প্রথমা :
সাত বছরের ছোট্ট একটা ছেলে । হাফ প্যান্ট পরে । বাসার পাশেই মাঝারি আকৃতির এক পাহাড় । লোকজন ‘টিলা’ বলে । ঝোঁপ ঝাড়ের পাশে সারাদিন হৈ চৈ ।
স্কুলের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসা লেবু মামার সপ্ত কান্ড,মামার বিয়ের বরযাত্রী পড়ে । পাঠ্য বইয়ে দারুন অনীহা । সকাল বেলার মক্তবের হুজুরকে আরো ভয় । তেল মাখানো কচকচে জালি বেতের ভয় । মুশকিল হচ্ছে নিজের বেত নিজেকেই এনে দিতে হয় হুজুরকে ।
ছেলেটার স্কুলে খাদিম স্যার বাংলা পড়ায় । বাংলা পড়ানোর মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ কি যেন বলতো,ওটা কি ভাষা ওরা বুঝতো না । কঠিন,অন্যরকম । ক্লাসের ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো,কি বলে খাদিম স্যার ? মোটাসোটা তেলতেলে দেখতে খাদিম স্যার । সারাদিন মুখে চোখে বিরক্তি,যেন চিরতার পানি খেয়ে এলো এই মাত্র ।
ক্লাসের পড়া না পারলে কানের পাশে জুলফি ধরে বেমক্কা টান,ব্যাথায় ককিয়ে উঠতো ওরা ।
মুখে বলতেন স্যার : বল পাকিস্তান ।
খাদিম স্যারের বিরক্ত মুখে তখন কি হাসি !
আগস্ট মাস এলেই সারা স্কুলে সাজ সাজ রব । কত রিহার্সেল । মাখন ভাই স্কুলের স্কাউট লিডার ।
কোমরের কোন জায়গায় পতাকার স্ট্যান্ড ঠেকিয়ে পতাকা ধরবে,কি ভাবে সবাই লেফট-রাইট করবে,খাদিম স্যার সবার সামনে থাকবেন । কুচকাওয়াজ করতে করতে সবাই সার কারখানার প্রধান অফিসের সামনে যাবে । কোরাস গাইবে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ । কারখানার মহা-ব্যবস্থাপক পতাকা উত্তোলন করবেন । পরে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হবে ।
স্কুল ছুটি । রাতে স্কুলের মাঠে ক্যাম্প ফায়ার । মাখন ভাই তখন একদম হিরো । কি দাম তার ! মাখন ভাই পুরো স্কুলের লিডার । মাখন ভাই স্কুলের যে কোনো ছেলে কে যদি ডেকে বলে : শোন তাড়াতাড়ি পকেট থেকে দশ পয়সা বের করে দে ।
স্কুলের যে কোন ছেলে সে আদেশ পালন করতে পারলে ধন্য । আহ,মাখন ভাই আমাকে চেনে ।
দুপুর বেলাটা খুব গরম । সারাদিন চিনচিন করে ঘাম । স্কুলের শুকনো কদম গাছটার নীচে পকেট ভর্তি মারবেল নিয়ে খেলা ।
হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ দিয়ে দিলেন হেড স্যার,রাজ্জাক স্যার । তার আগে ক্লাসে ইয়াহিয়া স্যার কি যে বললেন মনে নেই,যেটুকু বলা হলো তার মানে কাল থেকে স্কুল ছুটি,আসতে হবে না । কবে খুলবে পরে জানিয়ে দেবে । কী খুশি সবাই,পড়াশুনা নেই,বাড়ির কাজ নেই,খাদিম স্যারের জুলফি টানা নেই । ‘পাকিস্তান’ বলতে হবে না ।
আহ !
