গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।
নির্ঘুম একটা রাত কাটিয়েছি শুধু আজকের সুর্যোদয় দেখব বলে। চিরটাকাল কষ্টেই কাটিয়েছি। খুব আনন্দ খুব ভাললাগা কখনও পাওয়া হয়নি। খুব ভাল লাগায় বিভোর হতে কেমন লাগে আমি জানতে পারিনি কখনও এর আগে।
নিজেকে নিয়ে ভাবনা ছিল এই পর্যন্ত যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আর যতদিন বেঁচে থাকব প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই বেঁচে থাকব। নিজেকে মানুষ বলে ভাবতে কষ্ট হতো। ক্লান্তিকর এই একঘেয়ে জীবন বড় বেশি যান্ত্রিক। তবুও যেদিন পুর্ণিমা হতো প্রকৃতি ভেসে যেত চাঁদের আলোয় মনটা বড় বিষাদে ভরে যেত।
চাঁদের আলো সারা গায়ে মেখে শুয়ে থাকতাম খোলা আকাশের নীচে আর প্রাণ ভরে দেখে নিতাম আকাশ। নিঃসঙ্গতা তখন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ত। এক মাত্র আকাশই জানে সেইসব নিঃসঙ্গ বচন। তাই এত ভাল লাগা এত আনন্দ কখনও পাওয়া হবে এই জীবনে! ভাবিনি। খুব সুখী লাগে নিজেকে।
আজ খুব অন্যরকম একটা দিন। বলা যায় আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটা দিন। আজ আমি চন্দ্রকে জানাতে যাচ্ছি আমার ভালবাসার কথা। নিরবতা আর সইছে না আমার। আজ যদি বলতে না পারি তো দম বন্ধ হয়েই মরে যাবো মনে হয়।
' তব অধর একেঁছি সুধাবিষে মিশে
মম সুখ দুখ ভাঙ্গিয়া-
মম বিজন জীবন বিহারী।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূণ্য গগন বিহারী। '
ভোরের বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। রাত জাগা ক্লান্ত দু'চোখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে যেন ভোরের নরম আলো। সূর্য উঠছে।
দিগন্তে দিগন্তে তারই আগমনী দেখা যায়। ভোরের আকাশের যে কি অপূর্ব রুপ! দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। এইরকম পবিত্র একটা মুহুর্তেই তো তাকে দেখেছিলাম। আর খুইয়ে বসেছিলাম সর্বস্ব। তবু সেই সব হারানোর মাঝেও যে কত আনন্দ লুকিয়ে ছিল তা জেনেছি প্রতি পলে পলে।
খুব চেয়েছিলাম ঠিক এই রকম একটা সময়েই ওকে বলব ভালবাসি। কিন্তু অজিত বাগড়া দিল। ওরা ছোট্ট একটা আয়োজন করছে আজ আমাদের জন্য। বৌদি চাইছে খুব আনন্দঘন একটা সময়ে ওকে জানাই। আজ আমার জয়েনিং নতুন অফিসে।
নতুন একটা সময়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। অজিত আর বৌদি তাই চাইছে আজ সবকিছুরই শুভ সূচনা হোক। যদিও এই কটা ঘন্টা আমার কাছে কয়েক যুগের মত লাগছে। তাই যখন বললাম 'সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?!' আমার দুর্দশা দেখে অজিত আর বৌদি হেসেই খুন।
নাস্তার টেবিলে অজিত খুব শয়তানী করছিল।
চন্দ্রকে প্রায় বলেই দেয় আরকি। টেবিলের তলা দিয়ে কষে ওর পায়ে লাথি দিলাম। তারপরও হাসতে লাগল বেহায়ার মত। চন্দ্র চুপচাপ খাচ্ছিল। ও যেন দেখেও কিছু দেখছে না।
কি ভাবছে কে জানে! অফিসে যাবার আগে ওকে 'চন্দ্র যাচ্ছি' শুধু এতটুকুই বলতে পারলাম। অথচ কত কি বলতে ইচ্ছা করছিল। মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। চন্দ্র মাথা নেড়ে বলল 'আচ্ছা। '
নতুন অফিস নতুন জায়গা।
কেন জানি এক নজরেই ভাল লেগে গেল। আজ তেমন কিছু করতে হচ্ছে না কাজ। শুধু দেখছি বুঝে নিচ্ছি অফিসের টুকটাক। সারাদিন ধরে চলা দীর্ঘ অপেক্ষার অবশেষে অবসান হলো। বহুবার ইচ্ছে করেছে ওকে একটু ফোন দিই।
কি করছে, কেমন আছে, কিছু লাগবে কিনা এই টুকটাক। কিন্তু কেন জানি পারলাম না। একরাশ সংকোচ এসে ঘিরে ধরল।
