত্যিকার অর্থে এই তিন তালাক বা হিল্লা বিয়ে নিয়ে কি বলা আছে সেটা তুলে ধরার। সূরা বাকারাঃ ২২৫।

তোমাদের নিরর্থক শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না, কিন্তু সেসব কসমের ব্যাপারে ধরবেন, তোমাদের মন যার প্রতিজ্ঞা করেছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাকারী ধৈর্য্যশীল। ২২৬। যারা নিজেদের স্ত্রীদের নিকট গমন করবেনা বলে কসম খেয়ে বসে তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে অতঃপর যদি পারস্পরিক মিল-মিশ করে নেয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাকারী দয়ালু। ২২৭।

আর যদি বর্জন করার সংকল্প করে নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী ও জ্ঞানী। ২২৮। আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েজ নয়। আর যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে।

আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীরদের ওপর পুরুষদের প্রাধান্য রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। ২২৯। তালাকে-‘রাজঈ’ হ’ল দুবার পর্যন্ত তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।

আর নিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই জালেম।

২৩০। তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।

২৩১। আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও অথবা সহানুভুতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে। আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না।

আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং তাও স্মরণ কর, যে কিতাব ও জ্ঞানের কথা তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে যার দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানময়। ২৩২। আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ন করতে থাকে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে।

এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। ২৩৩। আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ন দু’বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়াবার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ, পিতার উপর হলো সে সমস্ত নারীর খোর-পোষের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী।

কাউকে তার সামর্থাতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন করা হয় না। আর মাকে তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এবং যার সন্তান তাকেও তার সন্তানের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। আর ওয়ারিসদের উপরও দায়িত্ব এই। তারপর যদি পিতা-মাতা ইচ্ছা করে, তাহলে দু’বছরের ভিতরেই নিজেদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে তাদের কোন পাপ নেই, আর যদি তোমরা কোন ধাত্রীর দ্বারা নিজের সন্তানদেরকে দুধ খাওয়াতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্তকৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও তাতেও কোন পাপ নেই।

আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ অত্যন্ত ভাল করেই দেখেন। মাওলানা ইউসূফ আলীর তাফসীর, সূরা বাকারা, পৃষ্ঠা ৮৩-৮৬ Click This Link উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে যে তথ্যগুলো জানা যায় বা আলেমরা বুঝে নিয়েছেন, সেগুলো হলো, ১। রাগের মাথায় বা ঝোঁকের বশে কোন কিছু করলে সেটা বিবেচ্য হবে না, এটা তালাকের বেলায়ও প্রযোজ্য। এ সংক্রান্ত রাসূল(সাঃ) এর একটি হাদীসও আছে। ২।

নারী-পুরুষ দুজনেরই সমান অধিকার আছে তালাক দেয়ার ব্যাপারে, তবে পুরুষের অগ্রাধিকার আছে। এটা এসেছে মূলত পুরুষের আর্থিক দায়িত্ব থেকে। যেহেতু স্বামী তালাক দিলে ইদ্দত কাল পর্যন্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয়া, মোহরানা দেয়া, সন্তানের খরচ বহন করা যেহেতু পুরুষের দায়িত্ব, অথচ এদিকে তালাকের মাধ্যমে সে তার স্ত্রী হারাচ্ছে এজন্য। ৩। আবার স্ত্রী নিজেও কিছু বিনিময় দিয়ে তালাক নিতে পারবে, যেটাকে "খুলা তালাক" বলা হয়।

এটা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে স্ত্রী কর্তৃক দেয়া তালাক। আরেক রকমের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে তালাক আছে, যেটাকে বলে “মুবাররা”"। সেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক হয় এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যার যার আর্থিক ও অন্যান্য শর্ত মুক্ত করা হয়। ৪। স্বামী কর্তৃক যখন স্ত্রীকে তালাক দেয়া হয় (সচেতন অবস্থায় মৌখিকভাবে বা লিখিতভাবে) তখন সেই স্ত্রীকে তিনমাসের ইদ্দতকাল পালন করতে হয়, তার প্রেগনেন্সী টেস্টের জন্য।