বাসায় এসে ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যায়,লাইব্রেরীও বন্ধ থাকবে । গল্পের বই পাবে কোত্থেকে ? সাত্তার স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো । সন্ধ্যায় ঘুমে আর চোখ ঢুলে আসে না । পড়া নেই । বাবা ঘরে ফিরলে গম্ভীর গম্ভীর লাগে ।
মা বা বাবা কেউ পড়তে বলছে না । বড়দার থাপ্পড় নেই আজ অংক ভুল করলে । হঠাৎ অনেক রাতে কিসের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর । কিসের শব্দ ? কোথায় যেন রেডিও বাজে । কান পেতে শোনার চেষ্টা ।
ওদের বাসায় তো কখনো রাতে রেডিও বাজে না পড়াশুনার ব্যঘাত হবে বলে । বাবা কি যেন শোনার চেষ্টা করছে রেডিও’র নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে । হঠাৎ পেছনের দরজায় জোরে জোরে শব্দ । ফয়েজ কাকা’র গলার শব্দ । বিরাট গলা : মতিউর সাহাব, হে মতিউর সাহাব ।
বাসার সবার ঘুম ওখানেই শেষ । ফয়েজ কাকা’র কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না । কি রকম অদ্ভুত করে কথা বলেন,খাদিম স্যারের মতো । ফয়েজ কাকা’র ছেলে শেরশাহ খান ছেলেটার সহপাঠী । শেরশাহ’র সারা আঙ্গুলে পাঁচড়া আর নাক ভর্তি সর্দি ।
শেরশাহ ছেলেটাকে প্রায়ই বলে :
হাম শেরশাহ খান,তু টিপু মিয়া । হাম বিহারী,তু বাঙ্গাল । আয় মারামারি করি ।
ছেলেটা ওর হাতের খোস পাঁচড়া দেখে মারামারি করতে যেত না,অবশ্য শেরশাহের সাথে হেরে যাবার সম্ভাবনাও আছে ।
ফয়েজ কাকা বললেন অত রাতে বাসায় এসে :বাসায় পাকিস্তানী পতাকা আছে ?
বাবার মুখটা খুব চিন্তিত : না,নেই ।
:কুছ পরোয়া নেহি । আপলোক সব হামার বাসায় চলে আসেন । ঘাবরাও মাত ।
সবাই ফয়েজ কাকাদের বাসায় যাবার জন্য রেডি হলেও ছেলেটার মনে হলো ফয়েজ কাকা’র মুখে কোথা থেকে যেন খাদিম স্যারের তেলতেলে মুখ এসে মিশে গেছে । বাসায় ওকে একা পেলেই ওর জুলফি টেনে ধরে বলবে : বল পাকিস্তান ।
ছেলেটা মার্চ মাসের শেষের দিকে অনেক রাতের গভীরে বিহারী ফয়েজ কাকা’র বিশাল শরীরের সামনে বলে উঠল : না যাব না ।
মধ্যমা :
কি ঠান্ডা । লেপের মধ্যে কি যে আরাম । উঠতে ইচ্ছে করে না । কাছে দূরে গোলার শব্দ ।
বন্দুকের গুলির শব্দ । শব্দে ছেলেটার ঘুম ভেঙ্গে যায় পুরোপুরি । চোখ খুলে যে প্রথম ছবিটা সে দেখতে পায় সেটা হলো একটা বিরাট গোঁফওয়ালা মানুষের ছবি । ছেলেটা গোঁফের দিকে তাকিয়ে থাকে । কোত্থেকে এত শব্দ ? বিছানার উপর উঠে বসে ।
বাবা জোরে রেডিও ছেড়ে দেন । কী সুন্দর গান বাজছে । এত সকালে এত জোরে ওদের বাসায় কখনো রেডিও বাজতে শোনেনি । বাসার সবাই পিটপিট করে জেগে ওঠে বড়দা,স্বপন,সোহেল । মনি তখন খুব পিচ্চি ।
সবার চেঁচামেচিতে মনিটা ক্যাঁ ক্যাঁ করে কাঁদে গলা ফাটিয়ে । ভীতু স্বপন ওর দুধের বোতল খুঁজতে লেগে যায় । বাবা সবাইকে জিজ্ঞেস করে,চোখে মুখে কি খুশি !
:কি খাবি তোরা আজ ?
:মাছ খাব ।
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে । মাছ খাবি তোরা ? বাবাটা হতভম্ব ।
বাবাটা জামা গায়ে ছুটে যান ফয়েজ কাকার বাসায় । ছেলেটাও পিছু পিছু । বাবা বলছেন ফয়েজ কাকাকে
:আপনাদের বাসায় বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ আছে ?