বাসে আসতে আসতে অজিতের সাথে কথা বললাম। সব আয়োজন শেষ।
বৌদি কিছু কেনাকাটা করবে। বাজারে আছে ওরা। অজিত জিজ্ঞেস করল ' তোর কোন স্পেশাল ফরমায়েশ আছে? থাকলে বল। ' বাড়িতে তারমানে কেউ নেই কাজের দু'জন লোক ছাড়া। বুকের ভেতর কেমন জানি একটু অসস্তি লেগে উঠল।
এই এতগুলো দিনের মাঝে ওকে একা রেখে আমরা কেউ কোথাও যাইনি। সবসময়ই কেউ না কেউ ছিল। আজই প্রথম। অজানা আশংকায় কেন জানি বুক কাঁপছে। গোবিন্দপুর আরো দশ মিনিটের পথ।
ওর সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল। কিন্তু চন্দ্রের ফোন তো বন্ধ রেখেছে সেই সেদিনের পর থেকে। অগত্যা বাড়ির নম্বরে ফোন দিলাম। রিং বাজছে। কেউ ধরছে না।
বাজতে বাজতে কেটে গেল এক বার, দু বার, দশ বার। বাস থেমেছে। তখনো ফোন দিয়ে যাচ্ছি। নাহ কেউ ধরছে না। ঘেমে নেয়ে উঠেছি ভেতরে ভেতরে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে অজিতের বাসা খুব বেশি দূরে না। এতটুকু পথ হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। হাঁটার মত ধৈর্য এখন নেই আমার। একরকম দৌঁড়ে চলে এলাম বাসায়। গেট থেকেই শুনতে পাচ্ছি ফোন বাজছে।
কিন্তু কেউ ধরল না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অথচ বাড়ির কোথাও এতটুকু আলো নেই। কি ব্যাপার ?! শুনশান নিরব চারিদিক। কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন? চন্দ্র কোথায়?! হৃৎপিন্ড এত জোরে বাড়ি খাচ্ছে পাঁজোড়ের সাথে যে ফেটে যাবে মনে হচ্ছে।
ভয় লাগছে।
'চন্দ্র!' জোরে চেঁচিয়ে ডাকি। সদর দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে থোকা থোকা জমাট বাঁধা অন্ধকার। 'চন্দ্র-অ-অ কোথায় তুমি?' ভেতরে ঢুকতেই পায়ের সাথে কি যেন বাঁধল।
কি যেন পড়ে আছে মেঝেতে। হাতড়ে হাতড়ে লাইট জ্বালিয়ে আতঙ্কে জমে গেলাম। সুবির!!! অজিতের মালী। রক্তের পুকুরের মাঝে পড়ে আছে। গলাটা কেটে রেখে গেছে ধারালো কিছু দিয়ে।
মাথা ঘুরে উঠল। কিন্তু কারা?! চন্দ্রের স্বামী নয়ত?! কিন্তু সে কেমন করে জানবে চন্দ্র কোথায় আছে? মুহুর্তেই হাজারো প্রশ্ন ঝাঁক বেঁধে উঁকি মারছে মনের ভেতরে। চন্দ্র! চন্দ্র কোথায়?! লাশ টপকে দোতলায় চন্দ্রের ঘরে যাই। কেউ নেই! সব জিনিস তছনছ করা হয়েছে। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চন্দ্রকে পেলাম না।
পেছনের বাগানের দিকের দরজাটাও খোলা। ভেজা মাটিতে বেশ কিছু পায়ের ছাপ। দুর্বৃত্তরা সম্ভবত এই পথেই ঢুকেছিল। অনেকদুর পর্যন্ত দৌঁড়ে গেলাম। মনে ক্ষীণ আশা হয়ত ওরা বেশিদুর যেতে পারেনি।
না পেলাম না।
কোত্থাও নেই চন্দ্র। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কেন আমি ওকে একা রেখে গেলাম? সারাদিনে কেন একবারও ফোন দিলাম না? বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে খুঁড়ে যাচ্ছে। চন্দ্র!!! অবর্ণনীয় কষ্টে ডুবে যাচ্ছি আমি।
হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাই নীচে।
কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা। কে যেন কাঁধ ধরে প্রচন্ড ঝাঁকি দিচ্ছে। কে?! বিরক্ত লাগছে। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিই।
'অরন্য! চন্দ্র কোথায়?' অজিত আর বৌদির উৎকন্ঠিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি বোবা চোখে। সারা শরীর ভেঙ্গে প্রবল বেগে কান্না আসছে। ঝাপসা লাগছে চারপাশ। সমস্ত কষ্ট প্রবল তোড়ে বের হয়ে আসছে কান্না হয়ে। সমগ্র অস্তিত্ব কাঁদছে আমার।
(চলবে)
চন্দ্রকথা-জোছনা
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।