কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন।
বছর খানিক আগের কথা। ফেসবুক ক্রিকেট নিয়ে একটা গ্রুপ আছে গ্রেটেস্ট ক্রিকেট স্লেডজ।
(এই গ্রুপটার ক্রিয়েটার কয়েক মাস আগে মারা গেছেন)। সেই গ্রুপ এ বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হয় তাই আমরা কয়েকজন বাংলাদেশীও ঝাপায় পড়ি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছু ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানিরা অবশ্য আমাদের পক্ষে মাঝে মাঝে কিছু বলে। এদের মধ্যে কয়েকজন ফেসবুক ফ্রেন্ডও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বেশ ভদ্র গোছের।
তার নামটা আমি ভুলে গেছি আহমেদ বশীর টাইপ কিছু একটা। সে সম্ভবত তার জীবনটাকে উৎসর্গ করেছে পাকিস্তানি উদীয়মান বোলার মোহাম্মদ আমীর এর জন্য বা এই জাতিয় কিছু। ফেসবুকে আমীরকে নিয়ে গ্রুপ খুলসে আর গ্রুপ এর নাম আমীর ইস ফ্রম ছাঙ্গাবাঙ্গাইল টাইপ কিছু একটা। বাঙ্গাইল দেখে আমি আবার ভাবলাম বাঙ্গালী কিনা যেহেতু পাকিস্তানে ১৫ লাখ এর মত বাঙ্গালী আছে। পরে জানলাম না মোহাম্মদ আমীর বাঙ্গালী না।
সেটা অন্য একটা গ্রামের নাম।
লেখাটা আসলে অন্যকিছু নিয়ে। যেহেতু ফেসবুক এ গ্রুপ এ কিছু বললে সেটা নিজ প্রোফাইলে থাকে বশীর দেখল আমি “ আই জাস্ট হেট পাকিস্তান ফর দা জেনোসাইড” গ্রুপ এ বার বার পোস্ট দেই। এটা দেখে সে ফেসবুক ইনবক্স এ মেসেজ দিল। ইংলিশ উর্দু মিলায় কথাবার্তাটা অনেকটা এরকম
বশির - ইয়ার তুম বাংলাদেশি হো তুম মেরে ভাই হো।
জিকো- Nice to know. I have sent add request for your Ameer group.
বশির- Why are you always crazy about 1971?
জিকো- Because that means a lot to me and my country.
বশির- Those were part of dirty politics. Forget those.
জিকো- Killing 3 million people can be politics for you, for us, genocide, and murder.
বশির- You are my friend. It hurts me when you talk against my country.
জিকো- - Then better we not befriend anymore. I am going to remove you. There is no question of reconciling with any Pakistani for the 1971 Liberation War unless they feel sorry for it.
বশির কে রিমুভ করতে যাবো তার আগে সে মেসেজ দিল। আরো কিছু কথাবার্তা ছিল যেগুলো এই পোস্ট এর জন্য জরুরি না।
বশির এর চাচা ১৯৭১ বাংলাদেশ এর কোন এক শহরে ছিল। পাকিস্তানি আর্মির সদস্য। বশির মোটামুটি নিশ্চিত তার চাচা একজন ভাল মানুষ এবং কোন বাংলাদেশি মেয়ে রেপ করেনায়, পাকিস্তানি আর্মিরা নাকি রেপ করেনা।
(বশির এর চাচা যে চাপাবাজি করসে তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই)। তখন এপ্রিল কি জুন মাসের ঘটনা। তখনও মুক্তি নামটা তেমন আতঙ্ক ছড়াতে পারেনায়। তবে তারপরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনির ক্ষতি যে একেবারে করতেসেনা তা না। ২ মাস ঐ শহরে থাকার পর বশিরের চাচারা কোন একটা গ্রামে গেল।
এবং ৫ জন মুক্তি কে ধরল। মুক্তিরা সবাই লুঙ্গি পড়া। তাদেরকে ক্যাম্প-এ আনা হল। ক্যাম্প-এ তাদের থেকে কথা বের করার জন্য নানারকম অত্যাচার চলল। (এই অত্যাচারের কথা বশির বলেনায় কিন্তু আমি বুঝতে পারতেসি)।
বশিরের চাচাদের যে ক্যাপ্টেন যে বিরাট দেশপ্রেমিক। বাংলাদেশ, মুক্তি এইসব সে সহ্যই করতে পারেনা। ৫ জন মুক্তির একজন কে সামনে আনা হল। তার মাথায় পিস্তল ধরা হল। তাকে সরাসরি বলা হল অন্য মুক্তিদের খবর দিতে।
নাহলে এখনই তাকে জানে মেরে ফেলা হবে। মুক্তি মাথা নিচু করে মাটিতে হাত দিয়ে সালাম করল। তবে তাই হোক। আমার জন্মভুমিকে রক্ষা করার জন্য আমি মরতে এখানে এসেছি। মেরে ফেলা হোক আমাকে।