এসময়ে তাকে স্বামীর বাড়িতেই থাকবার জন্য বলা হয়েছে, এবং স্বামীকে নির্দেশও দেয়া হয়েছে স্ত্রীর সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য। এসময়ে স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্বও স্বামীর। এই ইদ্দত পালন করার সময়ে যদি তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে সংসারে ফিরে আসে তাহলে আর বিবাহবিচ্ছেদ হয় না। এমনকি এসময়ের মাঝে স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি মারাও যায় তারা তার সঙ্গীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু ইদ্দতকাল পার হয়ে যাওয়ার পরেও যদি সমঝোতা না হয় তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় – এটা হলো প্রথম তালাক।

এরপর স্বামী বা স্ত্রী অন্য কাউকে বা আগের সঙ্গীকে আবার বিয়ে করতে পারে, এক্ষেত্রে নতুন করে দেনমোহর ধার্য করা হয় এবং এই তালাকপ্রাপ্তা নারীদের তাদের পূর্ব স্বামীর কাছে ফিরতে যাতে কোনরূপ বাধা দেয়া না হয় সেটা স্পষ্টভাবে কোরআনে আল্লাহ্‌তাআলা বলে দিয়েছেন। ৫। পুনরায় বিয়ের পর আবার পরে কোন এক সময়ে যদি বনিবনা না হয় তাহলে আগের নিয়ম মতো দ্বিতীয়বার তালাক হতে পারবে। এরপর স্বামী-স্ত্রী যদি আবারো মনে করে যে তারা একসাথে সংসার করবে তাহলে দ্বিতীয়বারও তারা পুনরায় নতুন করে বিয়ে করতে পারবে --- এটা হলো দ্বিতীয় তালাক এবং তদপরবর্তী বিয়ে। ৬।

এরপর যদি আবারো তাদের মাঝে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তাহলে তৃতীয়বারের মতো তালাক দেয়া যাবে। এবং এর ইদ্দতকালের মধ্যে যদি আর কোন সমঝোতা না হয়, তাহলে স্থায়ীভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা হয়ে যাবে। এরপর তাদের নিজেদের মধ্যে আর বিয়ে হতে পারবে না --- এটা হলো তৃতীয় তালাক। ৭। এরপর ওই স্ত্রী আলাদা কোন পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে যদি চায়।

প্রথম স্বামী যদি আবারো সেই স্ত্রীকে ফিরে পেতে চায়, এখন তাকে অপেক্ষা করতে হবে তার প্রাক্তন স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু বা স্বতঃস্ফুর্ত ডিভোর্সের উপরে। এরপর যদি আবারো ওই প্রাক্তন স্ত্রী আর প্রাক্তন স্বামী পরস্পরকে বিয়ে করে এটা হবে চতুর্থবারের মতো বিয়ে এবং এটাই হলো “হিল্লা বিয়ে” , আরবীতে শব্দটি হলো “হালালাহ্‌”। ৮। ডিভোর্সের সময় যদি কোন দুগ্ধপোষ্য সন্তান থাকে তাহলে ইদ্দতকাল দুধপান শেষ হবার সময় পর্যন্ত হবে এবং ওই পর্যন্ত স্ত্রীর ভরনপোষণের দায়িত্ব স্বামীর উপরে থাকবে। ৯।

এখানে যাবতীয় খুলা তালাক, ১ম , ২য়, ৩য়, ৪র্থ বিয়ে-তালাক – কোনটাতেই কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ বা তৃতীয় কোন পক্ষের কোন বাড়াবাড়ি করা চলবে না। তবে তালাক বা বিয়ের সময় দুজন করে সাক্ষী লাগে। চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।