আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এজি মাহমুদ, আবু সাইয়িদ এবং ঐশীরা

এক. প্রথমেই দুজন মানুষের কথা বলব। একজনের কথা বলার আগে একটি ভূমিকা দিয়ে নিই। আমি সাধারণত দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। রাতে টোয়েন্টিফোরের টকশো শেষ করে ফিরতে ফিরতে এমনিতেই দেরি হয়। সেই কারণে ২০ জুলাই একটু বেশি দেরি হয়।

তখন প্রায় ১০টা বাজে। ইতোমধ্যেই শাহীন একটি কাজে বাসায় এসেছে। নিচে ইন্টারকম থেকে সিকিউরিটি জানাল কেউ একজন এসেছে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। শাহীন গিয়ে ফোন ধরল। আমি ড্রইংরুম থেকে বুঝলাম, নিচের লোকটি ফোন ছাড়তে চাইছে না।

আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি নিজেই উঠে গিয়ে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো, মান্না আমি এজি মাহমুদ। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম আপনি উপরে চলে আসুন।

এজি মাহমুদকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে খানিকটা পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বুঝি দরকার আছে।

এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন। সেই পদাধিকারবলে তিনি প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সা'দাত মুহাম্মদ সায়েমের সামরিক শাসনামলে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এভাবে দেখতে গেলে বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে তিনি বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে ১৯৭৭ সালে জাপানি রেড আর্মি একটি যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করে।

একটি গুরুতর সংকট ছিল সেটি। সেই সংকট মোকাবিলায় তার দায়িত্বই ছিল প্রধান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের পরিস্থিতি একবারই মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এসব নিয়ে নিজের আত্দজীবনীমূলক একটি বই লিখেছেন এজি মাহমুদ। যার নাম মাই ডেসটিনি।

এজি মাহমুদ বাসায় এসে ঢুকলেন। ৮১ বছর বয়সের এই মানুষটিকে আমি দেখলাম প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে। এখনো ঋজু হয়ে হাঁটেন, স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলেন। বললেন আমি আপনার পাশের গলিতেই থাকি। মাঝে মাঝে এদিক দিয়ে হাঁটাচলা করি।

গতকালও এদিক দিয়ে যাওয়ার পথে আমার বইটি আপনাকে দিয়ে গেছি।

আমি স্বীকার করলাম বইটি আমি পেয়েছি। কিন্তু পড়ে দেখা হয়নি। মাত্র একদিনে তা তো সম্ভবও নয়। এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এজি মাহমুদ সেটা বোঝেন।

বললেন, আমি আমার বইটির নাম দিয়েছি মাই ডেসটিনি। আমার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যাকে ডেসটিনি হিসেবেই মানতে হবে। অন্য কোনোভাবে তার ব্যাখ্যা করা যাবে না। যেমন এ বইটি লেখাই হতো না। বিশেষ করে আমার নাতনির তাগিদেই আমার এই লেখাটা হলো।

বয়স্ক লোকদের প্রতি আমার একটি বিশেষ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আছে। আর যদি সেই মানুষটি বয়সের শেষ প্রান্তে এসেও সজীব থাকেন, সক্রিয় থাকেন তবে তিনি আমার ঈর্ষার পাত্র। আমার বয়স এখন ৬২ ছাড়িয়ে গেছে। নিজের আয়নায় আমি বিচারপতি হাবিবুর রহমান, ডা. বি চৌধুরী, এবিএম মূসা, ড. কামালদের দেখি। কামনা করি তাদের বয়সেও আমি যেন তাদের মতো সক্রিয় থাকতে পারি।

আমার মা ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বলতেন আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা, কারও কাঁধে হাত রেখে যেন আমাকে বাথরুমে যেতে না হয়। দুর্ভাগ্য আমার মায়ের মৃত্যুর আগের দুই বছর তিনি স্মৃতি হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন।

আমি এজি মাহমুদকে বললাম, ৮১ বছরে বয়সে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। একটি বই পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন।