মুক্তিকে মেরে ফেলা হল। মুক্তির নাম ছিল কামাল। বাংলাদেশের কোন জায়গায় এ ঘটনা ঘটেছিল তা অবশ্য বশির কোনভাবেই বলতে পারলনা। আমি তাকে বললাম যেভাবেই হোক চাচার কাছ থেকে এটা জানবা।
বশিরের চাচার তখন মাত্র বিয়ে।
বশিরের চাচা এই অকুতোভয় মুক্তিদের মরতে দেখলেন। সেদিন রাতেই বশিরের চাচা তার নব্বধুকে চিঠি লিখে এই অসম সাহসী মুক্তির কথা বলল। কামালের কথা বলল। বশিরের চাচী তারপর সেই চিঠির জবাব দিলেন। চিঠির ভাষাটা এরকম, আমরা যতদূর জানি বাংলাদেশিরা আমাদের সাথে বেইমানি করছে।
আমাদের সেনাবাহিনিরা যুদ্ধ করতে গেছে আর বাঙ্গালদেশিরা ভারতের সাথে আমাদের হারাতে চায়। তারা বেইমান। একটা কথা বলেন তো। মানুষ যত বড় বেইমানই হোক। সে কি নিজের মৃত্যুকে মেনে নিবে? এত সহজে? প্রিয় স্বামি আমি কসম খেয়ে বলছি আপনি চলে আসুন।
বাংলাদেশিদের আটকানো যাবেনা। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যাবে। বশিরের চাচা এই চিঠিকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তখনো পাকিস্তানি সেনাবাহিনি নিশ্চিত যে আমেরিকা চীন যাদের সাথে আছে তাদের এই সামান্য মুক্তিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নব্বধুর কথা ফেলতে পারলেন না।
তিনি কোনরকমে চেস্টা করে বুঝিয়ে সুজিয়ে ছুটি নেওয়ার ব্যাবস্থা করার চেস্টা করলেন। ছুটি নেওয়া যাচ্ছেনা। তিনি একরকমে পালিয়েই কিভাবে জানি পাকিস্তান ফিরে গেলেন। সম্ভবত বিহারী কোন ধনকুব তাকে সাহায্য করেছিল।
ঘটনাটা সম্ভবত খুব মজার না।
১৯৭১ এ এরকম ঘটনা থাকতেই পারে। আমি শুনলাম। তারপর বশীর আমাকে বলল, আমার সেই চাচার তিনটা মেয়ের পর একটা ছেলে হয়েছিল। তুমি কি কামাল কে দেখতে চাও? এ্যা কি বললা? কি নাম তোমার চাচাতো ভাইয়ের? হা ওর নাম কামাল। চাচী তার ছেলের নাম একজন অকুতোভয় এর নামে রাখতে চেয়েছিলেন।
আমার আপন ভাইয়ের নাম মিনহাজ। (রশীদ মিনহাজ পাকিস্তানি এয়ারফোর্স এর একমাত্র নিশান-ই-হায়দার পাওয়া, আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ এর মত, মতিউর রহমান একে বোকা বানিয়েই প্লেন দখলে নিয়েছিল, পরে দুইজনই মারা যায়, মতিউর রহমান কে পাকিস্তানিরা গাদ্দার বলে)। যেহেতু মিনহাজ নাম রাখা হয়েছে, তাই আমার চাচাতো ভাইয়ের নাম কামাল। বশীর তোমার চাচীকে আমি দেখতে চাই। কোন ছবি আছে? বশির বলল, কি যে বল, আমাদের পরিবারের মেয়েদের ছবি নেট এ দেওয়াই যাবেনা।
বশীর তুমি অবশ্যি আমার সালাম তাকে দিবা। আর কামাল এর ফেসবুক একাউন্ট নাই? আমি তাকে বন্ধু বানাতে চাই। বশীর বলল, তার নাই তবে সে একাউন্ট খুলবে। সে এখন পাকিস্তান আর্মিতেই আছে।
পাকিস্তান আর্মি শুনে দমে গেলাম।
এই নাম শুনলে আর শ্রদ্ধা রাখা সম্ভব না। কিন্তু পাকিস্তানি এই ছেলের নাম বাংলাদেশি একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে রাখা!! এটা কি আমার জন্য গর্বের একটা বিষয় না। বশির এর ভাষ্যমতে এটা নাকি তাদের কেউই জানেনা। বশিরের চাচা এটা নিয়ে মুখ খুলেই না। আর চাচীজান একবার খালি তাকে বলেছিল।
সেও তেমন কাউকে বলেনি। এটা কি আর কোন বলার মত ঘটনা! খালি তার মনে হল তার বন্ধু রাশ জিক্স (আমি) এর হয়ত এটা ভাল লাগবে। ঠিক আছে বশির। আমার ভাল লেগেছে। কেন জানি কিছুটা হলেও ভাল লাগছে।
আমার ফেসবুক একাউন্ট এর সাথে সাথে বশির সাথেও আর যোগাযোগ নেই (ঐ একাউন্ট ব্যান)। তাকে খুঁজলে হয়ত পাওয়া যাবে। মোহাম্মদ আমীর এর গ্রুপ এ তাকে আর পেলাম না। তার এক্সাক্ট নামটাও কেন জানি মনে নাই। থাক।
তাকে আর কি দরকার!!
তবে কামাল নামে শহিদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আপনাদের কারনেই আজ আমরা বুক ফুলে শ্বাস নিতে পারি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।