:না-ফয়েজ কাকা’র ভীতু উত্তর ।
:আমাদের বাসায় সবাই চলে আসুন । বাবাটা খুশি খুশি হয়ে বলেন ।
ছেলেটার বলতে ইচ্ছা করে শেরশাহ খানকে-
:আমি টিপু,তুই শেরশাহ । আমি বাংলা,তুই পাকিস্তান । আয় মারামারি করবি ?
সমাপ্তি :
হুমায়ুন কবির আরিফ ছেলেটার খালাতো ভাই । বয়সের বিশাল পার্থক্য থাকলেও দু’জনের অন্যরকম বন্ধুত্ব । অসম বন্ধুত্ব ।
আরিফ ভাই ওকে উদয়ন পত্রিকা দিয়ে বইয়ের মলাট দিয়ে দিত । রুশদেশের বিখ্যাত লোকদের ভিউকার্ড দিতেন । সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্প শোনাতেন । ঘোড়াড্ডিম,ছেলেটার মাথায় এত কিছু ঢোকে না ।
বড়দা ছেলেটা এক ক্লাস উপরে নীচে ।
দেশ স্বাধীন হলে ওরা দু’জনেই পরীক্ষা ছাড়াই পরের ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে যায় । বাজারে নতুন বই নেই,থাকলেও ছেলেটার কপালে নেই । ও বড়দার এক ক্লাস নীচে দেখে সবসময় বড়দা’র পুরোনো বই পেত । কখনো নতুন বই পেত না । কী যে মন খারাপ তাতে ।
আরিফ ভাইয়ের সে কি আগ্রহ,বইয়ে যেখানে যেখানে পাকিস্তান লেখা সেখানে কেটে কেটে বাংলাদেশ লিখছে । কী উৎসাহ আরিফ ভাইয়ের । ছেলেটা খুব মিষ্টি খেত। একদিন দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে, আরিফ ভাই ওকে বল্লেন: টিপু মিষ্টি খাবি ? ওকে আর পায় কে ? আরিফ ভাই গম্ভীর মুখে যা বল্লেন তার অর্থ এই যে এজন্যে হাঁটতে হবে অনেক দূর । ছেলেটা তবু রাজী ।
হাঁটতে থাকে ঢালু সড়ক বেয়ে । রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা দুইটা গাড়ী হুঁশ করে চলে যায়। জামশেদ কাকার দুটো বউ। দুপুরের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙ্গে বড় বউয়ের ছেলে শামীমকে পেটায় জামশেদ কাকা । শামীমের সে কি আর্ত চিৎকার ।
চিৎকার ছাপিয়ে কারখানার শিফট বদলের সাইরেন বেজে ওঠে । একটা মাঝ বয়সী লোক দুটো গরু পিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইন্দানগর চা বাগানের দিকে,গরু খোঁয়ারে দেবে বলে । খাদিম স্যারের বাসার পাশ গলে আরিফ ভাই আর ও হাঁটতে থাকে । স্যারের বাসায় বিরাট এক তালা । ছায়ানীড় সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো শুরু হবে হবে করছে ।
মাইকে জোরে গান বাজছে “নীল আকাশের নীচে আমি/রাস্তায় চলেছি একা”।
পেট ভরে মিষ্টি খায় ওরা দু’জন কলা মিয়ার মিষ্টির দোকানে । মাছি উড়ছে টেবিলে টেবিলে । দুপুর বেলাটা উড়তে উড়তে চলে যায় কালো ওড়নার মতো সন্ধ্যার দিকে । আরিফ ভাই চলে যান অস্ত্র জমা দিতে,তার আগে লম্বা চুল কেটে ফেলেন নিরঞ্জনদা’র দোকানে ।
সেই যে অস্ত্র জমা দিতে গেলেন আর ফিরলেন না ।
জীবনটাও জমা দিয়ে বেঁচে থাকলেন স্মৃতিতে । এখনো ।
রচনা : ৫ মার্চ,২০০৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।