আপনি তো সম্পূর্ণ সফল একজন মানুষ। এজি মাহমুদ স্মিত হাসলেন। হাসলে এখনো তাকে সুন্দর দেখায়। বললেন, ডেসটিনি। একজন স্রষ্টা আছেন, আপনি তার বাইরে যেতে পারবেন না।

বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন তিনি। রোজার দিন। চা-পানি খাওয়ার ব্যাপার নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ কথা হলো। মজার ব্যাপার তার মধ্যে খুব বেশি রাজনীতি নেই।

তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাসের কথা বললেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এজি মাহমুদের বইটি আমি পড়ে দেখেছি। একেবারেই তার আত্দজীবনীমূলক গ্রন্থ এটি। বর্তমান প্রজন্মকে তা কতখানি আকৃষ্ট করবে তা দেখার বিষয়। ইংরেজিতে লেখা বইটি সুখপাঠ্য।

ইংরেজি ভালো। এজি মাহমুদ বলছিলেন বইটি ইংরেজি হলে বাংলা পাঠকদের কাছে এটা বেশি পেঁৗছবে না। ডেইলি স্টারে সৈয়দ বদরুল আহসান তার ওপর একটি পর্যালোচনা লিখেছেন কিন্তু তাও ইংরেজিতে।

আমি আগেই বলেছি, ৮০-৮১ বছর বয়সের একজন মানুষের একটি বই বেরিয়েছে সেটাই আমার কাছে একটি খবর। আর সেই মানুষ যদি হন দেশের এক সময়ের শাসকদের অন্যতম তবে তার একটা গুরুত্ব থাকেই।

এজি মাহমুদের বইয়ের ভেতরে অবশ্য তৎকালীন রাজনীতির বিষয়ে কোনো কথাই নেই। ভবিষ্যতের কোনো দিকনির্দেশনাও নেই। কিন্তু তারপরও তার বইটি একটি কালিক তাৎপর্য বহন করে। আমি তার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

আরেকজন মানুষের কথা বলব।

বয়সে তিনি এজি মাহমুদের ১০ বছরের ছোট। এক সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তারও বহু আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) ভিপি ছিলেন। কিন্তু তাকে ঠিক বয়স্ক মানুষ হিসেবে উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে না আমার। যদিও দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজনীতি করছেন, তার সমসাময়িককালে কোনো কোনো রাজনীতিক যেমন আবদুর রাজ্জাক, সর্দার আমজাদ হোসেন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তথাপি তাকে এখনো বয়স্ক দেখায় না।

প্রচলিত রাজনৈতিক নেতাদের মতো তিনি মাঠ গরম করা বক্তা নন। বরঞ্চ নীরবে-নিভৃতে থেকে লেখাপড়া ও গবেষণার কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন। আগে নিয়মিত পত্রপত্রিকায় কলাম লিখতেন, অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে তার। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল গবেষণামূলক গ্রন্থ। এবার সত্তর বছর বয়সে তিনি 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা : কূটনৈতিক যুদ্ধ'-এর ওপর একটি গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।

পাঠকবৃন্দ হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি অধ্যাপক আবু সাইয়িদের কথা বলেছি। আগেই উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সেই ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। ধারাবাহিক রাজনৈতিক জীবনে এক প্রকার ছেদ পড়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে যখন আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ হাসিনা ও সংস্কার নিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক কেউ কেউ উসকে দিয়েছিলেন।

সেই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে আবু সাইয়িদ অন্যায়ভাবে শাস্তি পেয়েছিলেন। তাকে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, দলের সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ মনসুর, অধ্যাপিকা নাজমা রহমান, মুকুল বোস, খ ম জাহাঙ্গীরসহ অনেকেই একইভাবে দণ্ডিত হয়েছিলেন। এদের প্রায় সবাই মুষড়ে পড়েছিলেন। অনেকেই দলীয় সভানেত্রীর করুণা লাভের জন্য হাতজোড় করেছিলেন।

অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে এসব করতে দেখেনি কেউ। নেতৃত্বের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা দেখাননি। কাউকে ছোট করার চেষ্টা করেননি। অনেকেই বোঝেনি নীরবে-নিভৃতে নিজের একটি জগৎ তৈরি করেছেন তিনি। সেই জগতে বসে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা : কূটনৈতিক যুদ্ধ'-এর উপরে গবেষণা করেছেন।

যে কাজ আওয়ামী লীগেরই করার কথা ছিল।

আমি আবু সাইয়িদকে নিয়ে টোয়েন্টিফোরে টকশো মুক্তবাকে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান দেখে এক দর্শক ফোনে আমার কাছে মন্তব্য করলেন, শেখ হাসিনা আবু সাইয়িদকে ভুলভাবে হলেও ওই শাস্তি দিয়ে তার মহাউপকার করেছেন। এ জন্যই তিনি পিএইচডিটা করতে পেরেছেন। এখন তিনি অধ্যাপক সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর।

অভিনন্দন।

দুই. ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার চামেলীবাগে এক লোমহর্ষ খুনের ঘটনা ঘটে। ১৭ বয়সের এক তরুণী ঐশী তার পিতা-মাতাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ ইয়াবা সেবনে বাধা দেওয়ায় পিতা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং মা স্বপ্না রহমানকে বন্ধুদের সহযোগিতায় হত্যা করে মেয়ে ঐশী। কী মর্মান্তিক! কী হৃদয়বিদারক! আমাদের মতো আত্দিক পারিবারিক বন্ধনের সমাজে এরকম ঘটনা! সারা দেশের হৃদয় প্রকম্পিত।

আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে গর্ব করি। বলি যে পৃথিবী আমরা গড়তে পারিনি, যে দেশ ও সমাজ আমরা নির্মাণ করতে পারিনি সেটা ওরা নির্মাণ করে দেখাবে।

১৮ তারিখ রাতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের এক আলোচনায় বক্তারা বললেন, এ জন্য এককভাবে কি মেয়েটিকে দায়ী করা যায়? মেয়েটি মাদকাসক্ত ছিল তা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সে মাদকাসক্ত হলো কেন? এত মাদক কোথা থেকে আসে? সেটা বন্ধ হচ্ছে না কেন? আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র বা রাজনৈতিকভাবে মাদক ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ আমরা নিয়েছি কি? যে পুলিশ দম্পতি মারা গেছেন সেই পুলিশ প্রশাসন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এরকম কথা পত্রপত্রিকায় অনেকবার ছাপা হয়নি কি? তাদের আশ্রয় দিচ্ছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। বিশেষত সরকারি দলের এমপি ও প্রভাবশালীরা।

এ কথা কি বহুবার উচ্চারিত হয়নি। যারা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবারই মতে আমাদের তরুণ ও যুব সম্প্রদায় আজ পথহারা, তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত বটে_ কিন্তু এর মূল কারণ মাদক নয়, রাজনীতি। আমাদের রাজনীতির পথে, অলক্ষ্মী, সাংঘর্ষিক। তাই নতুন প্রজন্মের কোনো দিকনির্দেশনা, জীবনবোধ নেই এতে। ঐশীর ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে কিন্তু এরকম ঘটনা একেবারেই নতুন নয়।

মর্মান্তিক এসব ঘটনা এখনই এড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে আরও বড় মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। এমনিতেই নীতিহীন আপসহীন সাংঘর্ষিক রাজনীতি আমাদের এক ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদ, অধ্যাপক (ডক্টর) আবু সাইয়িদ আর ঐশীদের মধ্যে কত তফাৎ। বুকের মধ্যে চুর চুর করে নদী ভাঙনের মতো, নদীর পাড়ের বালুকণার মতো দুঃখ ঝরে পড়ে।

আমরা কেউ একচুল সরে দাঁড়াই না। এই নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।